'এই প্রবন্ধগুলিতে জীবনের তীক্ষ্ণ, মৌলিক বিশ্লেষণ, সমালোচনার বিশিষ্ট ভঙ্গী কল্পনাসমৃদ্ধি যোগে অপরূপ ও বিশুদ্ধ হাস্য-কিরণসম্পাতে ডাম্বর হইয়া উঠিয়াছে।”—‘কমলাকান্তের দপ্তর'-এর পাঠ্য প্রবন্ধগুলির প্রবন্ধ অবলম্বনে এই উক্তিটির যৌক্তিকতা বিচার করো।

বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর প্রবন্ধগুলি বিষয়বস্তু প্রধান, তথ্যনিষ্ঠ ও যুক্তিশৃঙ্খলনির্ভর সাধারণ প্রবন্ধ নয়। এই প্রবন্ধগুলি রচনা সাহিত্যের উদাহরণ। যে সমস্ত গদ্য নিবন্ধ সৃষ্টিধর্মী, লেখকের ব্যক্তিগত ভাবনাচিন্তা ও আবেগই যেখানে মুখ্য, নিছক বিষয়বস্তু নয়, মননশীলতা, আবেগ, কল্পনা কৌতুক পরিহাস ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধিদীপ্ত বিদ্রূপ ইত্যাদির সমবায়ে বা রূপরসোজ্জ্বল রচনারূপে শুধু আমাদের চিন্তাকে উদ্দীপিত করে না, হৃদয়-মনকেও আলোড়িত করে তোলে, তাদেরই রচনা সাহিত্যরূপে চিহ্নিত করা হয়। ড: শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ‘কমলাকান্তের দপ্তর'-এর প্রবন্ধগুলির রচনাভঙ্গির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন “এইগুলিতে শুধু রচয়িতার ব্যক্তিমানস নহে, তাঁহার আবেগ- অনুভূতি- কল্পনাস্বপ্ন- জীবনবোধ প্রভৃতি বৃত্তির সূক্ষ্ম তত্ত্বজালে রচিত, নিগূঢ় ব্যক্তিসত্তা এক অবর্ণনীয় আবেদন লইয়া পাঠকের হৃদয়দ্বারে উপস্থিত হইয়াছে। ইহাদের মধ্যে কোন নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু নাই, কোন ‘প্রকৃষ্ট বন্ধনে’ গ্রথিত চিরন্তন পারম্পর্য, প্রারম্ভ হইতে সমাপ্তি পর্যন্ত প্রসারিত কোন অচ্ছেদ্য যুক্তি-শৃঙ্খলা নাই। প্রবন্ধের সমস্ত আঙ্গিক বিন্যাস এখানে ছিন্ন হইয়া ইহা এক মুক্ত মানবাত্মার এক সর্ববন্ধনাতীত মানস অনুভূতির লীলাবিহার ক্ষেত্রে পরিণত হইয়াছে।”


কমলাকান্তের দপ্তর-এর ‘পতঙ্গ’, ‘আমার মন’, ‘বড়বাজার', 'বিড়াল' প্রভৃতি প্রবন্ধগুলির পর্যালোচনা আমরা লক্ষ্য করি। বিচিত্র কল্পনার বর্ণবিস্তারে ও হাস্যরসের কিরণ সম্পাতে বঙ্কিমচন্দ্র জীবনের তীক্ষ্ণ মৌলিক বিশ্লেষণ ও সমালোচনাকে এক অসাধারণ রূপদান করেছেন। এই রচনাগুলির বিশ্লেষণে জীবন সমালোচনার সেই রূপবৈশিষ্ট্য নির্দেশ করার আগে হাস্যরসের প্রকৃতি সম্বন্ধে সাধারণভাবে কিছু আলোচনার প্রয়োজন। ইংরেজিতে যাকে humour বলা হয় বাঙলায় তাকেই আমরা ‘হাস্যরসরূপে' অভিহিত করে থাকি। মানব জীবনের নানা অসঙ্গতি, বৈষম্য প্রভৃতিকে লেখক যখন কৌতুকাবহরূপে প্রদর্শন করেন, সেই কৌতুকরসে সমালোচনার তির্যক দৃষ্টি থাকলেও তা কখনই আক্রমণের রূপ নেয় না, শরৎকালের মেঘমুক্ত শুভ্রোজ্জ্বল আকাশের মতোই কৌতুকহাস্যের উজ্জ্বল কিরণে আমাদের সমস্ত হৃদয় আলোকিত হয়ে ওঠে, জীবনের সত্যের রূপ আমরা নতুনভাবে দেখতে পাই, তখনই আমরা বিশুদ্ধ হাস্যরসের উদাহরণ পাই, সেই অভিজ্ঞতা অনন্যসাধারণ বলে মনে হয়। ড: শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় হাস্যরসের প্রকৃতি সম্বন্ধে বলেছেন : “দীর্ঘ অভ্যাসের ফলে জীবনের যে সমস্ত বৈষম্য ও অসঙ্গতির সম্বন্ধে মন অসাড়, অচেতন হইয়া পড়িয়াছে, আমাদের চিরাচরিত জীবনযাত্রার মধ্যে যে সমস্ত বিচার বিভ্রম ও ভ্রান্ত মতবাদ অখগুনীয় সত্যের মত দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, humorist-এর হাসির খোঁটা এক ঝলক অতর্কিত আলোকের মত সেই সমস্ত ভ্রান্তি ও অসঙ্গতিকে এক মুহূর্তে সুস্পষ্ট, উজ্জ্বল করিয়া তোলে, আমাদের জীবনের বিচারধারাকে, শোভন-অশোভন-নির্ধারণের মানদণ্ডকে আমূল পরিবর্তিত করিয়া দেয়। তাহার হাসির মধ্যে এই স্বচ্ছ, ভ্রান্তি নিরসনকারী আলোক-প্রাচুর্য আছে বলিয়াই ইহা আমাদিগকে এত গভীরভাবে স্পর্শ করে।”


‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর এই রচনাগুলিতে কল্পনার বিচিত্র স্ফূরণে ও হাস্যরস অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধে আবদ্ধ। নেশাখোর অর্ধোম্মাদ কমলাকান্তের আফিমের নেশাঘটিত কল্পনার এক একটি বিচিত্র তরঙ্গভঙ্গে মানব জীবন সম্পর্কে গভীর চিন্তা, ধ্যান ও বিশ্লেষণ উপস্থাপিত হয়েছে বলেই এই চরিত্রটির মাধ্যমে বঙ্কিমচন্দ্র যে জীবন সমালোচনা আমাদের হৃদয় মনকে এত গভীরভাবে আলোড়িত করে, তাকে কখনই শুষ্ক তত্ত্বচিন্তা বা তথ্যযুক্তিতর্কের জাল বিস্তার বলে মনে হয় না। প্রথমে ‘পতঙ্গ' প্রবন্ধটির কথাই ধরা যাক। সূচনায় কমলাকান্ত বলেছে, নসীরামবাবুর বৈঠকখানায় সেজের বাতি জ্বলছে, সে মোসায়েবি ধরনে বসে আছে, বাবু দলাদলির গল্প করছেন, সে আফিম চড়িয়ে ঝিমোচ্ছে, দলাদলির প্রসঙ্গে চটে গিয়ে মাত্রা বেশি করে ফেলেছে। আফিমের এই মাত্রা বৃদ্ধির কৈফিয়ৎ হিসেবে কমলাকান্ত যে নৈয়ায়িক যুক্তি উপস্থাপিত করে প্রসঙ্গের সঙ্গে তার অসংগতি নিঃসন্দেহে হাস্যকর হয়ে উঠেছে : “বিধিলিপি। এই অখিল ব্রহ্মাণ্ডের অনাদি ক্রিয়াপরম্পরার একটি ফল এই যে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে কমলাকান্ত চক্রবর্তী জন্মগ্রহণ করিয়া অদ্য রাত্রে নসীরামবাবুর বৈঠকখানায় বসিয়া মাত্রা বেশী করিয়া ফেলিবেন। সুতরাং আমার সাধ্য কি যে, তাহার অন্যথা করি।”


কমলাকান্তের নিজের আফিমের মাত্রা বৃদ্ধি সম্পর্কে এই অতিকথনের মধ্য দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র অত্যন্ত নিপুণ, সরস ও চিত্তাকর্ষক ভঙ্গিতে এই প্রবন্ধটির মূল বক্তব্যের উপস্থাপনার পটভূমি তৈরি করেছেন। কমলাকান্ত দেখতে পায়, একটি পতঙ্গ বোঁ-ও বোঁ-ও শব্দ করে সেজের চারপাশে ঘুরছে, আফিমের প্রসাদেই দিব্যকর্ণ প্রাপ্ত হয়ে আলোর উদ্দেশ্যে তার এই ভাষণ শুনতে পায় অতীতে আলো পেতলের পিলসুজের ওপর মাটির প্রদীপে শোভা পেত, তারা স্বচ্ছন্দে পুড়ে মরতে পারত। তারা পতঙ্গজাতি পূর্বাপর পুড়ে মরছে, আলোয় পুড়ে মরায় তাদের জন্মগত অধিকার। এখন সেজের আড়ালে আলো আশ্রয় গ্রহণ করায় তারা কাচের আবরণে বাধা পায়, সেই আত্মাহুতির তীব্র তৃষ্ণাকে তৃপ্ত করতে পারে না। এই আলো কি তা সে জানে না, শুধু জানে, সে তার বাসনার বস্তু, জাগ্রতের ধ্যান, নিদ্রার স্বপ্ন, জীবনের আশা, মরণের আশ্রয়। পতঙ্গ চলে যাবার পর আবার আমরা কমলাকান্তের এই বিচিত্র কৌতুকাবহ কল্পনা পাই “নসীরামবাবু ডাকিল, ‘কমলাকান্ত'! আমার চমক হইল—চাহিয়া দেখিলাম—বুঝি বড় ঢুলিয়া পড়িয়াছিলাম। কিন্তু চাহিদা দেখিয়া নসীরামকে চিনিতে পারিলাম। না—দেখিলাম, মনে হইল, একটা বৃহৎ পতঙ্গ বালিশ ঠেসান দিয়া তামাক টানিতেছে।” তার মনে হল, এই পতঙ্গটিও যেন বোঁও-বোঁও করে কি বলছে। সেই সূত্রেই বহ্নিশিখার রূপমুগ্ধ পতঙ্গের রূপকল্পনায় মানব জীবন সম্পর্কে এই দার্শনিক চিন্তা আমাদের সামনে উদ্ঘাটিত হয় মানুষ মাত্রেই পতঙ্গ, জ্ঞান, ধন, মান, রূপ, ধর্ম প্রভৃতি বহ্নিতে আমরা পুড়ে মরতে চাই, এই সংসার বহ্নিময়, আবার কাচময়, তার আবরণে প্রতিহত হয়ে ফিরে আসি। সেই আবরণ না থাকলে সংসার এতদিন পুড়ে যেত। যদি সমস্ত ধর্মবিদ চৈতন্যদেবের মতো ধর্মকে প্রত্যক্ষ দেখতে পেত, তবে কজন বাঁচত। দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মপুস্তক এইসব বহ্নির কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। ঈশ্বর, ধর্ম, জ্ঞান, স্নেহ, ধর্ম কী আমরা জানি না, তবু সেই সমস্ত অলৌকিক ও অপরিজ্ঞাত বস্তুকে ঘিরে ঘুরে বেড়াই, আমরা পতঙ্গ ছাড়া আর কি।


‘আমার মন' প্রবন্ধে কমলাকান্ত প্রথমেই ওর মন কোথায় হারিয়ে গেছে, কে চুরি করেছে, এই প্রশ্নের সূত্রে নিজের ঔদারিকতা নিয়ে পরিহাস করছে : “মানি, পাকের ঘরে আমার মন পড়িয়া থাকিত।” কিংবা “যেখানে পাচকরূপী বিষ্ণুকর্তৃক, লুচিরূপ সুদর্শনচক্র পরিত্যক্ত হয়, আমার মন সেইখানেই গিয়া বিষ্ণুভক্ত হইয়া দাঁড়ায়” –সুখাদ্যবস্তুর এই বিচিত্র রূপক-কল্পনা আমাদের মনকে কৌতুকরসে গ্লাবিত করে। প্রসন্ন গোয়ালিনীর সঙ্গে কমলাকান্তের গব্যরসাত্মক প্রণয়ের বিবরণও কম কৌতুককর নয়। প্রসন্নর প্রতি তার অনুরাগের কারণ নির্দেশ করতে গিয়ে কমলাকান্ত বলেছে, প্রসন্ন তাকে যে দুধ দেয় তা নির্জল ও দামে সস্তা, দ্বিতীয়ত, সে কখনো কখনো তাকে ক্ষীর, সর, ননী বিনামূল্যে দিয়ে যায়; তৃতীয়ত, সে একদিন তার দপ্তরের কয়েকটি প্রবন্ধ পাঠ করে শুনিয়েছিল, প্রসন্ন শুনেছিল। এত গুণে কোন লেখক বশীভূত না হয়। শুধু তাই নয়, প্রসন্নের গুণের কথা কমলাকান্ত আর বেশি কি বলবে, সে তার অনুরোধে আফিম পর্যন্ত ধরেছিল। প্রসন্নর এত গুণের বিশেষত সর্বশেষ গুণটির প্রশস্তিবাচকের ভঙ্গি আমাদের মনকে হাস্যবেগের তরঙ্গে আন্দোলিত করে তোলে। কলসী কাখে পথচারিণী এক যুবতীর রূপলাবণ্যকে উচ্ছ্বসিত হতে দেখে কমলাকান্তের মনে হয়, এই যুবতীই তার মন চুরি করেছে, সে তার পেছনে পেছনে যেতে থাকে। যুবতী কিছুটা রুষ্টভাবে জিজ্ঞেস করে, সে কেন তার পিছু নিয়েছে। কমলাকান্ত বলে, সে তার মন চুরি করেছে, যখন “যুবতী কটূক্তি করিয়া গালি দিল। বলিল, চুরি করি নাই। তোমার ভগিনী আমাকে যাচাই করিতে দিয়াছিল। দর করিয়া আমি ফিরিয়া দিয়াছি।” কমলাকান্তের এই বিড়ম্বনাও কৌতুককর।


হাস্যরসের এই আয়োজনের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র এই ইঙ্গিত পাঠকদের মনে সঞ্চারিত করে দেন যে, আত্মগত ইন্দ্রিয়সুখ পরিতৃপ্তিতে মানুষের মনের শূন্যতা দুর হয় না। সেই সূত্রেই মানুষের স্থায়ী সুখ যে শুধু পরোপকারেই মেলে, সেটাই তার মনের ধ্রুব আশ্রয়—'আমার মনে'র এই মূল বক্তব্য চিন্তাকে লেখক প্রকাশ করেছেন। ‘বড়বাজার’ প্রবন্ধটির সূত্রপাতও হাস্যরসে। কমলাকান্ত বলেছে, এতদিন পর্যন্ত প্রসন্ন গোয়ালিনীর কাছ থেকে ক্ষীর, সর, দই, দুধ ও ননী খেয়ে আসছিল, আহারকালে সে ভাবত, সুচতুরা প্রসন্ন শুধু পরলোকে সদগতির কামনায় অনন্ত পুণ্য সঞ্চয় করছে। ভোজনের পর কমলাকান্ত প্রতিদিন প্রসন্নের পরকালে অক্ষয় স্বর্গ এবং ইহকালে মৌতাত বৃদ্ধির জন্য দেবতার কাছে প্রার্থনা করত। কমলাকান্তের এই আত্মপ্রসাদের কৌতুকরস উপভোগ্য সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রসন্ন এখন সেই সব জিনিসের জন্য মূল্য চাইছে, মানব চরিত্র যে কী ভীষণ স্বার্থপরতায় কলঙ্কিত, তার পরিচয় পেয়ে কমলাকান্ত ক্ষুব্ধ হয়, তার সেই ক্রোধ-ক্ষোভের প্রতিক্রিয়াও অত্যন্ত কৌতুকাবহ : প্রথম দিন প্রসন্ন যখন মূল্য চাইল, কমলাকান্ত রসিকতা করে উড়িয়ে দিল, দ্বিতীয় দিন বিস্মিত হল, তৃতীয় দিন গালি দিল। তার ফলে প্রসন্ন দুধ দই বন্ধ করল। কমলাকান্ত বলে, সে এতদিনে জানতে পারল, মানব জাতি নিতান্ত স্বার্থপর, সমস্ত আশা ভরসা বিশ্বাস নিষ্ফল, ভক্তিপ্রীতি স্নেহ-প্রেমপ্রীতি মিথ্যা : “হায়। মনুষ্যজাতির কি হইবে! হায়, অর্থলুব্ধ গোয়ালাজাতিকে কে নিস্তার করিবে। হায়! প্রসন্ন নামে গোয়ালার কবে গোরু চুরি যাবে।” কমলাকান্তের এই ক্রোধ-ক্ষোভের প্রকাশে আমাদের হাস্যবেগ অসংবরণীয় হয়ে ওঠে।


এই হাস্যরসাত্মক প্রস্তাবনার পরই কমলাকান্তের আফিমের প্রসাদলব্ধ বিচিত্র কল্পনায় এই পৃথিবী যে একটি বৃহৎ পণ্যশালা সেইরূপ আমাদের সামনে উদ্ঘাটিত হয়, রূপ, বিদ্যা, সাহিত্য, যশ ইত্যাদিকে আমরা বাজারে বিক্রয়যোগ্য পণ্যসামগ্রীরূপেই উপস্থাপিত হতে দেখি এবং সমাজ সংসারের এই বাস্তব সত্যকেও উপলব্ধি করি। সংস্কৃত বিদ্যা যে এদেশের ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের হাতে নিছক ভরণপোষণে বা জীবিকা সংস্থানের উপায় মাত্রে পর্যবসিত হয়েছে, ইয়োরোপীয় পণ্ডিতেরা তাতেই আধুনিক যুক্তি-বিচার বিশ্লেষণে ফলপ্রসু করে তুলেছেন, এই হাস্যরসাশ্রয়ী রূপক-কল্পনায় বঙ্কিমচন্দ্র সেই সত্যকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন “একস্থানে দেখিলাম কতকগুলা ফোঁটা-কাটা টিকিওয়ালা ব্রাহ্মণ তসর গরদ পরিয়া নামাবলি গায়ে, ঝুনা নারিকেলের দোকান খুলিয়া বসিয়া খরিদ্দার ডাকিতেছেন—“বেচি আমরা ঘটত্ব পটত্ব যত গত্ব—ঘরে চাল থাকিলেই স্ব-ত্ব নইলে ন-ত্ব। দ্রব্যত্ব জাতিত্ব গুণত্ব পদার্থ বাপের শ্রাদ্ধে বিদায় না দিলেই তুমি বেটা অপদার্থ।” কলুপটিতে গিয়ে কমলাকান্ত দেখতে পেয়েছে, যত উমেদার ও মোসাহেব সকলে সেজে তেলের ভাঁড় নিয়ে বসে গেছে: “তোমার টাকে চাকরি আছে, শুনিতে পাইলেই পা টানিয়া লইয়া, ভাঁড় বাহির করিয়া তেল মাখাইতে বসে।”


“কমলাকান্তের দপ্তর’-এর প্রবন্ধগুলিতে জীবনের তীক্ষ্ণ মৌলিক বিশ্লেষণ, সমালোচনার বিশিষ্ট ভঙ্গি কল্পনাসমৃদ্ধিযোগে যে কীভাবে অপরূপ ও বিশুদ্ধ হাস্যকিরণ সম্পাতে ভাস্বর হয়ে উঠেছে, 'বিড়াল' প্রবন্ধেও তার পরিচয় পাই। বিড়াল ধনীদের দরিদ্রদের শোষণ-বঞ্চনার মাধ্যমে ঐশ্বর্য সঞ্চয় যে অন্যায় এবং দরিদ্রদের খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জন্মগত অধিকার আছে, এই সত্যকে, তথা সমাজতন্ত্রবাদকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে পাণ্ডিত্যপূর্ণ, তথ্যনিষ্ঠ যুক্তি সমাবেশে নয়। এই বক্তব্য বিষয় অত্যন্ত অপ্রত্যাশিতভাবে এক বিচিত্র খেয়ালী কল্পনার এলোমেলো বাতাসে উড়ে এসেছে, কিন্তু যখন এসেছে, তখন আমরা নিঃসংশয়ে উপলব্ধি করি যে-কোনো সমাজবিজ্ঞানী বা অর্থনীতিবিদ এই বিষয়টিকে আমাদের অন্তরের এত গভীরে, আমাদের মননে ও অনুভূতিতে সঞ্চারিত করে দিতে পারতেন না। ‘বিড়ালে’র সূত্রপাত এই দৃশ্যে: কমলাকান্ত তার শয়নকক্ষে চারপাই-এর ওপর হুঁকো হাতে আফিমের নেশায় তন্দ্রাতুর, একটু মিট মিট করে ক্ষুদ্র আলো জ্বলছে, দেওয়ালের ওপর চঞ্চল ছায়ার প্রেতবৎ নৃত্য, আহার প্রস্তুত হয়নি, সেইজন্য হুঁকো হাতে সে নিমীলিত নেত্রে ভাবছিল, সে যদি নেপোলিয়ন হত তবে ওয়াটার্ল যুদ্ধে জয়ী হতে পারত কিনা। এমন সময় বিড়ালের একটি ক্ষুদ্র শব্দ 'মেও' শোনা যেতেই তার মনে হল, ওয়েলিংটন হঠাৎ বিড়ালত্ব প্রাপ্ত হয়ে তার কাছে আফিম ভিক্ষা করতে এসেছে। কমলাকান্ত পাষাণের মতো কঠিন হয়ে বলবে মনে করল, ডিউক মহাশয়কে ইতিপূর্বে যথোচিত পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এখন আর অতিরিক্ত পুরস্কার দেওয়া যেতে পারে না, বিশেষত অপরিমিত লোভ ভালো নয়। কমলাকান্তের এই আত্মপ্রসাদস্ফীতি কল্পনার হাস্যরস আমাদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও উপভোগ্য মনে হয়, সেই কল্পনায়ই বিড়াল সমাজতন্ত্রবাদের প্রবক্তা ও কমলাকান্ত ধনতন্ত্রের প্রতিনিধিতে রূপান্তরিত হয়, বিড়ালের ক্ষুধার জ্বালার অভিজ্ঞতার বিবরণ, দরিদ্রদের খেয়ে পরে বেঁচে থাকার দাবি এবং ধনীদের তাদের বঞ্চিত করে ঐশ্বর্য সঞ্চয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সামাজিক বৈষম্যের তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ ও সমাজ সমালোচনার এক প্রাণবন্ত রূপ নিয়ে আমাদের হৃদয়মনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।