“আমি অনেক অনুসন্ধান করিয়া দেখিতেছি, পরের জন্য আত্মবিসর্জন ভিন্ন পৃথিবীতে স্থায়ী সুখের অন্য কোন মূল্য নাই।”—উক্তিটি বিশ্লেষণ করো।

বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর ‘আমার মন' প্রবন্ধে মানব জীবনের চরম চরিতার্থতা সম্বন্ধে এই তত্ত্বভাবনা প্রকাশ করেছেন : পরের জন্য আত্মবিসর্জন ছাড়া এই পৃথিবীতে স্থায়ী সুখের অন্য কোনো মূল বা উৎস নেই। আমরা এই সংসারে কী করতে আসি প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, আমরা শুধু মন বাধা দিতেই সংসারে জন্মগ্রহণ করি। যারা স্বভাবত অত্যন্ত আত্মপ্রিয়, তারাও বিয়ে করে সংসারী হয়ে স্ত্রী পুত্রের কাছে আত্মসমর্পণ করে বলেই সুখী হয়, নতুবা তারা কিছুতেই সুখী হত না। মানব সংসারের যে সমস্ত বস্তু সুখদায়ক বলে পরিচিত, তাদের থেকে লব্ধ সুখের স্বরূপ বিশ্লেষণ করলেই আমরা এই সত্য যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে পারব।


কমলাকান্ত তার গভীর অনুভূতির কথা ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছেন, “আমি অনেক অনুসন্ধান করিয়া দেখিতেছি, পরের জন্য আত্মবিসর্জন ভিন্ন পৃথিবীতে স্থায়ী সুখের অন্য কোন মূল নেই। ধন, যশ, ইন্দ্রিয়লব্ধ সুখ আছে বটে, কিন্তু তাহা স্থায়ী নহে।” বস্তুত ঐশ্বর্য, খ্যাতি প্রভৃতি থেকে যে ইন্দ্রিয়সুখ লাভ করা যায়, তা স্থায়ী নয়। এ সকল বস্তু প্রথমবারে যে পরিমাণে সুখদায়ক হয়, দ্বিতীয়বারে সে পরিমাণে হয় না, তৃতীয়বারে আরো অল্প সুখদায়ক হয়, ক্রমশ অভ্যাসে তাদের থেকে কিছুই সুখ পাওয়া যায় না। সুখ থাকে না, কিন্তু দু'টি অতৃপ্তির কারণ দেখা দেয়: প্রথমত, অভ্যস্ত বস্তুতে সুখ না হোক, অভাবে গুরুতর অসুখ বা অতৃপ্তি হয় এবং তৃপ্তিবিহীন আকাঙ্ক্ষার বৃদ্ধিতে যন্ত্রণা হয়। সুতরাং পৃথিবীতে যেসব বিষয় কাম্যবস্তু বলে চিরপরিচিত, সে সমস্তই অতৃপ্তিকর ও দুঃখের মূল। সমস্ত ক্ষেত্রেই যশের সঙ্গে নিন্দা, ইন্দ্রিয়সুখের সঙ্গে ব্যাধি, ঐশ্বর্যের সঙ্গে ক্ষতি ও মনস্তাপ অবিচ্ছেদ্যভাবেই জড়িত থাকে। সুন্দর দেহ জরাগ্রস্ত বা ব্যাধিজীর্ণ হয়। সুনামেও মিথ্যা কলঙ্ক রটনার স্পর্শ লাগে, ঐশ্বর্য স্ত্রীর অবৈধ প্রণয়ী ভোগ করে, মানসম্ভ্রম মেঘমালার মতো শরৎকালের পরই বিলীন হয়।


বিদ্যা বা জ্ঞানও তৃপ্তিদায়ক নয়, শুধু অন্ধকার থেকে গাঢ়তর অন্ধকারে নিয়ে যায়, এই সংসারের তত্ত্বজিজ্ঞাসা নিবারণ করে মানুষকে চিরস্থায়ী সুখের অমৃতস্পর্শ এনে দেয় না। আমরা কি কখনও শুনতে পাই যে কেউ বলেছে, সে অর্থোপার্জন করে বা যশ লাভ করে সুখী হয়েছে, তার সমস্ত আকাঙ্ক্ষার নিবৃত্তি ঘটেছে। কেউ যে কখনও একথা শোনেনি, এটা শপথ করেই বলা যায়। এর থেকে ধনমান প্রভৃতির নিষ্ফলতার গুরুতর প্রমাণ আর কি পাওয়া যেতে পারে। বিস্ময়ের কথা এই যে, এমন অখণ্ডনীয় প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও প্রতিটি মানুষই এই সমস্ত কামাবস্তুর জন্য প্রাণপাত করে। মাতৃস্তন্য দুগ্ধের সঙ্গে সঙ্গে ধনমানাদির সর্বসারবত্তায় বিশ্বাস শিশুর হৃদয়ে সঞ্চারিত হতে থাকে। সে দেখে, তার পিতামাতা, ভাইবোন, গুরু, ভৃত্য, প্রতিবেশী শত্রুমিত্র প্রভৃতি সকলেই অর্থ, যশ, মান, সম্ভ্রম প্রভৃতির জন্য লালায়িত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেইজন্য শিশু কথা ফোটার আগেই সেই পথে যেতে শেখে। কিন্তু করে মানুষ নিত্য সুখের একমাত্র উৎস অনুসন্ধান করে দেখবে? বিদ্বান, বুদ্ধিমান দার্শনিক সংসারতত্ত্ববিদ প্রভৃতি থেকেই নিজেদের জ্ঞানগরিমা নিয়ে আস্ফালন করতে পারেন, কিন্তু তাঁরা সকলে মিলে যদি পরসুখবর্ধন ছাড়া মানুষের স্থায়ী সুখের অন্য কোনো মুল আছে কিনা অনুসন্ধান করেন, তবে দেখতে পাবেন, আর অন্য কোনো উৎস নেই, নান্য পন্থা বিদ্যতে অয়নায়।


পরসুখবর্ধন ছাড়া যে মানুষের স্থায়ী সুখের অন্য কোনো মূল নেই, এই কথাটি অনেক প্রাচীন। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ভারতবর্ষে বুদ্ধদেব এই কথাটিই কতভাবে প্রচার করে গেছেন, তারপরও শত সহস্র লোকশিক্ষক শত সহস্রবার এই শিক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু কিছুতেই লোকে শেখে না, আত্মপ্রিয়তার মায়াজাল কাটিয়ে উঠতে পারে না। আবার ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে ইংরেজি শাসন, ইংরেজি সভ্যতা ও শিক্ষা প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাহ্যসম্পদের প্রতি অনুরাগ এসে দেশটাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে আরম্ভ করেছে। ইংরেজ জাতি অত্যন্ত বাহ্যসম্পদপ্রিয়, এটাই ইংরেজ সভ্যতার প্রধান চিহ্ন; তারা এদেশের বাহাসম্পদসাধনেই রত, আমরা তা-ই ভালোবেসে আর সবকিছু বিস্মৃত হয়েছি। আমরা আমাদের হৃদয় থেকে ভারতবর্ষের অন্যান্য সমস্ত আদর্শকে নির্বাসিত করেছি, দেশে সিন্ধু থেকে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত শুধু বাহ্যসম্পদের পূজা আরম্ভ হয়েছে। বাণিজ্য বিস্তার, চারদিকে রেলওয়ে প্রতিষ্ঠায়, টেলিগ্রাফে বাহাসম্পদের তীব্র আলোকচ্ছটা দেখে আমরা মোহমুগ্ধ ও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম।


রেলওয়ে টেলিগ্রাফ প্রভৃতি বাহ্যসম্পদের উপকরণগুলিতে মানুষের কতটুকু মনের সুখ বৃদ্ধি পাবে, এই সমস্ত বস্তু কি কারো অশান্ত মনকে শান্ত করতে, কারো মনের যন্ত্রণার আগুন নির্বাপিত করতে, যে কৃপণ আকণ্ঠ ধনতৃষ্ণায় দগ্ধ আছে, তার তৃষ্ণা কি নিবারণ করতে পারবে—আমরা ইংরেজদের বাহাসম্পদের আয়োজনে মোহমুগ্ধ হয়ে জীবনের এই সমস্ত মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখতে পাইনি। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজি ও বাংলা সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্র, বক্তৃতা, বিতর্ক, ভাষণ ইত্যাদি সমস্ত কিছুতেই শুধু বাহাসম্পদের পূজার মন্ত্রই উচ্চারিত হত, শুধু টাকা বাড়াও, যাতে টাকা বাড়ে তার উপায় কর– চারদিকে শুধু একথাই শোনা যেত, আর তাকেই আমরা জীবনের মূল মন্ত্ররূপে গ্রহণ করেছিলাম। ইংরেজ অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ, জেমস্ মিল ও জন স্টুয়ার্ট মিল প্রমুখ ইংরেজ উপযোগবাদের প্রবক্তাদের রচনায় বাহ্যসম্পদকেই সভ্যতার মানদণ্ডরূপে প্রতিপন্ন করা হয়েছে, ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি সম্প্রদায় তাদের রচনাকেই জীবনবেদরূপে গ্রহণ করেছিল, অর্থের পূজায় নিজেদের হৃদয় ধর্মকে বলি দিতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। কিন্তু এই বাহাসম্পদে ক’জন অশিষ্ট শিষ্ট, ক'জন অধার্মিক ধার্মিক এবং ক'জন অপবিত্র পবিত্র হয়েছে, এই প্রশ্নের উত্তর কি এই বাহাসম্পদের পূজারীরা দিতে পারবে? পারবে না। তাহলে এই ইয়োরোপীয় সভ্যতার উচ্ছিষ্ট আবর্জনা ভারতবর্ষে রেখে দেওয়ার কি যৌক্তিকতা আছে?


বৈষয়িক সমৃদ্ধির প্রবক্তারা পারেন, মানুষকে, তার উদরপূর্তি অর্থাৎ ক্ষুধা দূর করতে হবে। এবং ক্ষুধা যাতে ভালোভাবে তৃপ্ত হয়, তাঁরা সেই চেষ্টায়ই রত। সেটা ভালো বটে, কিন্তু তাই নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করা অর্থাৎ ক্ষুধা তৃপ্ত করতে গিয়ে ইন্দ্রিয়সর্বস্ব প্রাণীতে পরিণত হওয়া এবং মনুষ্যধর্ম বিসর্জন দেওয়া অনুচিত। উদর তৃপ্তি থেকে মনের সুখ স্বতন্ত্র জিনিস, তার বৃদ্ধির জন্য চেষ্টা না করলে ইন্দ্রিয়সুখ পরিতৃপ্তির সমস্ত উপকরণ থাকলেও মানুষের জীবন মরুভূমির মতো শূন্য ও তাপদগ্ধ হতে বাধ্য। শুধু বিবাহ করলেই মানুষ যে সুখী হয় তা নয়। যদি পারিবারিক স্নেহের গুণে বিবাহিত ব্যক্তিদের আত্মপ্রিয়তা লুপ্ত না হয়ে থাকে, যদি আত্মপরিচয়কে ভালোবেসে তারা তাবৎ মানব জাতিকেই ভালোবাসতে না শেখে, তবে বিবাহ নিষ্ফল। বিবাহ বন্ধনে যদি মানব চরিত্রের উৎকর্ষ সাধিত না হয় এবং তার মধ্য দিয়ে মানুষ মানব প্রীতির শিক্ষা না পায়, তবে তার কোনো সার্থকতা নেই।


মনের সুখ স্বতন্ত্র সামগ্রী—আহারাদি বাহাসুখ ও মনের সুখ স্বতন্ত্র বস্তু। ঐহিক সুখসাধনের উপকরণ থাকলেও মনের সুখ না থাকতে পারে। বাহাসুখ বৃদ্ধি হলেই মনের সুখ হবে বঙ্কিমচন্দ্র এই ভ্রান্ত ধারণা দূর করতে বলেছেন। যে পরের সুখ সাধন করেনি বা করার চেষ্টা করেনি, সুখে তার কোন অধিকার নেই বলে কমলাকান্ত অভিমত প্রকাশ করেছেন। বস্তুত বঙ্কিমচন্দ্র এই মতটি নীতিবিদ্যুলভ দৃঢ়তার সঙ্গে স্থাপন করেছেন। কমলাকান্তের রসোজ্জ্বল স্নিগ্ধ মূর্তির সঙ্গে চিন্তাবীর, আদর্শবাদী বঙ্কিমচন্দ্রের দৃঢ়তার সংমিশ্রণ দপ্তরের মধ্যে বহুস্থলে হয়েছে।