'সোনার তরী' কাব্যের প্রথম ও শেষ কবিতায় ('সোনার তরী' ও 'নিরুদ্দেশ যাত্রা') 'বিদেশিনী' রূপে কবি কাকে সম্বোধন করেছেন? এই কবিতা দুটির মধ্যে ভাবগত কোনো সাদৃশ্য থাকলে তা পরিস্ফুট করো।

'সোনার তরী' কাব্যের প্রথম কবিতাটির নাম 'সোনার তরী’ আর শেষটির নাম ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা'। এই দুটি কবিতায় নিজের সকল কর্মপ্রচেষ্টা ও কাব্যপ্রচেষ্টার অন্তরালে কবি এক চালিকা শক্তির প্রভাব অনুভব করেছেন। প্রথম কবিতায় নৌকা বেয়ে এক নেয়ে আবির্ভূত হয়ে কবির আবেদনে সোনার ধান অর্থাৎ কবির সৃষ্টি কাব্যসম্ভার তরণীতে তুলে নেন, কিন্তু নৌকায় কবির স্থান হয় না। শেষ কবিতা 'নিরুদ্দেশ যাত্রা’য় আবার সোনার তরীর উল্লেখ আছে, এ তরণীর নাবিকা এক মোহিনী রমণী। তারই নীরব আহ্বানে নৌকাতে উঠে কবি বহুদূর অতিক্রম করে এসেছেন। সন্ধ্যার পর রাত্রিসমাসন্ন। সম্মুখে রাত্রির এবং সুদূর লক্ষ্যের অনির্দেশ্যতায় কবির চিত্ত আশঙ্কা ও সংশয়ে পীড়িত। তরীর সঙ্গিনী নাবিকাকে প্রশ্ন করেও তিনি উত্তর পান না। তবে সেই মোহিনীর রহস্যময় নীরব হাসিতে একটা ভরসা পান।


লক্ষণীয় এই যে প্রথম কবিতায় তরীর কর্ণধার একজন ‘পুরুষ’, দ্বিতীয় কবিতার নৌকাচালিকা একজন ‘নারী'। প্রথম কবিতায় নেয়ে কবিকে তরীতে স্থান দেন নি শুধু কাব্যসম্ভার গ্রহণ করেছিলেন। শেষ কবিতায় কবি নিজেই তরীতে আশ্রয় পেয়েছেন। দুটি কবিতায় দুটি ঘটনা সংস্থানের মধ্যে বৈসাদৃশ্য আছে বলে মনে হতে পারে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কবিমানসের বিবর্তন ও তাঁর ভাবনা-বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে বিচার করলে কবিতা দুটির মধ্যে ভাবগত সাদৃশ্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে।


নিজের জীবন ও কাব্য সাধনার উপরে এক অন্তর্যামী নিয়ন্ত্রীশক্তির প্রভাব রবীন্দ্রনাথকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। এই প্রভাব তিনি ‘সোনার তরী' কাব্যে অনুভব করতে থাকেন এবং তার পরিপূর্ণ উপলব্ধি ঘটে ‘চিত্রা' কাব্যে। বিশ্বসংসার ও কবির ব্যক্তিজীবনের নিরন্তর সংস্পর্শ ও সংযোগে কবিচিত্তে অনুভূত তরঙ্গের উচ্ছ্বাস থেকে সৃষ্ট বিচিত্র কাব্যসম্ভার কর্মকাণ্ড নির্বাহিত হওয়ার পিছনে শুধু ব্যক্তিগত ইচ্ছাশক্তি ক্রিয়াশীল বলে তিনি মনে করেন না। তাঁর জীবনসাধনা ও কাব্যসাধনার মধ্যে অন্তরতর কোনো শক্তির অভিপ্রায় পরিস্ফুট হয়ে উঠছে বলে তিনি অনুভব করেন। এই শক্তি কিন্তু ঈশ্বর নয়। কবির ব্যক্তিজীবনের নিয়ন্ত্রীশক্তি যাকে ‘চিত্রা’ কাব্যে তিনি ‘জীবনদেবতা’ নাম দিয়েছেন।


এই জীবনদেবতার তত্ত্বগত ধারণাটি কবির মনে সহসা উদ্ভূত হয়নি, নানারকমের বিবর্তনের ভেতর দিয়ে ‘চিত্রা’কাব্যে ‘অন্তর্যামী’ কবিতায় তা পরিপূর্ণরূপে লাভ করেছে। ‘সোনার তরী' কবিতায় নেয়েতেই জীবনদেবতার পূর্বাভাস দেখা যায়। 'নিরুদ্দেশ যাত্রা’ কবিতায় ‘জীবনদেবতা' কল্পনার পূর্ণতর পর্যায়ে পৌঁছেছে। এখানে অন্তর্যামী শক্তিকে তিনি নারীরূপে কল্পনা করেছেন। তাই এই শক্তির উপর জীবনের পূর্ণ ভার তুলে দিয়ে একান্তভাবে নির্ভর করেছেন। তারই তরণীতে আরোহী হয়ে অজানার উদ্দেশ্যে চলেছেন। আপন জীবনের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর সঙ্গ লাভ করেছেন, এটাই কবির কাছে একটি বড় ভরসা। বহু বাধা বিঘ্ন সামনে রয়েছে এবং তার জন্য মনে আশঙ্কা ও ব্যাকুলতাও রয়েছে। কিন্তু তার মধ্যেও কবি ভরসা পান, বরাভয় অনুভব করেন।


‘সোনার তরী'র কর্ণধার এবং 'নিরুদ্দেশ যাত্রা’র নাবিক অভিন্ন। এই অভিন্ন শক্তি প্রথম কবিতায় তাই পুরুষরূপে এবং দ্বিতীয় কবিতায় নারীরূপে উপস্থিত। এই শক্তিকেই কবি নিরুদ্দেশ যাত্রায় ‘বিদেশিনী' বলে সম্বোধন করেছেন।


‘সোনার তরী’ ও ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা' কবিতা দুটির আপাত বৈসাদৃশ্য দেখা গেলেও এদের মধ্যে ভাবগত সাদৃশ্য রয়েছে। একই কল্পনার ভিন্ন প্রকাশ ঘটেছে কবিতা দুটিতে। রবীন্দ্রনাথের একটি বিশেষ তত্ত্বভাবনার বিকাশস্তরের সাক্ষ্য হিসাবে কবিতা দুটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এবং একই সূত্রে প্রথিত।