‘রূপকথা' প্রবন্ধটির সাহিত্যমূল্য কতখানি তা প্রবন্ধসাহিত্যের মানদণ্ডে বিচার করো।

‘রূপকথা’ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশিষ্ট প্রবন্ধ। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় হার্দ্যধর্মের সঙ্গে মননের এক মণিকাঞ্জনযোগ সার্থকতায় মণ্ডিত হয়ে ওঠে। ইংরেজি সাহিত্যের বিশ্রুত অধ্যাপক ড. বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে গভীর পরিচয়ের ফলে পাশ্চাত্য রচনার ধারাটিকে তাঁর স্বকীয় শক্তিতে অনুসৃত করেছেন। তার ফলে তাঁর রচনায় জ্ঞানের নিষ্কর্যকে লাভ করা যায়। প্রবন্ধ সাহিত্যের মুখ্য বৈশিষ্ট্য তার যুক্তিধর্মী অন্বয়। এই পারিপাট্য ও রচনাসৌন্দর্য প্রবন্ধকে স্থায়ীমূল্যে মূল্যবান করে। তথ্য অপেক্ষা অভিজ্ঞতা ও ব্যক্তিগত রসাস্বাদ প্রবন্ধে এক স্বতন্ত্র মহিমা দান করে। এইদিক থেকে তাঁর প্রবন্ধ Literature of Power এবং Literature of Knowledge-এর সমন্বিত রূপ। যুক্তিশৃঙ্খলা দিয়ে প্রবন্ধকে উপস্থাপিত করা ও সাহিত্যপাঠের রসাস্বাদকে সঞ্চারিত করা প্রবন্ধের বৈশিষ্ট্য।


শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৃষ্টি সাংকেতিক বা Synthetic। এই দৃষ্টির ফলে তাঁর চিন্তাধারায় সংশ্লেষধর্মিতা লক্ষ্য করা যায়। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৃষ্টি বিশ্লেষণধর্মী। বিশ্লেষণধর্মিতা ও সংশ্লেষধর্মিতার সমন্বয়ে প্রবন্ধের চমৎকারিত্ব নির্ধারিত হয়েছে। প্রবন্ধ যে 'প্রকৃষ্ট বন্ধন' তা শ্রীকুমার বাবুর নানা প্রবন্ধপাঠে বোঝা যায়। তত্ত্ব অধিকারের প্রেরণা তথ্য উন্মোচনের মধ্যে দেখা দেয়। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনা তাই উদ্ধৃতি-কণ্টকিত নয়, পাণ্ডিত্যের প্রদর্শনীতে তৎপর নয়, উল্লেখবাহুল্যে ভারগ্রস্ত নয়, তা অন্তরের অনুভূতিকে স্বতোৎসারিতভাবে প্রকাশ করেই সার্থক হয়ে ওঠে। 'রূপকথা' প্রবন্ধটি এই রীতির একটি সার্থক উদাহরণ।


ভাষাপ্রয়োগের দিক থেকে লেখক ক্ল্যাসিক্যাল রীতির অনুবর্তী। ক্ল্যাসিক্যাল রীতির লেখায় যেমন তৎসম শব্দের প্রয়োগ দেখা যায়, শ্রীকুমারবাবুর লেখায় তেমনি সংস্কার-ঘেঁষা সাধুরীতির ব্যবহার। কিন্তু এই গদ্যরীতির মধ্যে কাব্যধর্মিতা এমন উচ্ছ্বসিত ভাবে আত্মপ্রকাশ করে যা পাঠকের মনকে স্থায়ীভাবে মুদ্রিত করে। প্রত্যেকটি অনুচ্ছেদ যুক্তিনির্ভর চিন্তায় প্রথিত। প্রত্যেক অনুচ্ছেদের ভাববিন্যাস স্বতন্ত্র, কোথাও এই পদ্ধতির পৌনঃপুনিকতা নেই। রূপকথার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে লেখক কাব্যঘন ও রসঘনভাবে তাঁর বক্তব্যকে প্রকাশ করেছেন : “পক্ষান্তরে রূপকথা নামটির চারিধারে একটি রহস্য মাধুর্য, একটি ঐন্দ্রজালিক মায়াঘোর বেষ্টন করিয়া আছে। নামটি আমাদের হৃদয়ের গোপন কক্ষে গিয়া আঘাত করে ও সেখানকার সুপ্ত নামহীন বাসনাগুলির মধ্যে একটা সাড়া জাগাইয়া দেয়।”—এই ব্যাখ্যার মধ্যে লেখকের অনুভূতিপ্রবণতা ও মননশীলতা যুগপৎ আত্মপ্রকাশ করেছে।


রূপকথা ছিল ঠাকুমার স্নেহাঞ্চলে, স্নেহনীড়ের নিভৃত কোণে। সেখান থেকে ছিনিয়ে এনে সাহিত্যের প্রকাশ্য দরবারে দাঁড় করিয়ে দিয়ে একালের সমালোচকরা আধুনিক সাহিত্যিক মানদণ্ডে তার বিচার করেছে। লেখক এই প্রচলিত মতকে খণ্ডন করেছেন সংহত প্রকাশরীতিতে—“কিন্তু রূপকথাকে প্রকৃত সাহিত্যের নিয়মে বিচার করলে। ইহার প্রতি অবিচারই করা হইবে। আধুনিক সাহিত্যের আদর্শে ইহা গড়িয়া উঠে নাই। আধুনিক সাহিত্যের উদ্দেশ্য ও গঠনপ্রণালীও ইহার ছিল না। ইহার সমস্ত মাধুর্য উপলব্ধি করিতে হইলে ইহাকে জন্মমুহূর্তের আবেষ্টনের মধ্যে ফেলিয়া দেখিতে হইবে।” রূপকথার সংজ্ঞা ও বিচারের আদর্শ এবং জন্মমুহূর্তকে উপলব্ধি করার প্রয়োজনীয়তা লেখক সুন্দরভাবে বিন্যস্ত করেছেন। জন্মমুহূর্তের আবেষ্টনের বর্ণনায় শ্রীকুমারবাবু কবিস্বভাবী—"বর্ষণমুখর রাত্রি : স্তিমিতপ্রদীপ গৃহ; অন্ধকারে গৃহকোণে আলোছায়ার লীলাচল নৃত্য, সর্বোপরি কল্পনাপ্রবণ আশা-আশঙ্কা-উদ্বেল শিশুহৃদয় এবং ঠাকুরমার স্নেহসিক্ত, সরস, তরল কণ্ঠস্বর; এই সকল মিলিয়া যে একটি অনুপম মায়াজাল, যে একটি রহস্যের ঐক্যতান সৃষ্টি করে, তাকে ষ্টীলের কলমের মুখে, ছাপার বই-এর পাতায় ও সাহিত্য ব্যবসায়ীর শিক্ষিত রুচির নিকট ছিন্নভিন্ন হইয়া পড়ে।" লেখকের কাব্যানুভূতির উজ্জ্বলতম পরিচয় এই ব্যাখ্যায় আছে। এইভাবে রূপকথার সংজ্ঞা ও জন্ম-পরিবেশের বর্ণনা করতে গিয়ে লেখক কোন পাশ্চাত্য পণ্ডিতের উল্লেখ দিয়ে রচনাটিকে ভারাক্রান্ত করেননি, বরং লেখকের ব্যক্তিগত অনুভূতির রসে জারিত করে তাকে প্রকাশ করেছেন।


সমালোচকরা প্রবন্ধের মধ্যে নির্মিতিকৌশলের কথা বার বার বলেন। কবি কর্ণপূর বলেছেন : “অসাধারণ চমৎকারকারিনী রচনা হি নির্মিতি।” এই কারণেই প্রবন্ধের গঠনসৌন্দর্যকে অনেকে নির্মিতি বলেছেন। সমালোচক বলেছেন, অসাধারণ চমৎকারকারিনী রচনাই নির্মিতি। এই গঠনসৌন্দর্যের মধ্যে প্রধান গুণ পরিমাপ। 'রূপকথা' প্রবন্ধে এই পরিমাপের মাধুর্য রচনাটিকে সাহিত্যিক উৎকর্ষ দান করেছে।


প্রবন্ধের মধ্যে একটা বিতর্কের অবকাশ থাকে। এখানেও লেখক বিপরীত মতকে এনে যুক্তিতর্ক দিয়ে তাঁর বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। রূপকথার বিরুদ্ধে প্রাপ্তবয়স্কদের প্রধান অভিযোগ ইহার অলীকতা ও অবাস্তবতা। এই অভিযোগ খণ্ডন করে লেখক রূপকথার বাস্তবতার কথা ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি রূপকথার গল্পগুলি বিশ্লেষণ করে, সেখানে সামাজিক ও পারিবারিক ব্যবস্থার চিত্রকে প্রতিভাত হতে দেখেছেন। এক্ষেত্রে লেখকের যুক্তি কাব্যিক : "নীল আকাশ অবাস্তব হইলেও ইহা শত নিগূঢ় বন্ধনে আমাদের বাস্তব জীবনের সহিত আপনাকে জড়াইয়া রাখিয়াছে।” নীল আকাশ আমাদের তুচ্ছ জীবনের ওপর চন্দ্রাতপের মতো বিস্তৃত। নীল আকাশ আমাদের কলকোলাহলের ওপর এক স্নিগ্ধ শাস্তির প্রলেপ বুলিয়ে দেয়। এই মানদণ্ডে বাস্তবের কার্যকারিতা ব্যাখ্যা শ্রীকুমারবাবুর গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণশীলতার পরিচায়ক। নীল আকাশের ঘন নীলরূপের দিকে চেয়ে আমাদের উদ্ধত বিদ্রোহ ও অশান্ত প্রকৃতি মাথা নত করে। সুতরাং ইহাকে অবাস্তব বলিয়া উড়াইয়া দিলে মানব-মন তাহার অনেকটা সৌন্দর্য ও উদারতা হারায়।" রূপকথার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে এই ধরনের যুক্তিনির্ধারণ লেখকের কবিমন ও অনুভূতিপ্রবণতাকে প্রমাণিত করে—“সেই হিসাবে রূপকথারও একটা প্রয়োজনীয়তা আছে।" এর পর লেখকের সিদ্ধান্ত। রূপকথা অবাস্তব নয়, বাস্তব। এই সিদ্ধান্ত মৌলিক ও গভীর চিত্তার সাক্ষ্যবাহী। সাধারণত লোকে রূপকথাকে অবাস্তবের কেন্দ্রলোক বলে মনে করে। কিন্তু লেখক তাঁর স্বাতন্ত্র্যাচিন্তায় সেই অবাস্তবের ধারণাকে খণ্ডন করেছেন।


শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রবন্ধের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ ধর্মী ও উদ্ভাবনীক্ষমতা সম্পন্ন। বলা বাহুল্য, এটাই সমালোচনা-সাহিত্যের আদর্শ। তিনি কোন পূর্বপ্রচলিত মতকে আপ্তবাক্য হিসেবে গ্রহণ করেননি, তাকে তিনি বিতর্কিত করে তুলেছেন। উদাহরণ দিয়ে বলা যায় যে, রূপকথাকে যাঁরা অলীক ও অবাস্তব বলে উড়িয়ে দেন, তাদের মতামতকে সমালোচনার অঙ্কুশাঘাতে তিনি -বিচ্ছিন্ন করেছেন। শ্রীকুমারবাবুর ভাষায়, “রূপকথার বিরুদ্ধে প্রাপ্তবয়স্কদের প্রধান অভিযোগ–ইহার অলীকতা ও অবাস্তবতা। অবশ্য, বাস্তব না হইলেই যে কাহারও পৃথিবীতে স্থান নাই, এ কথা কেহ বলেন না। সংসারে অবাস্তবেরও একটা প্রয়োজন আছে। মাটির সহিত যোগ না থাকিলে, মাটিতে শিকড় না গাড়িলেই, আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহারিক জীবনের সহিত প্রত্যক্ষ সম্পর্কে না আসিলেই কাহাকেও এই সুন্দর পৃথিবী ও মানবমন হইতে নির্বাসিত করা যায় না। সুতরাং ইহাকে অবাস্তব বলিয়া উড়াইয়া দিলে মানবমন তাহার অনেকটা সৌন্দর্য ও উদারতা হারায়। সেই হিসাবে রূপকথারও একটা প্রয়োজনীয়তা আছে।" অন্যত্র বলেছেন: “স্ফুটতাই বাস্তবতার একমাত্র লক্ষণ নহে।" এই ধরনের মন্তব্য লেখকের সত্তা বা বোধ থেকে উৎসারিত। এইভাবে প্রচলিত মতামতকে খণ্ডন করে সমালোচক তাঁর মৌলিক মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। যে কোন শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের প্রধান গুণ মৌলিকতা। মৌলিক চিন্তার আলোকে যদি রচনা উদ্ভাসিত না হয়, তবে রচনায় উৎকর্ষ আসে না। এই উৎকর্ষ প্রবন্ধসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। ‘রূপকথা’ এই বিচারে উৎকৃষ্ট প্রবন্ধাবলীর অন্যতম। এখানে বিষয়বস্তুকে ভাবের সঙ্গে অঙ্কিত করেছেন, কখনও কখনও বিষয়নিষ্ঠ হয়েছেন। কখনও কখনও “intense personal emotion”-কে ব্যবহার করেছেন। এইভাবে রচনার পারিপাট্য, সৌকর্য ও নির্মিতিকৌশল প্রবন্ধকে উৎকৃষ্ট সাহিত্যের পর্যায়ভুক্ত করে তুলেছে।