আমি বুঝাইয়া বলিলাম যে, “সামাজিক ধনবৃদ্ধি ব্যতীত সমাজের উন্নতি নাই।” ‘বিড়াল' রাগ করিয়া বলিল যে, 'আমি যদি খাইতে না পাইলাম, তবে সমাজের উন্নতি লইয়া কি করিব'?”—'বিড়াল' প্রবন্ধের অনুসরণে এই দুই উক্তির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে এবং তাদের মধ্যে কোন্‌টি লেখকের সমর্থন লাভ করেছে, যুক্তিসহ বিশ্লেষণ করে দেখাও।

“সমাজের উন্নতিতে দরিদ্রের প্রয়োজন না থাকিলে না থাকিতে পারে, কিন্তু, ধনীদিগের বিশেষ প্রয়োজন।”- 'বিড়াল' রচনায় এই মন্তব্যের আলোকে লেখকের সমাজ-মনস্কতার পরিচয় দাও।


'কমলাকান্তের দপ্তর'-এর অন্তর্গত 'বিড়াল' নিবন্ধটি বঙ্কিম-প্রতিভার একটি বিশিষ্ট নিদর্শন। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের দপ্তরে' সমাজতন্ত্রবাদ উপস্থাপিত হয়েছে বিড়াল ও কমলাকান্তের বাদ-প্রতিবাদে এবং বিড়ালের ভাষণে। এই বিতর্ক অবশ্যই নেশাখোর কমলাকান্তের আফিমের প্রসাদলব্ধ এবং সেই কারণেই অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক ও উপভোগ্য হয়েছে। বিড়াল তার ক্ষুধা দূর করার জন্য কমলাকান্তের দুধ খেয়ে ফেলেছে সেই জন্য সেই চুরি বা অপরাধের উপযুক্ত শাস্তিদানের উদ্দেশ্যে সে তাকে লাঠি নিয়ে মারতে গেছে। কমলাকান্ত তখন আফিমের নেশার প্রসাদে দিব্যকর্ণ প্রাপ্ত হয়ে বিড়ালের বক্তব্য শুনতে পেয়েছে।


বিড়াল শোষিত, সর্বহারা, দরিদ্র সমাজের প্রবক্তারূপে এই বক্তব্য উপস্থাপিত করেছে : এই সংসারের ক্ষীর, সর, দুগ্ধ, দধি, মৎস্য, মাংস ইত্যাদি সবই কমলাকান্তরা, অর্থাৎ ধনীরা খাবে, তারা, বিড়ালেরা, অর্থাৎ দরিদ্ররা কিছু পাবে না কেন, কোন্ যুক্তিতে তারা এই সমস্ত খাদ্যবস্তু থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকবে। ধনী ও এই শ্রেণিগত পার্থক্যের জন্যই। কিন্তু ধনীদের মতো দরিদ্ররাও তো মানুষ, প্রকৃত প্রভেদ সত্যই দরিদ্র—শুধু কিছু আছে কি? ধনীদের যেমন ক্ষুধাতৃষ্ণা আছে, তেমনি দরিদ্রদেরও আছে। কোনো দরিদ্রই সাধ করে চোর হয় না, খেতে পেলে কে চোর হয়। সমাজের উঁচুতলার যে সব মানুষ বড়ো বড়ো সাধু সেজে বসে আছেন এবং চোরের নামে শিউরে ওঠেন, তাঁদের অনেকেই চোর অপেক্ষাও অধার্মিক, চুরি করার প্রয়োজন নেই বলেই তাঁরা চুরি করেন না। কিন্তু প্রয়োজনাতীত ধন থাকা সত্ত্বেও তাঁরা যে চোরের দিকে মুখ তুলে চেয়ে দেখেন না, তার জন্যই চোর চুরি করে। অধর্ম চোরের নয়, চোর যে চুরি করে, সে অধর্ম কৃপণ ধনীর। চোর দোষী, কিন্তু কৃপণ ধনী তার থেকে শতগুণে দোষী। চোরের দণ্ড হয়, কিন্তু চুরির মূল যে কৃপণ ধনী তার দণ্ড হয় না কেন। দরিদ্রের আহার সংগ্রহের দণ্ড আছে, ধনীর কৃপণতার দণ্ড নেই কি কারণে? ধনীর দোষেই কি দরিদ্র চোরে পরিণত হয় না? পাঁচশ' জন দরিদ্রকে বঞ্চিত করে একজন তাদের আহার্য সংগ্রহ করবে কেন, যদি করল তবে সে তার আহারের পর যেটুকু অবশিষ্ট থাকে, তা দরিদ্রকে কেন দেবে না? যদি না দেয় তবে দরিদ্র অবশ্য তার থেকে চুরি করবে, কারণ না খেতে পেয়ে মরবার জন্য কেউ এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেনি।


বিড়ালের এই বক্তব্য খণ্ডন করার জন্যে ধনতন্ত্রের প্রতিনিধিরূপে তার সমর্থনে কমলাকান্ত সেই সনাতন যুক্তি উপস্থাপিত করেছে এই কথাগুলো অত্যন্ত সোশিয়ালিস্টিক, সমাজ বিশৃঙ্খলার মূল। যদি যার যত ক্ষমতা সে তত ধন সঞ্চয় করতে না পারে, অথবা সঞ্চয়ের পর চোরের জ্বালায় ভোগ না করতে পারে, তবে কেউ আর ধন সঞ্চয়ে যত্নবান হবেন না, তাতে সমাজের ধন বৃদ্ধি হবে না। আর সামাজিক ধন বৃদ্ধি ছাড়া সমাজের উন্নতি সম্ভব নয়। কমলাকান্তের এই উক্তি অষ্টাদশ শতাব্দীর অ্যাডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো প্রমুখ অর্থনীতিবিদদের ধনতন্ত্রের মতবাদেরই প্রতিধ্বনি। তাঁরা বলেছিলেন, ব্যক্তিগত উদ্যোগে একজন ব্যক্তি অর্থ তথা মূলধন সঞ্চয় ও সংগ্রহ করে কলকারখানায় তথ্য উৎপাদনে বিনিয়োগ করে, উৎপাদিত পণ্যদ্রব্য রপ্তানিতে শুধু মূলধন বিনিয়োগকারীরই নয়, তার দেশেরও লাভ হয়।


সুতরাং বিনিয়োগকারী ধনী এন্টারপ্রেন্যার বা উদ্যোক্তাকে মূলধন সঞ্চয়ের অবাধ সুযোগ দিতে হবে। দেশের সরকারকে তার মূলধন সঞ্চয় ব্যাহত হয় এমন পরিমাণে তার ওপর কর ধার্য করলে চলবে না, শ্রমিকেরাও যতদূর সম্ভব কম মজুরি দিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধিতে তাকে সাহায্য করবে, নিজের ভোগের পরিমাণ বাড়িয়ে মজুরি বৃদ্ধির দাবি করবে না। উৎপাদন ও তাঁর থেকে লাভ যত বেশি হবে, শিল্পে বিনিয়োগকারী ততই মূলধন সঞ্চয়ের সুযোগ পাবে এবং নতুন নতুন শিল্প প্রচেষ্টায় পণ্য উৎপাদিত হবে। এই প্রক্রিয়াই সামাজিক ধন বৃদ্ধির উৎস। অন্যদিকে ধনীদের ধনের চাহিদা পূরণের জন্যই উৎপাদন বৃদ্ধি এবং সেই সূত্রে সমাজের ঐশ্বর্য বৃদ্ধি ঘটে। সুতরাং সামাজিক উন্নতির জন্য ধনীকে তার ক্ষমতা অনুযায়ী ধন সঞ্চয় ও ভোগ করার জন্য রাষ্ট্র শক্তিকে তার নিরাপত্তার কঠোর ব্যবস্থা করতে হবে। যদি যার যত ক্ষমতা, সে তত ধন সঞ্চয় করতে অথবা সঞ্চয় করে চোরের জ্বালায় নির্বিঘ্নে ভোগ করতে না পারে, তবে কেউ আর ধন সঞ্চয়ে যত্নবান হবে। না; তাতে সমাজের ধন বৃদ্ধি হবে না।


ধনতন্ত্রের সমর্থনে কমলাকান্তের এই যুক্তি বা বক্তব্যের প্রতিবাদে বিড়াল বলেছে, সে যদি খেতেই না পেল, তবে সমাজের উন্নতি নিয়ে সে কি করবে। এই পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষের খেয়ে পরে বেঁচে থাকার অধিকার আছে, এই অধিকার জন্মগত। কিন্তু মুষ্টিমেয় ধনিক শ্রেণি তাদের শোষণ করে তাদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে মুনাফার পাহাড় গড়ে তোলে। ধনীদের সুরম্য প্রাসাদ, ভোগবিলাসের চাহিদা পূরণের জন্য বিভিন্ন সুসজ্জিত বিপণীগুলিতে পণ্যসম্ভারের বিপুল আয়োজন, তাদের জীবন ঘিরে চোখ ধাঁধানো ঐশ্বর্যের দ্যুতি প্রভৃতিকে সমাজের উন্নতির লক্ষণরূপে ধনতন্ত্রের প্রবক্তারা সাড়ম্বরে প্রচার করে থাকেন। তাঁরা ভেবে দেখেন না, ধনীদের এই সমৃদ্ধি ও সমাজের উন্নতি অসংখ্য দরিদ্র নিরন্ন মানুষের কাছে অর্থহীন, মর্মান্তিক পরিহাস। ক্ষুধার জ্বালা কি ভয়ংকর, অসহনীয়, ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ বোঝে না। কবিকে অনুসরণ করে আমরা বলতে পারি, ক্ষুধাতুরের দৃষ্টিতে পূর্ণিমার চাঁদও পোড়া ঝলসানো রুটি হয়ে ওঠে। সমাজতন্ত্রের প্রবক্তারূপে বিড়াল যথার্থই বলেছে, সমাজের ধন বৃদ্ধির অর্থ ধনীর ধন বৃদ্ধি, ধনীর ধন বৃদ্ধি না হলে দরিদ্রের কী ক্ষতি; সে যদি খেতেই না পেল, যা বেঁচে থাকার ন্যূনতম শর্ত ও অধিকার, তবে সমাজের উন্নতি নিয়ে সে কী করবে। ক্ষুধার জ্বালায় যে মানুষ ছটফট করছে, দুচোখে অন্ধকার দেখছে, যার কর্ণদ্বয় রুদ্ধ হয়ে আসছে, তার কাছে এই সামাজিক উন্নতির তো কোনো অর্থই নেই।


বিড়ালের এই বক্তব্যের প্রতি লেখকের সহানুভূতি, তাঁর হৃদয়ের সমর্থন আমাদের কাছে অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। “দেখ, আমি প্রাচীরে প্রাচীরে মেও মেও করিয়া বেড়াই, কেহ আমাকে মাছের কাঁটাখানাও ফেলিয়া দেয় না। মাছের কাঁটা, পাতের ভাত, নর্দমায় ফেলিয়া দেয়, জলে ফেলিয়া দেয়, তথাপি আমাকে ডাকিয়া দেয় না।”—এই উক্তিগুলিতে দরিদ্রের ক্ষুধার জ্বালা যন্ত্রণা যে আবেগ তীব্রতায় বাস্তব ও জীবন্ত হয়ে ওঠে, লেখকের হৃদয়ের ঐকান্তিক সহানুভূতি ও সমর্থন ছাড়া তা সম্ভব হত না। সেই সহানুভূতির জন্যই দরিদ্রের ক্ষুধার এই জ্বলন্ত বাস্তবতার বিপরীতে ধনতন্ত্রের সমর্থনে কমলাকান্তের ওই বক্তব্য বা যুক্তিকে অত্যন্ত অন্তঃসারশূন্য বলে মনে হয়। ধনী কেন পাঁচশ জনকে বঞ্চিত করে তাদের আহার্য সংগ্রহ করবে, যদি করল তবে তার আহারের পর যা অবশিষ্ট থাকে সেটুকু সে দরিদ্রকে কেন দেবে না, যদি না দেয় তবে দরিদ্র অবশ্যই তার কাছ থেকে চুরি করবে, কেননা অনাহারে মরে যাবার জন্য এই পৃথিবীতে কেউ আসেনি—এই উক্তির ভঙ্গিটি থেকেই আমরা বুঝতে পারি, বঙ্কিমচন্দ্র সমাজের দরিদ্র সর্বহারা মানুষদের ক্ষুধার জ্বালা যে কি নিদারুণ। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর সমস্ত হৃদয়মন নিয়ে সমাজতন্ত্রের এই মূল সত্যকে উপলব্ধি করেছিলেন। সেইজন্যই বিড়ালের এই উক্তি বুদ্ধিগত বিতর্কের গণ্ডি অতিক্রম করে সামাজিক বৈষম্য তথা ধনিক শ্রেণির দরিদ্রের শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে দৃপ্ত প্রতিবাদ হয়ে ওঠে।


সে যদি খেতেই না পেল তবে সমাজের উন্নতি নিয়ে কি করবে—বিড়ালের এই উক্তির কোনো সদুত্তর কমলাকান্ত দিতে পারেনি। অবশেষে সে বলেছে : “সমাজের উন্নতিতে দরিদ্রের প্রয়োজন না থাকিলে না থাকিতে পারে, কিন্তু ধনীদিগের বিশেষ প্রয়োজন, অতএব চোরের দণ্ডবিধান কর্তব্য। কমলাকান্ত এখানে ধনতন্ত্রের স্বরূপ উদ্ঘাটিত করেছে, অর্থাৎ লেখকের নির্দেশে করতে বাধ্য হয়েছে। ধনীদের শ্রেণিস্বার্থের জন্যই সমাজের এই উন্নতি তথা তাদের ঐশ্বর্য-সংগ্রহের অধিকারকে রক্ষা করতে এবং চোরের দণ্ড দিতে হবে। কমলাকান্তের এই উক্তির মধ্য দিয়ে আমরা বঙ্কিমচন্দ্রের ধনতন্ত্রের সমালোচনাই লক্ষ্য করি, সেই সমালোচনার সূত্রেও তিনি বিড়ালের উক্তি তথা সমাজতন্ত্রকে সমর্থন করেছেন।