“পুষ্প আপনার জন্য ফুটে না। পরের জন্য তোমার হৃদয় কুসুমকে প্রস্ফুটিত করিও।” এই উক্তির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে দেখাও।

পাঠক-পাঠিকাদের নিছক অবসর বিনোদনের উপকরণ সরবরাহকে বঙ্কিমচন্দ্র সাহিত্য সৃষ্টির লক্ষ্য ও মানদগুরূপে গ্রহণ করেননি। মানব জীবনের প্রকৃত সার্থকতা সম্বন্ধে পাঠকদের উৎকণ্ঠিত ও সচেতন করে তোলার জন্যই তিনি লেখনী ধারণ করেছিলেন। প্রবন্ধ, রঙ্গব্যঙ্গাত্মক রচনা, উপন্যাস এবং কমলাকান্তের দপ্তরের মতো অভিনব আঙ্গিকে লিখিত আত্মভাবনিষ্ঠ রচনা–বঙ্কিমচন্দ্রের সমস্ত রচনায়ই সে সম্পর্কে তাঁর চিন্তা-ভাবনা বিভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়েছে। সেই চিন্তা প্রত্যয়কে যদি সূত্রবদ্ধ করতে হয়, তবে বলতে হয়, মানব-প্রীতি ও অপরের কল্যাণের জন্য আত্মবিসর্জনই মানবজীবনের একমাত্র সার্থকতা-গানের ধুয়ো বা ধ্রুপদের মতো এই উপলব্ধি বঙ্কিমের বিভিন্ন রচনায় প্রকাশিত হয়েছে, কখনও আবেগে, কখনও বা মননশীলতায় বা তাদের সম্মিলিত ধারায়, যেমন কমলাকান্তের দপ্তরে, কখনও বা জীবনের রূপসৃষ্টিতে, উপন্যাসগুলি যার উদাহরণ। কমলাকান্তের দপ্তরের ‘একা' শীর্ষক রচনাটিতে কমলাকান্তের প্রৌঢ় বয়সের আশাভঙ্গ ও নিঃসঙ্গতার বেদনার পটভূমিতে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর সেই জীবনভাবনাকেই এক বিচিত্র ও মনোজ্ঞ রূপদান করেছেন।


জ্যোৎস্না-রাত্রির সৌন্দর্যদর্শনে পুলকিত হৃদয় একজন পথচারীর আপনমনে গান গাওয়ার মধ্য দিয়ে অভিব্যক্তি তার আনন্দ কমলাকান্তের হৃদয়কে আলোড়িত করে তোলে। রাত্রি জ্যোৎস্নাময়ী—নদী তীরে চাঁদের কিরণ-হাসি, অর্ধাবৃতা সুন্দরীর নীল বসনের মতো শীর্ণ শরীর। নীল সলিলা তরঙ্গিনী তাকে বেষ্টন করে প্রবাহিত, রাজপথে শুধু আনন্দ, বালক, বালিকা, যুবক-যুবতী, প্রৌঢ়া, বৃদ্ধা, নির্মল চাঁদের কিরণস্নাত হয়ে আনন্দ-রত। সেই সৌন্দর্য ও আনন্দের তরঙ্গলীলার মধ্যে কমলাকান্তই শুধু একা নিরানন্দ, সেইজন্যই ঐ সংগীতে তার হৃদয়যন্ত্র বেজে ওঠে। নিঃসঙ্গতার সেই বেদনায় সে উপলব্ধি করে, যদি অন্য কেউ মানুষের প্রণয়ভাগী না হয় তবে তার মানব জন্ম নিষ্ফল। পুষ্প সুগন্ধি, কিন্তু যদি তার ঘ্রাণগ্রহণকর্তা কেউ না থাকত তবে সে সুগন্ধী হত না। ঈশ্বর পুষ্পকে সৌরভ, বর্ণ, বৃত্ত ও দলের অতুলনীয় ঐশ্বর্য দান করেছেন। সকালে প্রস্ফুটিত হয়ে সে সন্ধ্যবেলায়ই ঝরে পড়ে, কিন্তু নিজের সেই ক্ষণস্থায়ী জীবনেই পুষ্প তার সেই দান নিয়ে গন্ধ ও বর্ণে আশপাশের মানুষদের মুগ্ধ ও আনন্দিত করে নিজেকে সার্থক করে তোলে। অপরের জন্য প্রস্ফুটিত হয়ে নিজের বর্ণগন্ধের ঐশ্বর্য বিলিয়ে দিয়ে সে তার জীবনের মহত্তম সার্থকতাকে সন্দেহাতীতভাবে প্রকাশ করে।


মানুষের জীবন সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। যৌবনে জগৎ ও জীবনের সবকিছু মানুষের কাছে আনন্দময় বোধ হয় তার কারণ, সেই সময় তার মন আশায় পরিপূর্ণ থাকে। প্রৌঢ়ত্বে উপনীত হবার পর মানুষ ক্রমাগত তিক্ত অভিজ্ঞতার আঘাতে নৈরাশ্যে ও মোহভঙ্গে ভারাক্রান্ত হয়ে জীবনকে মরুভূমির মতোই শুষ্ক ও শূন্যরূপে দেখাতে থাকে। তখন তার মনে হয়, এই জীবন যেন পথহীন অরণ্য, জলাশয়হীন প্রান্তর, কূলহীন নদী, দ্বীপহীন সমুদ্র কিংবা নক্ষত্রহীন নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। মানুষ তখন জানতে পারে, আশাপূরণের আনন্দ নয়, নৈরাশ্যের নিষ্ঠুর আঘাতই বাস্তব সত্য, তাকে একথা জানতে হয় যে কুসুমে কীট আছে, কোমল পল্লবে কণ্টক আছে, আকাশে মেঘ আছে, নির্মল নদীতে আবর্ত আছে, ফলে বিষ আছে, উদ্যানে সর্প আছে, মানুষের হৃদয়ে আছে শুধু আত্মাদর। তবে কি তখন তার কোনো আশ্রয় বা অবলম্বনই থাকে না? তাপদগ্ধ মরুভূমির শুষ্কতা ও শূন্যতাকেই জীবনের একমাত্র সত্যরূপে তাকে মেনে নিতে হয়?


পুষ্পের বর্ণগন্ধের মতোই প্রতিটি মানুষ ঈশ্বরের দানরূপে বুদ্ধি, বিভিন্ন ধরনের কর্মশক্তি, স্নেহ-মমতা করুণা প্রভৃতি হৃদয়তৃপ্তি নিয়ে এই পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়, অবশ্য ঈশ্বরের এই সমস্ত দান সকলে সমানভাবে পায় না, তাদের তারতম্য থাকে। কিন্তু সেটা বড়ো কথা নয়, সে ঈশ্বরের কাছ থেকে যতটুকু দাম পেয়েই আসুক, অপরের কল্যাণে তাকে নিয়োজিত করতে পারলেই তার জীবন সার্থক হয়। বিভিন্ন যুগের মহামানবদের জীবন ও সাধনা থেকে আমরা সেই শিক্ষাই লাভ করতে পারি। বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে এমন অনেক দিগ্বিজয়ী সম্রাট আবির্ভূত হয়েছেন যাঁরা নির্বিচারে হত্যা লুন্ঠন শোষণ-পীড়নের মাধ্যমে দেশজয়ের ও যথেচ্ছ ভোগবিলাসের অহংকারে মত্ত হয়েছেন, কিন্তু ইতিহাস ও মানব সমাজের স্মৃতি তাঁদের কোনো শ্রদ্ধার আসন দান করেনি। তাঁরা তাঁদের সমকালেই অজস্র মানুষের ঘৃণার অভিশাপ কুড়িয়েছেন, মৃত্যুর পরেও তাঁদের নাম থেকে কলঙ্কের দাগ মুছে যায়নি। কিন্তু শুধু ইতিহাসই নয়, যুগযুগান্তরে অসংখ্য মানুষ তাঁদের স্মৃতিতে, ধ্যানে ও কর্মে পরম শ্রদ্ধায় ও প্রেমে ধরে রেখেছে যীশুখ্রিস্ট, বুদ্ধদেব, রাজর্ষি অশোক, নানক, কবীর, চৈতন্যের নাম। এই মহামানবেরা পরহিতব্রতে নিজেদের সমগ্র জীবন উৎসর্গ করে মানব জীবনের পরম সার্থকতা যে কোথায় বিহিত সেই আদর্শ ও দৃষ্টান্তকে রেখে গেছেন, তা ধ্রুবতারকার অনির্বাণ জ্যোতির মতোই মানুষকে পথ দেখাবে আবহমানকাল।


দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, কবি, গায়ক, শিল্পী প্রভৃতি গুণী ব্যক্তিরা বিভিন্ন যুগে তাঁদের ঈশ্বরদত্ত গুণের সাহায্যে জীবনের সত্যে ও সৌন্দর্যসুষমার বিভিন্ন রূপরচনায় মানব-হৃদয়কে আলোকিত এবং আনন্দের ঝর্ণাধারায় স্নাত ও শুচি নির্মল করেছেন এবং করে চলেছেন। ব্যক্তিগত সুখভোগ নয়, পরের জন্য, সমাজের বা সমগ্র মানব জাতির জন্য নিজের যা-কিছু শ্রেষ্ঠ মানবিক সম্পদ তার উৎসর্গের এইসব দৃষ্টান্তই আমাদের সামনে জীবনের এই সত্যকে তুলে ধরে, পুষ্প নিজের জন্য ফোটে না, পরের জন্য পুষ্পের মতো নিজের হৃদয়-কুসুমকে প্রস্ফুটিত করতে পারলেই মানব জীবন সার্থক হয়। আমরা যে যতটুকু শক্তি, গুণ বা যোগ্যতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছি, ব্যক্তিগত স্বার্থ ও সুখের গণ্ডিতে আবদ্ধ না থেকে সেটুকু নিয়েই যদি আশপাশের সকলের কল্যাণের জন্য নিজেদের উৎসর্গ করতে পারি, তবেই আমাদের জীবন দুঃখ, আঘাত, নৈরাশ্যের সমস্ত কণ্টককে ধন্য করে ফুলের মতোই সৌন্দর্যে সৌরভে বিকশিত হবে, সকলকে আনন্দ দান করে পরম সার্থকতা ও গৌরব অর্জন করতে পারবে।