“শিল্পের মূল রহস্যের সন্ধান কী তা জানতে হলে যে কোনো দেশের প্রাগৈতিহাসিক ছবি বা বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রকৃত পটুয়া ছবিকে বিশ্লেষণ করতে হবে; কারণ ছবির মূল সত্যের সন্ধান এখানে এসেছিল।"- আলোচনা করো।

প্রাগৈতিহাসিক ছবি ইতিহাস সৃষ্টির পূর্বাবস্থার ছবি। যখন মানুষ ইতিহাসের আদিপর্বে কেবল গোষ্ঠীবদ্ধ যাযাবর, তখন তাদের শিল্প ছিল, ছিল সৃষ্টির প্রেরণা। হাতের কাছে তারা যেসব প্রাকৃতিক উপকরণ পেত তাই দিয়ে পাহাড়ের গায়ে বা মাটির বুকে মনের বাসনা কামনা কল্পনাকে এঁকে রাখত। এই প্রচেষ্টা ছিল তাদের জীবন-সংগ্রামের অঙ্গ। তাই শিল্পের রহস্য এসবের মধ্যে ফুটে উঠেছিল। কিন্তু এগুলো ছিল বিচ্ছিন্ন শিল্প। কোনো সংহত জগৎ এদের ছিল না। এদের পুরাণের ভিত্তিও ছিল না, কারণ পুরাণ যত পুরাতনই হোক না কেন, তা রচিত হয়েছিল সংহত সমাজের যুগে। এইরকম একটা পর্যায়ে পটুয়া শিল্পের প্রচলন হয়েছিল। পটুয়া শিল্পের জগৎ সংহত ও পুরাণ-বিশ্বাস নির্ভর। পটুয়ারা যে জগতের সন্ধান পেয়েছিল, সেই জগৎ ছিল সামান্য লক্ষণের জগৎ। একটা সংহত পুরাণের ওপর তার প্রতিষ্ঠা। প্রাগৈতিহাসিক ছবিতে পোশাকি শিল্পের ভাষাও ছিল না। পুরাণে বিশ্বাসও ছিল না। কিন্তু পটুয়া শিল্পীদের মতো এরাও শিল্পের সত্যকে আবিষ্কার করতে পেরেছিল। এই আবিষ্কার হয়েছিল অজ্ঞানে বা অজ্ঞাতসারে। এর দ্বারা বোঝা যায় এরা সচেতন শিল্পী ছিল না। এই শিল্পসত্যকে তারা ধরে রাখতে পারেনি।


সভ্যতার অগ্রগামিতার সঙ্গে সঙ্গে যখন জীবনে ও সমাজে নানা চাকচিক্য, নানা দীপ্তি এল, তখন প্রাগৈতিহাসিক শিল্পের প্রাণসত্তা হারিয়ে গেল। শৌখিনতার জগতে শিল্পীরা নেমে পড়ল। শিল্পীর দল কোমর বেঁধে নেমে পড়ল পালিশ করার কাজে। এই দিকে তারা নজর দিল। শিল্পের আসল কথা যে ভাবসৃষ্ট তা তারা ভুলে গেল। শিল্পের সাধনা যোগসাধনার মতো। সন্ন্যাসীরা এই যোগের পথে অগ্রসর হয়ে যদি ঈশ্বরধ্যানের কথা ভুলে যান তবে যেমন বিপদ হয়, এও সেইরকম। যোগভ্রষ্ট হয়ে যদি কেউ ‘সিদ্ধাই’ বা ‘বিভূতি' নিয়ে মেতে ওঠে তাহলে তার সাধনা যেমন ব্যর্থ হয়, এই ধরনের আধুনিক শিল্পেও অনেকটা তাই। প্রাগৈতিহাসিক শিল্পে এই পালিশ করার দক্ষতা ছিল না। কারণ তা ছিল ইতিহাসের পূর্বাবস্থার সৃষ্টি। পটুয়া শিল্পের সঙ্গে এই দিক থেকে এদের মিল ছিল। পটুয়া শিল্প ছিল ঘরোয়া, সহজ ও সরল। পটুয়া ছবি বাংলাদেশের নিজস্ব সম্পদ। বাংলার পুরোনো শিল্পীরা পটের বুকে যেসব বস্তুগুলির চিত্রকলা আঁকত, তার মধ্যে শিল্পের সত্য ধরা পড়েছিল। বাংলা লোকশিল্পের প্রথম বোধ এই পটুয়া শিল্প হতে এসেছিল। এই বোধই শিল্পের মূল ভাব। শিল্পের এই ভাবসত্যকে শিল্পীরা তাদের সৃষ্টির মধ্যে প্রাণবন্ত করে ফুটিয়ে তুলেছিল। এই ভাবসত্যকে বুঝতে হবে শিল্পের গড়ন ও বক্তব্যকে বিচার করে। পটুয়া শিল্পের মধ্যে এই রসবোধ একটা ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছিল। এই ‘পাকা ভিত্তি' অর্থাৎ সংহত পৌরাণিক বিশ্বাস পটুয়া শিল্পের প্রাণ। পটুয়া শিল্পীরা একটা শক্ত ভিত্তির উপর শিল্পকে দাঁড় করিয়েছিল। এই সব পর্যালোচনা করলে শিল্পের মূল রহস্যকে জানা যাবে। প্রাগৈতিহাসিক ছবি বা পটুয়া শিল্পের মধ্যে গুণগত ব্যবধান যথেষ্ট। তবু এই দুই শিল্পের এমন কতকগুলি সামান্য যা প্রণিধান করলে শিল্পের মূল রহস্য জানা যাবে। ছবির মূল সত্যের সন্ধান শিল্পীরা পেয়েছিল।


সভ্যতার বিভিন্ন পর্যায়ে শিল্পীগণ নানাভাবে তাদের শিল্পসৃষ্টি রেখে যান উত্তরাধিকারীর জন্য। সেই শিল্প পর্যালোচনা করলে শিল্পের বিকাশের রহস্যকে বোঝা যাবে। শিল্পের এই বিকাশের রহস্যই শিল্পের সত্য। শিল্পের মূল উদ্দেশ্য সৌন্দর্যসৃষ্টি। এই সৌন্দর্যসৃষ্টি শিল্পবিকাশের ইতিহাসে মূল সত্য। প্রাগৈতিহাসিক ছবি বিশেষ করে বাংলা দেশের পটুয়া ছবি বিশ্লেষণ করে ছবির মূল সত্যকে খুঁজে পাওয়া যায়। শিল্পীরা এই সত্যের সন্ধানেই ব্যাপৃত ছিল। পুরাণের ভিত্তি ছাড়া কখনও সংহত শিল্প প্রত্যাশা করা যায় না। এই সংহতি ছাড়া শিল্পের সত্য জীবন্ত হয় না। প্রাগৈতিহাসিক শিল্প যে খাপছাড়া, পটুয়া শিল্প যে সংহত, এই সত্যকে প্রণিধান করলে উভয়ের পার্থক্য যেমন জানা যায় তেমনি শিল্পের ইতিহাসের শিল্পসত্যকেও জানা যায়।