“সোভিয়েট পরিকল্পনার এই যুক্তিসূত্রে অবশ্যই প্রত্যক্ষ সমস্যার রঞ্জন ছিল।”—সোভিয়েট পরিকল্পনার যুক্তিসূত্র আলোচনা করে এই মতের যাথার্থ্য বিচার করো।

সোভিয়েট রাশিয়া বিপ্লবের পর শিল্পে ও কৃষিতে অসামান্য উন্নতি করে। তাদের নিজস্ব পরিকল্পনা বৈশিষ্ট্যের ফলে এই উন্নতি সম্ভব হয়। “সোভিয়েট ইউনিয়নের আশ্চর্য প্রগতি আমাদের মুগ্ধতার উজ্জ্বল আকাশে উত্তীর্ণ করে।” এর জন্য সোভিয়েট পরিকল্পনার মূল সূত্রগুলি দায়ী। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সূচক সময় থেকে হাল আমল পর্যন্ত যে প্রগতির ধারা বয়ে গেছে, তা দেখে লেখক বিস্মিত ও হতচকিত। সোভিয়েট পরিকল্পনার মূল সূত্র হচ্ছে বিনিয়োগের হার বাড়াতে হবে অবিরাম গতিতে, তা ঢিলে দেওয়া উচিত নয়। বিনিয়োগের ফলে যে সব যন্ত্রপাতি, অন্যান্য উৎপাদন-উপকরণ তৈরি হবে, তা দিয়ে আরও যন্ত্রপাতি ও উপকরণ কেনার ব্যবস্থা করা উচিত। ভোগ্যপণ্য ক্রয় করে তা নষ্ট করা উচিত নয়। উৎপাদনের এই প্রণালী, বিনিয়োগের এই নীতি গ্রহণ করলে, দেশে কলকারখানা ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে ছেয়ে যাবে। এই যন্ত্র বিদ্যুৎ পরিবহনের সাহায্যে দেশে দ্রুততার সঙ্গে উৎপাদন ছড়িয়ে পড়বে। প্রথম দিকে ভোগ্যপণ্য ব্যবহারে কৃচ্ছতা অবলম্বন করলে পরবর্তী পর্যায়ে তার সুফল পাওয়া যাবে। “প্রথম দিকে কৃচ্ছসাধন করো, অস্তিমে অপরূপ ফল পাবে।” লেখকের এই মন্তব্য সোভিয়েট পরিকল্পনা সম্পর্কে সত্য। ভবিষ্যতের কথা যে-সব দেশ ভাবেনি তাদের পরবর্তী পর্যায়ে ভুগতে হয়েছে। উৎপাদনের পূর্ণাংশ ভোগ্যপণ্যে নিঃশেষ হয়েছে। যন্ত্রপাতি কেনার অভাবে যন্ত্রপাতি পূর্ববৎ থাকবে তার ফলে উৎপাদন বাড়বে না। অথচ ক্রমবর্ধমান জনসাধারণের চাহিদা বাড়বে। সাধারণ মানুষ একবার ভোগস্বাচ্ছন্দ্যের রসাস্বাদ পেলে সে আরও বেশি ভোগস্বাচ্ছন্দ্য লাভের জন্য তৎপর হবে। অথচ খাদ্য, শস্য বা বিলাসব্যসনের সামগ্রীর উৎপাদন পূর্ববৎ। সোভিয়েট পরিকল্পনা এই কথা শিখিয়েছে “পরিণামে যদি দুঃখলগ্ন না হতে চাও, আপাতত নিবৃত্তির মন্ত্র শেখো। বিনিয়োগ বাড়াও এবং বিনিয়োগের গুরু অংশ প্রতিনিয়ত যন্ত্র-পরিবহন বিদ্যুৎ ইত্যাদি প্রসারে বিন্যস্ত করো।” সোভিয়েট পরিকল্পনার মূল উৎস তাই যে বিনিয়োগের হার বৃদ্ধি ও যথাক্ষেত্রে বিনিয়োগ।


ধনবিজ্ঞানের একটি প্রাথমিক সিদ্ধান্ত এই পরিকল্পনার মধ্যে নিহিত আছে। বিনিয়োগের হারের সঙ্গে আর্থিক প্রগতি ও অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক। বিনিয়োগের পরিমাণ বেশি বলেই ইউরোপে, চিনে-জাপানে জাতীয় উপার্জন বৃদ্ধির হার সম্মুখবর্তী হয়েছে। কিন্তু বিনিয়োগ করলেই তো চলবে না। বিনিয়োগের আনুপাতিক কত অংশ ইস্পাত-যন্ত্রপাতি-সড়ক-বন্দর-বিদ্যুৎ সেচনে ব্যয়িত হবে, কত অংশ নিত্যকার তাৎক্ষণিক চাহিদার ইন্ধন মেটাতে ব্যয়িত হবে কি না, সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা গড়ে ওঠে সোভিয়েট পরিকল্পনার নিরঙ্কুশ প্রয়োগ সম্পর্কে। সোভিয়েট বিনিয়োগ প্রত্যক্ষ সমস্যার দ্বারা পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রিত। এ-বিষয়ে দুটি দিক লক্ষণীয়। শত্ৰু এবং শত্রু-পণ্য শক্তি দিয়ে নতুন সোভিয়েট বলয়িত। সোভিয়েট সমাজতন্ত্র যে নতুন পরীক্ষানিরীক্ষার আয়োজন করেছিল, তা ছিল ধনতন্ত্রী শত্রুশিবিরে ঘেরা। এই কারণে বিনিয়োগের অধিকাংশ মূলধন সামরিক প্রতিরক্ষা ও শিল্পগত সুরক্ষার পশ্চাতে ব্যয় করা হয়েছিল। প্রতিক্ষার প্রয়োজনে ইস্পাত ও কলকারখানা বা কলকবজার ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। বিনিয়োগের মাত্রা বাড়ানোর নিরিখে সম্ভোগের মাত্রা কমাতে হবে। বাইরে থেকে ভোগ্যপণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রিত। তাই বাইরে থেকে ভোগ্যপণ্য আসার আশঙ্কা নেই। দেশজ পণ্য উৎপাদন নিয়ন্ত্রিত করে ভোগ্যপণ্য যথাসম্ভব কমিয়ে নিয়ে আসতে পারে। ভোগ্যপণ্য সীমিত হলে লোকে উপার্জিত অর্থ সম্ভোগে ব্যয় করতে অপারগ হবে। এইভাবে বাধ্যতামূলক সঞ্চয় বাড়বে। এই সঞ্জয় থেকে বিনিয়োগ বাড়বে। এইভাবে ভোগ্যপণ্যের ব্যবহার সীমিত করে বিনিয়োগের মাত্রা বাড়ালে দেশে অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধি হবে—এটাই লেখকের ধারণা।


অর্থনীতিবিদ হিসেবে লেখকের এই চিন্তা যুক্তিবহ। কারণ সঞ্চয় ও বিনিয়োগের পারস্পরিক সম্পর্ক দিয়ে অর্থনীতি নিয়ন্ত্রিত। বিনিয়োগ ছাড়া শিল্পপ্রসার ও কৃষিপ্রসার সম্ভব নয়। কিন্তু সেই বিনিয়োগ যদি ‘consumer goods'-এ ব্যয় হয় তাহলে শিল্প বা কৃষি উৎপাদনে জোয়ার আসে না। উৎপাদনের প্রাচুর্যের ওপর দেশের অর্থনৈতিক প্রগতি নির্ভর করে। আর এই উৎপাদন ও বণ্টন (Production and Distribution) অর্থনীতির মেরুদণ্ড। প্রচুরতম উৎপাদন ও সুসম বণ্টন দ্বারা সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতির প্রাথমিক পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু বণ্টনে অসাম্য থাকলে 'each according to his need, each according to his deed” –এর দ্বারা সামাজিক কাঠামো নির্দিষ্ট হয়। এই দিক থেকে সোভিয়েত পরিকল্পনার এই আলোচনা যুক্তিবহ ও গুরুত্বপূর্ণ।