'ছিন্নপত্র’-র মধ্যে প্রকৃতির যে বিশেষ রূপ ও বিচিত্র রহস্যময়তা ফুটে উঠেছে তার স্বরূপ বিশ্লেষণ করো।

'ছিন্নপত্র’-কেও একদিক থেকে বলা যেতে পারে 'রূপসী-বাংলা'র কথা চিত্র– আলোচনা করো।


রবীন্দ্রনাথ শৈশবাবধি প্রকৃতি প্রেমিক। সমগ্র রবীন্দ্রজীবনে প্রকৃতিই তাঁর প্রধানতমা নায়িকা, তাঁর সমগ্র আত্মার হ্লাদিনী শক্তি স্বরূপিণী। ‘ভৃত্যরাজকতন্ত্র’র যুগ থেকেই বাতায়নপথে চলেছে বালক রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি-রস-সম্ভোগ। তারপর মহর্ষির সঙ্গে বোলপুর-ডালহৌসি-হিমালয় ভ্রমণকালে, পেনেটির বাগানবাড়িতে, কৈশোরে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে শিলাইদহ ভ্রমণের সময় মুক্ত প্রকৃতির রূপ ও সৌন্দর্য আকণ্ঠ পিপাসায় পান। করেছেন রবীন্দ্রনাথ। ‘শৈশব সঙ্গীত’ বা ‘সন্ধ্যাসঙ্গীত', কিংবা 'প্রভাতসঙ্গীত' থেকে শুরু করে জীবনের অন্তিম লগ্নের ‘শেষলেখা’ পর্যন্ত সেই পিপাসা অনিঃশেষ-অপরিতৃপ্ত। প্রকৃতির সঙ্গে চিত্তবিনিময়ের লীলাই সমগ্র কবি জীবনের একমাত্র লীলা, প্রকৃতিই কবিপ্রাণের একমাত্র উদ্দীপন-শক্তি।


কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এই প্রকৃতিমগ্নতা ও প্রকৃতিপ্রেম যতই শৈশবাবধি তাঁর ধাতু প্রকৃতির সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে থাক না কেন, একথা অস্বীকার করা যাবে না যে, এই বিশিষ্ট প্রকৃতি চেতনা কবি-চেতনায় ঋদ্ধ এবং পল্লবিত হতে পেরেছে ‘ছিন্নপত্র’ যুগের নদীবিধৌত পল্লিবাংলা পরিক্রমণকালে। আরও মনে রাখা প্রয়োজন, শৈশবের কল্পনা-কুহক লালিত বায়বীয় প্রকৃতিপ্রেম 'ছিন্নপত্র' পর্বেই বাস্তব অভিজ্ঞতার কোমল কঠিন অভিঘাতে একটি নির্দিষ্ট রূপ নিতে পেরেছে এবং যা পরিণত রূপে প্রকাশিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী সাহিত্য ধারায়।


যথার্থই ‘ছিন্নপত্র’-র যুগে বাংলার নদী মাঠ-আকাশ, সন্ধ্যা-প্রভাত, গ্রীষ্ম-শীত-বর্ষা ইত্যাদি যেন প্রকৃতির বিচিত্র রূপ ও অনিঃশেষ সৌন্দর্যকে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টির সম্মুখে ক্রমাগত উন্মোচিত করে চলেছে। বিচিত্র সেইসব প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি কবিচিত্তে যে ক্ষণিক ভাবতরঙ্গের সৃষ্টি করেছে ‘ছিন্নপত্র’-তে তার সাক্ষ্য আছে। কবির ইন্দ্রিয়ের উপর প্রকৃতির নানারূপের প্রতিবিম্বগুলি যেন নথিবদ্ধ হয়ে গেছে ‘ছিন্নপত্র'র পাতায় পাতায়। ঝিল্লিমুখরিত সন্ধ্যা, অলস-তৃপ্ত মধ্যাহ্ন, জ্যোৎস্নাগ্লাবিত রাত্রি, নির্জন নদী ও চর, কোলাহলমূখর নদীঘাট ইত্যাদি বর্ণ-শব্দ-গন্ধময় চিত্রমালা 'ছিন্নপত্র'-র অজস্র।


নদীবিধৌত বাংলার বুকে সন্ধ্যার মায়াময় বর্ণনাগুলি অনবদ্য— “সূর্য সম্পূর্ণ অস্ত যায়, আকাশের সুবর্ণ আভা মিলিয়ে যায়, অন্ধকারে চার দিক অস্পষ্ট হয়ে আসে........ পাণ্ডুবর্ণ বালির উপরে এই পাণ্ডুবর্ণ জ্যোৎস্নায় চোখে আরও কেমন বিভ্রম জমিয়ে দেয়। কাজেই সবটা জড়িয়ে ভারী একটা অবাস্তবিক মরীচিকাজগতের মতো বোধ হয়।”


মায়াময় সন্ধ্যার বর্ণনা অন্যত্র আছে— “সূর্য ক্রমেই রক্তবর্ণ হয়ে একেবারে পৃথিবীর শেষ রেখার আড়ালে অন্তর্হিত হয়ে গেল। বহু দূরে একেবারে দিগন্তের শেষ প্রান্তে একটু গাছপালার ঘের দেওয়া ছিল, সেখানটা এমন মায়াময় হয়ে উঠল..........মনে হল ঐখানে যেন সন্ধ্যার বাড়ি.........."


জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাত্রির বর্ণনাও বড়ো মায়াময় হয়ে দেখা দিয়েছে 'ছিন্নপত্র'-তে— “পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে, জলে একটিও নৌকো নেই”—জ্যোৎস্না জলের উপর ঝিক্ ঝিক্ করছে পরিষ্কার রাত্রি—নির্জন তীর—বহুদূরে ঘন বৃক্ষবেষ্টিত গ্রামটি সুষুপ্ত—কেবল ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে—আর কোনো শব্দ নেই।"


‘ছিন্নপত্র’-তে প্রকৃতির এই শান্ত নিস্তব্ধ মায়াময় রূপ যেমন আছে, তেমনি আছে তার ধ্বংসকারী প্রলয়ংকরী মূর্তিও। ‘পত্রপুটে’র ‘পৃথিবী’ কবিতায় যে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘ডান হাতে পূর্ণ করো সুধা, বাম হাতে চূর্ণ করো পাত্র’—প্রকৃতির সেই মূর্তিকে পেয়েছিলেন ‘ছিন্নপত্র’ পর্বেই।


“কতকগুলো ছিন্নভিন্ন মেঘ ভগ্নদূতের মতো সুদুর পশ্চিম থেকে ঊর্ধ্বাকাশে ছুটে এল—তারপরে বিদ্যুৎবজ্ৰ ঝড়বৃষ্টি সমস্ত এক সঙ্গে এসে পড়ে খুব একটা তুর্কিনাচন নাচতে আরম্ভ করে দিলে।”


গ্রীষ্মের খররৌদ্রতাপ এবং বর্ষার অঝোরবর্ষণ—এই দুই প্রকৃতিই চিরকাল রবীন্দ্র কবিচিত্তকে কাব্য কল্পনা এবং নবসৃষ্টির আনন্দে উদ্‌বোধিত করেছে। প্রকৃতির সেই দুই সৌন্দর্যময় রূপও ‘ছিন্নপত্র’-তে অনিবার্যভাবেই এসেছে, সেই সঙ্গে এসেছে শরৎ, শীত, বসন্তের বৈচিত্র্যময়তা। গ্রীষ্মের খরতাপে আচ্ছন্ন উদাস দ্বিপ্রহর, বর্ষার ঘনকৃষ্ণ মেঘ ও বর্ষণসিক্ত পৃথিবীর উল্লাস, শরতের স্নিগ্ধ নির্মল রৌদ্রের আগমনি বাণী, শীতের জড়তা ও কুয়াশাচ্ছন্নতা এবং বসন্তের মদির বাতাসে হৃদয়ের আকুলতা পর্যায়ক্রমে অঙ্কিত হয়েছে 'ছিন্নপত্র’-র পত্রাবলিতে।


রবীন্দ্রনাথ যদিও লিখেছেন যে, এই মহৎ মুক্ত পৃথিবীর অনন্ত বিস্তার ও নিঃসীম রহস্যলোকের মাঝখানে মানুষকে অতি নগণ্য বলে বোধ হয়— “এখানে মানুষ কম এবং পৃথিবীটাই বেশি” (৩৮ সংখ্যক পত্র), তথাপি মনে রাখতে হবে রবীন্দ্রনাথের এই প্রকৃতি মানবসংসর্গ-বিচ্ছিন্ন নয়। বরং মানুষ এবং প্রকৃতির দ্বৈতলীলাই এখানে বৃহত্তর অর্থে অভিব্যক্ত। ‘দ্বৌ অপি অত্র অরণ্যকৌ'—কালিদাসের সেই মহতী বাণীরই যেন উত্তরসাধক হিসাবে রবীন্দ্রনাথ আত্মপ্রকাশ করেছেন 'ছিন্নপত্র'-র পত্রগুচ্ছে, তাই প্রকৃতির রস সম্ভোগ করতে করতেই নদী তীরলগ্ন মানব জীবন যাত্রার চিত্রও তার সরল অনাড়ম্বর সৌন্দর্য নিয়ে কবির চোখে ধরা দিয়েছে। ‘ছিন্নপত্র’-তে তাই প্রকৃতিচিত্র যেমন ব্যাপক, সেই প্রকৃতির অংশরূপে মানব জীবন-চিত্রও তেমনি বিস্তৃত। 'জনপদবধূ'-দের নদীর ঘাটে সমাগম, ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ের জলক্রীড়া, হাটুরে মানুষের ব্যস্ততা, উদাসী পথিকের বেসুর গান, তাদের সুখ-দুঃখ, সরলতা-নিষ্ঠুরতার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা রবীন্দ্রনাথ দিয়েছেন।


রবীন্দ্রনাথের এই প্রকৃতি কখনও মানব-সত্তারূপে অভিব্যক্ত, আবার মানব জীবন কখনও প্রকৃতির প্রতিতুলনীয়। তাঁর প্রকৃতিরাজ্যের সন্ধ্যা কখনও— “আপনার রাঙা আঁচলটি শিথিলভাবে এলিয়ে দেয়....... সিঁদুর পরে বধুর মতো কার প্রতীক্ষায় বসে থাকে" (১৪ সংখ্যক পত্র)। আবার তাঁর দেখা মানুষেরা নদী প্রবাহের মতো চিরচলমানতায় আভাসিত হয়- “মানুষ ও নানা শাখা-প্রশাখা নিয়ে নদীর মতোই চলেছে” (৩৮ সংখ্যক পত্র)। 'ছিন্নপত্র’র প্রকৃতি স্বরূপত প্রকৃতি ও মানুষের অর্ধনারীশ্বর মূর্তি।


‘ছিন্নপত্র’-র প্রকৃতি শুধুমাত্র ইন্দ্রিয়ের উপরিতললগ্ন চিত্ররূপময়তাতেই সমাপ্ত নয়। প্রকৃতির মৃন্ময়ীরূপ চকিতে হৃদয়ের নিগূঢ় রহস্যালোকে অবগাহন করে প্রায়শই চিন্ময়ীরূপে অভিব্যক্ত হয়েছে। তখন আর প্রকৃতি শুধু দর্শনগ্রাহ্য দৃশ্যাবলি নয়, তা হয়ে উঠেছে জগৎ ও জীবনের মননগ্রাহ্য গভীর তত্তস্বরূপা। নিসর্গের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিচিত্র লীলা রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক জীবন প্রত্যয়কে সহসা বিদ্যুৎরেখায় উদ্ভাসিত করেছে। প্রকৃতির সৌন্দর্য তাঁর জন্মজন্মান্তরের স্মৃতি সংস্কারকে জাগ্রত করে এক অনির্বচনীয় রহস্যের দ্বার উন্মোচিত করে দিয়েছে। তখন তাঁর মনে হয়— “আমি এই পৃথিবীতে আমার সমস্ত সর্বাঙ্গ দিয়ে প্রথম সূর্যালোক পান করেছিলুম, নবশিশুর মতো একটা অন্ধ জীবনের পুলকে নীলাম্বরতলে আােলিত হয়ে উঠেছিলুম, আমার এই মাটির মাতাকে আমার সমস্ত শিকড়গুলি দিয়ে জড়িয়ে এর স্তন্যরস পান করেছিলুম।”


এই মাটি-পৃথিবীর সঙ্গে যেন কবিসত্তার এবং সমগ্র মানবসত্তার 'জননাত্তর সৌহৃদানি।' সেই সত্তার সঙ্গে বিজড়িত প্রকৃতিকে তাই তাঁর—'গাছপালা নদী মাঠ কোলাহল নিস্তব্ধতা প্রভাত সন্ধ্যা সমস্তটা-সুদ্ধ দু-হাতে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছা করে।' (১৮ সংখ্যক)


প্রকৃতির অপার বাৎসল্য আবিষ্কার করার সূত্রেই রবীন্দ্রনাথ পৃথিবীকে ‘স্বর্গাদপী গরিয়সী' বলে মনে করেন। মাতারূপা এই পৃথিবীর অন্তরস্থিত বেদনাও যেন অনায়াসে উপলব্ধ হয় রবীন্দ্র চেতনায়— “এর মুখে ভারী একটা সুদূরব্যাপী বিষাদ লেগে আছে— যেন এর মনে আছে, আমি দেবতার মেয়ে, কিন্তু দেবতার ক্ষমতা আমার নেই। আমি ভালোবাসি, কিন্তু রক্ষা করতে পারি নে। আরম্ভ করি, সম্পূর্ণ করতে পারি নে। জন্ম দিই, মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারি নে।”


অর্থাৎ ‘ছিন্নপত্র’-র প্রকৃতি একদিকে বাহারূপসৌন্দর্য ও বৈচিত্র্যলীলায় যেমন উদ্ভাসিত, অন্যদিকে তেমনি চিন্ময়ী সত্তারূপে জীবন রহস্যের নিগূঢ় লীলায় অভিব্যঞ্জিত। ‘ছিন্নপত্র’-র প্রকৃতি-ভাবনায় একদিকে ছবি, অন্যদিকে গান; একদিকে সে প্রকৃতি রূপসীমায় অভিব্যক্ত, অন্যদিকে অরূপ মহিমায় তার উদ্ভাসন। আসলে রবীন্দ্র-মানসে সদাসর্বদা রূপ-অরূপের যে দ্বৈতলীলা, ‘ছিন্নপত্র’-র প্রকৃতি ভাবনাতেও সেই দ্বৈতলীলার অনির্বচনীয় প্রতিফলন।