'আদাব' গল্পে মাঝি ও সুতা-মজুর চরিত্র দুটি চিত্রণের মধ্য দিয়ে লেখকের দাঙ্গাবিরোধী, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিপূর্ণ মনোভাবটি উজ্জ্বলরূপে প্রকাশিত হয়েছে। এ বিষয়ে তোমার যুক্তিপূর্ণ অভিমত জানাও।

সমরেশ বসু 'আদাব' গল্পের মুখ্য চরিত্র দুটির কোনো নামকরণ করেন নি কেন? এ সম্বন্ধে তোমার সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করো।


চল্লিশের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে সমরেশ বসুর আবির্ভাব 'আদাব' গল্পের মাধ্যমে। ১৯৪৬-এর শারদীয় 'পরিচয়' পত্রিকায় এই গল্পটি প্রকাশিত হয়। ওই বছরেরই ১৬ই আগস্ট তৎকালীন মুসলিম লিগ 'প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস'-এর ডাক দেয়। শুরু হয় হিন্দু-মুসলমানের রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ক্রমশ এই দাঙ্গা সারা বাংলা হয়ে সমগ্র ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে তখন প্রবল বিশ্বাসহীনতা, ঘৃণা, বিদ্বেষ, হিংসা, সন্দেহ আর আক্রোশ। এরই পটভূমিতে সমরেশ বসুর উক্ত গল্পটি রচিত। তিনি এ-গল্পে দাঙ্গার রুদ্ধশ্বাস পরিবেশে মাঝি ও সুতা-মজুর চরিত্রদুটির মধ্যে সঙ্কটাপন্ন সাধারণ মানুষের আতঙ্ক ও অসহায়তার পাশাপাশি তাদের প্রীতিপূর্ণ মানবিক সম্পর্ক স্থাপনের দিকটিকে সমুজ্জ্বল করে দেখিয়েছেন। আরো লক্ষ্যণীয়, উক্ত চরিত্রদুটিকে তিনি কোনো নির্দিষ্ট নামের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখেন নি। কর্মগত পরিচয়ই এখানে তাদের অস্তিত্ব অভিজ্ঞান হয়ে উঠেছে।


‘আদাব’ গল্পের প্রথমে দেখা যায়, দাঙ্গার অগ্নিগর্ভ রাত্রি পরিবেশে প্রাণভয়ে ভীত একটি লোক আশ্রয় নেয় দুটি গলির মধ্যবর্তী স্থানে রাখা এক ডাস্টবিনের আড়ালে। অপর পাশে তারই মতো আরেকটি লোক ভীত-সন্ত্রস্ত। স্থির চার চোখের দৃষ্টি ভয়ে, সন্দেহে, উত্তেজনায় তীব্র হয়ে উঠেছে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না। চোখে চোখ রেখে উভয়েই অপেক্ষা করে থাকে প্রতিপক্ষের আক্রমণের। দাঙ্গার বিষাক্ত পরিবেশে উভয়ের কাছে তখন অন্যপক্ষের জাতের প্রশ্ন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাস্তবে কোনো আক্রমণ না এলে উৎকণ্ঠায় অধৈর্য হয়ে তখন শুরু হয় পরিচয়ের পালা। ক্রমশ পরিষ্কার হয় তাদের পেশা, জানা যায় তাদের আবাসস্থল। আর এই সূত্রেই আমরা প্রথম সনাক্ত করতে পারি মাঝি ও সুতা-মজুর চরিত্রদুটিকে। একজন নারায়ণগঞ্জের সুতাকলের শ্রমিক, বাড়ি চাষাড়ায়; অপরজনের আবাসস্থল 'বুড়িগঙ্গার হেইপারে—সুবইডায়'।


প্রাথমিক এই পরিচয়-লাভের পরেও মাঝি আর সুতা-মজুরের মনে বিশ্বাসহীনতা দানা বেঁধে থাকে। আসলে দাঙ্গাদগ্ধ পরিবেশে আত্মরক্ষার খাতিরেই তাদেরকে এভাবে সংশয়ের জালে বন্দি হতে হয়েছে। ক্রমে ক্রমে সময়ের সহযোগে, কণ্ঠস্বরের আন্তরিকতায় উভয়ের আতঙ্ক আর অবিশ্বাস ধীরে ধীরে দূরে সরতে থাকে। পরস্পরের প্রতি নির্ভরতা বাড়ে—'তুমি চইলা গেলে আমি একলা থাকুম নাকি? উভয়ের পরিচিতি স্পষ্ট হয়। নৌকোর মাঝি মুসলমান আর সুতা-মজুর হিন্দু। কিন্তু লেখক তাদের নামের কোনো উল্লেখ করেন না। গল্পের কাহিনী এগিয়ে চলে অনামা এই দুটি চরিত্রের কথোপকথনকে অবলম্বন করে। প্রকৃতপক্ষে তারা কোনো একক ব্যক্তি নয়, হিন্দু ও মুসলমান—দুই ধর্মের প্রতিনিধি-স্বরূপ। তাদের বড় পরিচয় তারা মানুষ। তাই ধর্মমত ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও তারা ঘনিষ্ঠ হয়, তাদের বন্ধুত্ব বাড়ে। এবং তা সম্ভব হয় তখন, যখন সেই বিশেষ দুই ধর্মের মানুষ সাম্প্রদায়িক হানাহানিতে মত্ত। তারা কিন্তু এই দাঙ্গার স্রোতে গা ভাসায় না। বরং সুতা-মজুরের কাছে মাঝি প্রশ্ন তোলে—'আমি জিগাই মারামারি কইরা হইব কী। তোমাগো দুগা লোক মরব, আমাগো দুর্গা মরব। তাতে দ্যাশের কী উপকারটা হইব?' মাঝির এই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে স্বয়ং লেখকের দাঙ্গাবিরোধী, শাস্তিকল্যাণকামী দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় আমরা পাই।


আলোচ্য গল্পে সমরেশ বসু মাঝির মন্তব্যে যে জিজ্ঞাসাটিকে ফুটিয়ে তুলেছেন, সেই জিজ্ঞাসা কেবলমাত্র মুসলমান মাঝির নয়, দাঙ্গাকবলিত সমাজের অধিকাংশ মানুষেরই। উপরন্তু এ-গল্পে মাঝির কোনো নির্দিষ্ট নাম না থাকায় উপরিউক্ত প্রশ্নটির সঙ্গে বাস্তবের সাধারণ মানুষের জিজ্ঞাসার আরো সাধারণীকরণ ঘটে গেছে। মাঝি-চরিত্রের ব্যক্তিগত স্তর অতিক্রম করে ধর্ম ও জাতি-নির্বিশেষে জিজ্ঞাসাটি দাঙ্গার শিকার হওয়া এবং না-হওয়া অসংখ্য মানুষের সমষ্টিগত ও ঐক্যবদ্ধ জিজ্ঞাসা হয়ে উঠেছে। অপরদিকে, এই প্রশ্নই যেন 'আদাব'গল্পের চরিত্রদুটিকে সাম্প্রদায়িক বিভেদের ঊর্ধ্বে নিয়ে গিয়ে অধিকতর ঘনিষ্ঠ করে তুলেছে। উভয়ের পারস্পরিক সম্প্রীতিপূর্ণ মনোভাবটি আরো আন্তরিক ও গভীর হয়ে উঠেছে। মাঝি ও সুতা-মজুরের এই সৌহার্দ্যের ছবি আঁকার মধ্য দিয়ে লেখক আসলে হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক সম্প্রীতি স্থাপনের আকাঙ্ক্ষাকেই ব্যক্ত করেছেন।


মাঝি ও সুতা-মজুরের পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতা ও সম্প্রীতির চরম প্রকাশ দেখা যায় মাঝির বিদায় নেওয়ার সময়। আটদিন ধরে ঘরের খবর জানতে না পেরে মাঝি যখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঘরে ফিরতে চায়, তখন একান্ত আপনজনের মতো সুতা-মজুর উৎকণ্ঠিত হয়ে মাঝির কামিজ চেপে ধরে বলে—কেমনে যাইবা তুমি, আঁ?' মাঝিও বেদনার্ত স্বরে সুতা-মজুরকে 'ভাই' বলে সম্বোধন করে বলে যে, পরের দিন ঈদ। সোগাহী বিবি আর ‘পোলামাইয়া' অধীর অপেক্ষায় রয়েছে তার আনা নতুন জামাকাপড়ের আশায়। বাড়ি তাকে যেতেই হবে। মাঝির কথা শুনে সুতা-মজুর নিজের বুকের মধ্যে ব্যথা অনুভব করে। মাঝি বিদায়-মুহূর্তে আত্মীয় বিচ্ছেদজনিত দুঃখে কাতর হয়ে সুতা-মজুরকে 'আদাব' জানিয়ে বলে—'যাই......ভুলুম না ভাই এই রাত্রের কথা। সুতা-মজুরও তখন নিজের ধর্মীয়পরিচয় বিস্মৃত হয়ে বলে ওঠে—'আমিও ভুলুম না ভাই—আদাব'। এখানেই যাবতীয় ধর্মীয় বন্ধনকে অতিক্রম করে মাঝি ও সুতা-মজুরের মতন নিতান্ত সাধারণ মানুষের মধ্যে গল্পকার সমরেশ বসু মানবিকতার ও সম্প্রীতির অসামান্য প্রকাশ ঘটিয়েছেন। দাঙ্গাবিধ্বস্ত শহরের রুদ্ধশ্বাস ও সন্দেহকলুষ পরিবেশের বিপ্রতীপে 'আদাব'-এর এই দুই চরিত্র দাঙ্গাবিরোধী ও পারস্পরিক সম্প্রীতিপূর্ণ মনোভাবের যে নজির তৈরি করতে পেরেছেন, তার মানসিক আবেদন সর্বকালে অম্লান হয়ে থাকবে।


মানুষ মানুষের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার পরেও যে সম্প্রীতির সুর স্তব্ধ হয়ে যায় না, তার অপূর্ব চিত্র সমরেশ বসু 'আদাব' গল্পের শেষাংশে আমাদের দেখিয়েছেন। দাঙ্গার ভয়াবহ পরিবেশে সুতা-মজুরকে একলা রেখে পারিবারিক মমতার প্রগাঢ় আকর্ষণে মাঝি চলে যাওয়ার পর নিঃসঙ্গ সুতা-মজুর সেই আতঙ্কিত মুহূর্তেও মাঝির জন্য ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা জানায়—'ভগবান—মাজি য্যান বিপদে না পড়ে।' মাঝি ঘরে ফেরার পর তারা ছেলেমেয়ে ও বিবির আনন্দের কথা সে মনে মনে কল্পনা করে। আর তখনই ‘হল্ট' কথাটি কানে আসতেই সুতা-মজুর গলা বাড়িয়ে দেখে, পুলিশ অফিসার রিভলবার হাতে রাস্তায় লাফিয়ে পড়েছে। তারপরেই আগ্নেয়াস্ত্রের গর্জন শুনে রুদ্ধশ্বাস উৎকণ্ঠায় মাঝির বিপদের সঙ্গে নিজের একাত্মতা বোধ করে সে হাতের আঙুল কামড়ে ধরে। বলা বাহুল্য, স্বল্পক্ষণের পরিচয়ের মধ্যেই সুতা-মজুর আর মাঝির হৃদয়ে সম্প্রীতির সুর একতারে বাঁধা হয়ে গিয়েছিল বলেই এমন চরম মুহূর্তে সুতা-মজুর মাঝির বিপদের সঙ্গে নিজেকে এভাবে একাত্ম করে দিতে পেরেছে। সাম্প্রদায়িক বিভেদ উভয়ের এই সম্প্রীতির বন্ধনে বিন্দুমাত্র অন্তরায় তৈরি করতে পারে নি।


সমরেশ বসু আলোচ্য গল্পে অসাধারণ শিল্প নৈপুণ্যের সঙ্গে হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিপূর্ণ এই মনোভাবকেই উজ্জ্বলরূপে তুলে ধরেছেন। যুদ্ধপ্রিয় মানুষ তথা রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতার্থ করার লালসায় সাধারণ মানুষের জীবনকে সাময়িকভাবে দাঙ্গার আগুনে ঝলসে দিতে সমর্থ হলেও একসময় মানুষের কাছে সেই চালাকি ও অমানুষসুলভ মনোভাব ধরা পড়ে যায়ই। দাঙ্গাবিরোধী এই সাধারণ মানুষ তখন মানবতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে, ঐক্যবদ্ধ হয়। 'আদাব' গল্পে সমরেশ বসু এই সাধারণ মানুষের স্বপক্ষে কলম ধরেছেন। হিন্দু-মুসলমানের জাতিগত পরিচয়ের সঙ্কীর্ণতাকে অতিক্রম করে তাই তাঁর সৃষ্ট মাঝি ও সুতা-মজুর চরিত্রদুটি নামহীন হয়েও সম্প্রীতির সূর্যালোকে দীপ্ত হয়ে উঠেছে।