“তোকে আমি যে-সব চিঠি লিখেছি তাতে আমার মনের সমস্ত বিচিত্র ভাব যেরকম ব্যক্ত হয়েছে এমন আমার আর কোনো লেখায় হয় নি।”—ইন্দিরা দেবীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে 'ছিন্নপত্র'র অনন্যতা বিশ্লেষণ করো।

রবীন্দ্রনাথের প্রথম ও প্রধানতম পরিচয় তিনি কবি। শৈশবাবধি প্রকাশের সাধনাতেই তিনি নিমগ্ন প্রাণ। শিল্পের বিচিত্র শাখায় তাঁর সেই প্রকাশ-বাসনা পরিব্যাপ্ত। আরও বিস্ময়ের কথা যে, কর্মের বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথ একজন সনিষ্ঠ ও অক্লান্ত কর্মীরূপে প্রকাশমান। কিন্তু অজস্র কর্মব্যস্ততার মধ্যেও তাঁর প্রকাশোন্মুখ কবিসত্তা বা শিল্পসত্তা কখনও ক্লান্ত হয়নি। সৃষ্টির প্রাচুর্যে এবং বৈচিত্র্যে রবীন্দ্রনাথ আজও আমাদের কাছে বিস্ময়।


রবীন্দ্রনাথের এই বিচিত্র সৃষ্টিকর্মের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তাঁর পরিচয়। ‘আত্মপরিচয়' গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- “সফল কাব্যই কবির প্রকৃত জীবনী। সেই জীবনীর বিষয়ীভূত ব্যক্তিটিকে কাব্যরচয়িতার জীবনের সাধারণ ঘটনাবলীর মধ্যে ধরিবার চেষ্টা করা বিড়ম্বনা।”


কিন্তু জিজ্ঞাসু পাঠক শুধুমাত্র কবির সাহিত্যিক পরিচয়ে তৃপ্ত হতে পারেন না। বিপুল সাহিত্য-সৃষ্টির মধ্য দিয়ে যে রবীন্দ্র-পরিচয় অভিব্যক্ত, তা শিল্পের প্রয়োজনেই অনেকখানি আদর্শায়িত। ব্যক্তিজীবনের অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা কাব্যের মধ্যে চিরন্তন মানব-সত্যের উচ্চারণরূপে প্রকাশিত। সাহিত্যের জগৎ তো আসলে অলৌকিক মায়ার জগৎ। সেখানে তাই কবির যে প্রতিবিম্ব ধরা পড়ে, তা অনেকখানি রূপান্তরিত ও সূক্ষ্মতার ব্যঞ্জনায় আভাসিত। ব্যক্তিজীবনের ঘটনাসংশ্লিষ্ট রক্তমাংসের পরিচয় সেখানে মেলে না। এমনকি কবির জীবনীর মধ্যেও কবির ব্যক্তিজীবনের সবটুকু পরিচয় পাওয়া যাবে না। “কবিরে পাবে না তাহার জীবন চরিতে”—এ স্বীকারোক্তি তো স্বয়ং রবীন্দ্রনাথেরই। সেদিক থেকে রবীন্দ্রজীবনের ব্যক্তি জীবনের সেই অবগুণ্ঠিত অন্তরালবর্তী দিকগুলি অনেকখানি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর পত্রাবলির মধ্যে। রবীন্দ্র-পত্রাবলিতেই লুকিয়ে আছে রবীন্দ্রনাথের অন্তরঙ্গ পরিচয়।


রবীন্দ্রনাথ তাঁর সুদীর্ঘ আশি বৎসরের জীবন-সীমায় কাব্য ও কর্মসাধনার ব্যস্ততার মধ্যেও অবিশ্রাম চিঠি লিখেছেন। এই চিঠিও আসলে তাঁর একটি অন্যতম প্রকাশ-মাধ্যম। এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত চিঠির সংখ্যাও প্রায় সাড়ে চার হাজার।


অতএব রবীন্দ্রনাথের মনের অকৃত্রিম পরিচয় তাঁর চিঠিপত্রের মধ্যেই বিধৃত, এ কথা নিঃসংশয়ে বলা যায়। চিঠিগুলিই তাঁর মানস-মুক্তির আশ্চর্য সোনালি ফসল। কিন্তু দুঃখের বিষয় রবীন্দ্রনাথের সব চিঠি এখনও গ্রন্থাকারে প্রকাশিত নয়। বিশ্বভারতী এ পর্যন্ত ষোলো খণ্ড ‘চিঠিপত্র' এবং 'ছিন্নপত্র’ বা ‘ছিন্নপত্রাবলী’, ‘পথে ও পথের প্রান্তে’ ও ‘ভানুসিংহের পত্রাবলী' গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের বহু চিঠিপত্র মুদ্রিত হয়েছে যা এখনও গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। আজও বহু চিঠি ব্যক্তিগত সংগ্রহে অজ্ঞাত ও অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে। তবু যেটুকু প্রকাশিত, তার মধ্যে থেকেই আমরা পেয়ে যাই বস্তুজীবনের উত্তাপে উজ্জ্বল, অনাবিল কৌতুকে মুখর, প্রকৃতির সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ, মানুষের প্রতি প্রীতিতে মধুর, প্রাত্যহিক জীবনের শোকে-দুঃখে-আনন্দে-উল্লাসে সজীব এক মানুষের মুখ। কিন্তু এই বিপুল পত্র-সাহিত্যের মধ্যে ‘ছিন্নপত্র’ বা ‘ছিন্নপত্রাবলী’র বিশিষ্টতা এখানেই যে, এই পত্রাবলির মধ্যেই তাঁর ব্যক্তিজীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ অনুপুঙ্খের পাশাপাশি শোনা যাবে তাঁর কবিপ্রাণের বিমুগ্ধ প্রকৃতিদৃষ্টি ও আন্তরিক মানব প্রীতির যুগলবন্দি সুর।


রবীন্দ্রনাথের কবিজীবন এবং ব্যক্তিজীবন পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয়। রবীন্দ্রজীবন অন্বেষণের ক্ষেত্রে এই কথাটা সর্বাগ্রে মনে রাখা প্রয়োজন। রবীন্দ্র-রচনাবলির প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন— “অতি অল্প বয়স থেকে স্বভাবতই আমার লেখার ধারা আমার জীবনের ধারার সঙ্গে সঙ্গেই অবিচ্ছিন্ন এগিয়ে চলেছে।”


—তাই রবীন্দ্রনাথ যেমন শুধু তাঁর কবি পরিচয়ে সমাপ্ত নন, তেমনি কেবলমাত্র ব্যক্তি পরিচয়েও তিনি সম্পূর্ণ হতে পারেন না। 'চিঠিপত্র'-র প্রথম খণ্ডে মৃণালিনী দেবীকে লেখা চিঠিগুলির মধ্যে তাই স্নেহে-প্রেমে-সুখে বিরহে-বাৎসল্যে জীবন্ত ব্যক্তি-পরিচয়ের ছবি ফুটে ওঠে, তা আমাদের কাছে মূল্যবান হলেও সেখানে সমগ্র রবীন্দ্রনাথ ধরা দেন না। আবার ‘চিঠিপত্র’ একাদশ খণ্ডে অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা পত্রাবলির মধ্যে কবি ও কর্মী রবীন্দ্রনাথ যতটা ধরা দেন, তাঁর বিদেশ ভ্রমণ সংক্রান্ত তথ্যাবলি, আশ্রম-ভাবনা, বিশ্বভারতী সংক্রান্ত চিন্তা ইত্যাদি যতটা ধরা পড়ে, দৈনন্দিন জীবনের অভিঘাতে তাড়িত ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ ততটা ধরা পড়েন না। রবীন্দ্র-পত্রাবলির মধ্যে কেবলমাত্র 'ভানুসিংহের পত্রাবলী'র সঙ্গে ‘ছিন্নপত্র'-র কিছুটা বাহ্য সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। কেননা উভয়তই কৌতুকোজ্জ্বল দৃষ্টিতে পৃথিবী ও জীবনকে দেখার লীলাময় দৃষ্টির পাশাপাশি সুগম্ভীর দর্শন ও সুগভীর মানবতার প্রকাশ ঘটেছে।


তথাপি, এই উভয় পত্রাবলীর তুলনামূলক বিচারেও ‘ছিন্নপত্রাবলী' অনন্য। কেননা চিঠির মধ্যে যথার্থ আত্মপ্রতিফলন কেবলমাত্র তখনই ঘটতে পারে, যখন পত্রলেখক ও পত্রপ্রাপকের মধ্যে রুচি, শিল্পবোধ, জীবন দর্শন, রসচেতনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে একটা সামগ্রিক মানস-সাম্য উপস্থিত থাকে। ‘ভানুসিংহের পত্রাবলী’ যখন লেখা হয়েছে তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স পঞ্চাশোর্ধ, আর পত্রের প্রাপক রাণু অধিকারী নিতান্ত বালিকা। তাই এই পত্রাবলি আসলে লীলাচপল বালিকার আগ্রহাতিশয্যে রচিত এক পরিণত মানুষের লীলাকৌতুক। পত্রের উপলক্ষ্যে ‘ভানুসিংহের পত্র' মূলত রবীন্দ্রনাথের স্বগত-উচ্চারণ।


কিন্তু একমাত্র ‘ছিন্নপত্রাবলী'-তেই সমগ্র রবীন্দ্রনাথ এক অকৃত্রিম স্বতস্ফূর্ততায় পত্র প্রাপক ইন্দিরার কাছে আত্মউন্মোচন ঘটিয়েছেন। শৈশবাবধি রবীন্দ্র সান্নিধ্য ধন্য, উন্নত মানবিক বোধ ও রসবোধের অধিকারিণী, সাহিত্য-সংগীত-অভিনয়ে সুনিপুণা স্নেহের এই ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা ছিলেন যথার্থই রবীন্দ্র-মানসের অনুভব ও প্রকাশের যোগ্য দর্পণ। রবীন্দ্রনাথ তাই অনায়াসে ও অকপটে ইন্দিরা দেবীকে লেখা পত্রাবলিতে নিজ অনুভবগুলিকে অর্গলমুক্ত করতে পেরেছিলেন।


বাস্তবিকই ‘ছিন্নপত্র’র চিঠিগুলির মধ্যে রবীন্দ্রনাথের এক দীর্ঘ জীবনপর্বের বিচিত্র অভিজ্ঞতা অনুভব, লঘু চিন্তা, গভীর দর্শন, ব্যক্তিজীবনের ছায়া, কবিজীবনের দীপ্তি, সৌন্দর্যমুগ্ধতা, কৌতুকপ্রাণতা, পৃথিবী প্রেম এবং মানবপ্রীতি যে বিপুল ও বিচিত্র ধারায় অনর্গল প্রবাহিত হয়েছে, অন্য কোনো রচনায় বা চিঠিপত্রে তা দুর্লভ।


‘ছিন্নপত্রাবলী’র মধ্যে একদিকে যেমন দেখতে পাই সপরিবারে শিলাইদহের পদ্মাপারে ভ্রমণকালীন কৌতুকের দুশ্চিন্তার ছবি, সাহাজাদপুরের এক বিদ্যালয় পরিদর্শনকালের হাস্যকর অভিজ্ঞতার বর্ণনা, তেমনি আছে নির্জন শাস্ত মনোহর প্রকৃতি বা নদী তীরবর্তী সহজ মানবজীবন চিত্র। সাহাজাদপুরের নদীতীরে ‘জনপদবধূ’দের ভিড়, ‘গোপাল সাহা'র মেয়ের স্বামীগৃহ যাত্রার অনুপুখের পাশাপাশি নির্জন প্রকৃতিদর্শনে উপজাত বিমুগ্ধ প্রাণের সুগভীর অনুভূতিও অবলীলায় প্রকাশিত হয়েছে ইন্দিরাকে লিখিত পত্রে— “এই অনও ধূসর নির্জন নিঃশব্দ চরের উপরে প্রতি রাত্রে শত সহস্র নক্ষত্রের নিঃশব্দ অভ্যুদয় হচ্ছে, জগৎ সংসারে এ-যে কী একটা আশ্চর্য মহৎ ঘটনা তা এখানে থাকলে তবে বোঝা যায়।” [ছিন্নপত্র – ১০ সংখ্যক]


‘ছিন্নপত্র’র পৃষ্ঠাতেই পাওয়া যাবে জমিদার রবীন্দ্রনাথের কর্মব্যস্ত জীবনের ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস, আবার সেই সঙ্গে দরিদ্র-অশিক্ষিত প্রজাদের মঙ্গলের জন্য একান্ত মানবিক আকুতি— ‘‘আমার এই দরিদ্র চাষী প্রজাগুলোকে দেখলে আমার ভারী মায়া করে, এরা যেন বিধাতার শিশুসন্তানের মতো নিরুপায়।”


প্রকৃতি ও মানুষের অপার রহস্য চোখ ভরে দেখতে দেখতেই এখানে যে রবীন্দ্রনাথের কবিকল্পনা ও ছোটো গল্পের জগৎ সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল, তার সাক্ষ্যও ছড়িয়ে আছে ‘ছিন্নপত্র’র চিঠিগুলির মধ্যে। 'সোনার তরী’ ও ‘চিত্রা’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলির অনুভব যেমন চিঠিগুলিতে প্রকাশিত, তেমনি 'খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন', ‘সমাপ্তি', 'ছুটি', 'কঙ্কাল', প্রভৃতি ছোটো গল্পগুলির বীজভূমিও লুকিয়ে আছে ‘ছিন্নপত্রে'। এই কারণেই নিঃসংশয়ে বলা যায়, ‘ছিন্নপত্র’-তে রবীন্দ্রনাথের বিচিত্র মানস-অনুভব যেমন অকৃত্রিমভাবে প্রকাশিত হয়েছে, অন্যত্র তা হয়নি। তাই সমগ্র রবীন্দ্র-পত্রসাহিত্যের মধ্যে ‘ছিন্নপত্র’ অবিতর্কিতভাবেই অনন্য।