“আজকে আমাদের উত্তরাধিকার আবিষ্কার করতে হলে যাদের রচনাবলী বিচার করতে হবে, তাঁদের মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের বিশেষ মর্যাদা"–প্রসঙ্গ নির্দেশ করে এই উক্তির যাথার্থ্য বিচার করো।

সাহিত্যে উত্তরাধিকারের সন্ধান কবির প্রধান কর্তব্য। কারণ সাহিত্য দেশ, কাল ও সমাজের প্রেক্ষিতে রচিত হয়। প্রতি দেশের সাহিত্যে তার পুরাতন ধারার বিবর্তনে বিবর্তিত হয়ে নব নব রূপে আত্মপ্রকাশ করে। কালে কালে এর রূপ বদলায়। এর মধ্যে ঐতিহাসিক কারণ যদি ঘটে, তবে সাহিত্যের উপপ্লব সূচিত হয়। মধ্যযুগে তুর্কী-বিজয়োত্তর বিপর্যয়ে সমাজে যে উত্থান-পতন শুরু হয়, তাতে আর্য-অনার্য সংঘর্ষ ও সমন্বয় হয়। অনার্যধারা সাহিত্যে দেশজ ধারা হিসেবে গৃহীত হয়। বাংলা সাহিত্যে তুর্কী বিজয়ের পর থেকে অনার্য-গোষ্ঠীর পুজিত ব্রতকথা-ছড়া-মঙ্গলকাব্য ক্রমে ক্রমে প্রবল হয়। চৈতন্যযুগে পৌরাণিক উত্থানের ফলে এই ধারার সমন্বয় হয়। পৌরাণিক ও লৌকিকের সমন্বয়ে বাংলা মঙ্গলকাব্য তার সাহিত্যিক রূপে স্থিরীকৃত হয়। বাংলা মঙ্গলকাব্য সৃষ্টি বৈষুব পদাবলী ও বৈষুবেতর আখ্যানকাব্যে বা পাঁচালী কাব্যে, রোমান্টিক ও দেশজকাব্যের ধারা লক্ষ্য করা যায়। রামায়ণ-মহাভারত-ভাগবতের চর্চায় পৌরাণিক সংস্কৃতির অধ্যায় যেমন প্রবলভাবে দেখা দেয়, তেমনি লৌকিক আততির স্রোত-এ বহমান হয়। লেখক বলেছেন, 'চণ্ডীকাব্যে, মঙ্গলকাব্যে এমনকি বৈষুব পদাবলীতে এই স্বাস্থ্য আমাদের আশ্চর্য লাগে। এই মনোবৃত্তির ফলে দেবদেবীর প্রতি মানুষের মহিমা আরোপিত হয়, সদাগরদের নাকাল করে’ এই উত্তরাধিকার যে আবিষ্কার করাই সব সাহিত্যভাবুকদের পক্ষে প্রধান কাজ, এই উৎসকে জানতে গেলে ঈশ্বর গুপ্তকে বুঝতে হবে। ব্রিটিশপূর্ব শিল্পসাহিত্যের উৎস দেশের ঐতিহ্যে সুপ্ত আছে। সেই সুপ্ত ঐতিহ্যকে আবিষ্কার করেই ঈশ্বর গুপ্ত কবির কাব্যচর্চা সার্থক হবে। ঈশ্বর গুপ্তের বস্তুনিষ্ঠ মনোভাব তাঁর বাস্তবধর্মী কাব্যে ফুটে উঠেছে। ‘আনারস’, ‘তপসে মাছ', 'ছাগল' প্রভৃতি বস্তুধর্মী কবিতা। “ তপসে মাছ’বা ‘পাঠা’ কিছুতেই এ বস্তুবাদীর আপত্তি নেই।” ‘ছাগল’ পদ্যে কবি বলেছেন—

‘রসভরা রসময় রসের ছাগল।

তোমার কারণে আমি হয়েছি পাগল।।'


‘আনারসকে’ দেখে কবির মনে হয়—

‘বন হতে এল এক টিয়ে মনোহর। 

সোনার টোপর শোভে মাথার উপর।।'


এই পদ্যে আনারসের বর্ণনা বস্তুবাদী কবিতার বর্ণনা। প্রাকৃত মনের বাস্তবিকতাতেই কবির সহানুভূতি রূপ পায়—

‘কিছুদিন মা! দয়া করি    রপ্তানিটা বন্ধ রাখো,

ধনে প্রাণে হল কাঙালী।

ভাত বিনে বাঁচিনে,      আমরা ভেতো বাঙালি,

চাল দিয়ে মা বাঁচাও প্রাণে চালের জাহাজ চেলো নাকো।।


কবি সামাজিক সমস্যার প্রশ্ন জানেন, কিন্তু উত্তর জানেন না। তাই ভিক্টোরিয়ার সিংহাসনে কবির ভরসা—

'ওগো মা ভিক্টোরিয়া 

কর গো মানা; যত তোর রাঙা   ছেলে আর যেন মা

চোখ রাঙে না চোখ রাঙে না।।"


দেশজ সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী বিধবাবিবাহকে পছন্দ করেন না। স্ত্রীশিক্ষাও তার কাছে আদর্শ শিক্ষা নয়। তাঁর ব্যঙ্গ তাই ক্ষুরধার হয়ে ওঠে—

‘বিবিজ্ঞান চ'লে লবেজান ক'রে। 

শাড়ীপরা এলোচুল আমাদের মেম

বেলাক নেটিভ লেডি শেম্ শেম্ শেম্। 

সিন্দুরের বিন্দুসহ কপালেতে উল্কি”

নসী, যসী, ক্ষেমী, রামী, যামী, শামী, গুল্কি'

‘পৌষপার্বণ’ দেশজ জীবনের বিরাট উৎসব। সেই উৎসবে কবি উৎসাহী।


আজকের কবিকুলকে দেশজ সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হবার কথা বলতে হবে। এই সমস্যার পথে ঈশ্বর গুপ্ত নতুন দিশা। দেশজ উত্তরাধিকারকে জানতে পারলে কবিদের কাব্যকৃতি সার্থক হবে। এই বোধকে উত্তরাধিকারীর জন্য ব্যাপ্ত করার জন্য ঈশ্বর গুপ্তের বিশেষ মর্যাদা। বঙ্কিমচন্দ্র গুপ্ত কবির প্রতিভাকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন এই ভাবনায় ভাবিত হয়ে রসিকের দৃষ্টিভঙ্গীতে গুপ্ত কবির যথার্থ বিচার সম্ভব হয়েছে। ঈশ্বর গুপ্তকে ‘খাঁটি বাংলার' কবি বলে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর দেশজ উত্তরাধিকারের কথা বলেছেন। এই দেশজ উত্তরাধিকার না থাকলে ঈশ্বর গুপ্তের ঐতিহাসিক বিচার সম্ভব হয় না। আলোচ্য উক্তিতে তাই লেখক ঈশ্বর গুপ্তকে এক ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গীতে বিশ্লেষণ করেছেন।