'নজরুলের 'বিদ্রোহী' কবিতাটি প্রকৃতই কোন বিদ্রোহ-বাণীর নয়, এর মর্মকথা হচ্ছে অপূর্ব উন্মাদনা—এক অভূতপূর্ব আত্মবোধ—সেই আত্মবোধের প্রচণ্ডতায় কবি উচ্ছ্বসিত প্রায় দিশেহারা। উক্তিটির যাথার্থ বিচার করো।

'বিদ্রোহী' কবিতায় 'আমি' বলতে কবি কাকে বুঝিয়েছেন? 'বিদ্রোহী' কবিতায় যে বিদ্রোহ ঘোষিত হয়েছে তার প্রকৃত তাৎপর্য বিচার করো।


কবি নজরুল ইসলাম তাঁর কবি জীবনের প্রারম্ভ-বেলাতেই এই ‘বিদ্রোহী' কবিতাটি রচনার দ্বারা বাংলা জনসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ বরেণ্য মানুষের নন্দিত অভিনন্দনও কবি যেমন লাভ করেন, তেমনি লাভ করেন নিন্দার বরমাল্য। দেশের তরুণ সমাজ যেমন কবিতাটির মধ্যে তারুণ্যের জয়যাত্রার বাণী খুঁজে পান, তেমনি অনেকে এই কবিতাটির মধ্যে খুঁজে পান আমিত্বের সাহঙ্কার প্রকাশ, খুঁজে পান সাড়ম্বর আত্মঘোষণা।


বারটি স্তবকে এবং ১৩৯ টি ছত্রে বিন্যস্ত এই দীর্ঘ কবিতায় ‘আমি' শব্দটি ৯৯ বার ব্যবহৃত হয়েছে। প্রথমদিকে 'আমি' বলতে উদ্দিষ্ট হয়েছে দেশের বীর-সমাজ—নবচেতনাদীপ্ত বীর দেশবাসী ও বীর তরুণ দল। এদেরই উন্নত শিরে দণ্ডায়মান হতে কবি উচ্চকণ্ঠে আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু তারপরেই কবি এদের সঙ্গে নিজের সত্তাকে মিলিয়ে দিয়ে, এদের বোধের সঙ্গে নিজের বোধকে একাত্ম করে, এদের সঙ্গে এক হয়ে গেলেন। কবিতার দ্বিতীয় স্তবক থেকেই ‘আমি’ বলতে দেশবাসী তথা মানুষ, তরুণ দল, কবি নিজে—এই তিনে এক হয়ে গেছে। 'আমি' বলতে সূচিত হয়েছেন কবি নিজে।


কিন্তু কবির এই পরিচয় প্রাত্যহিক জীবনের বেড়া দেওয়া ধূলি-মলিন পরিচয় নয়। রবীন্দ্রনাথের ‘দুই পাখি'র উপমা দিয়ে বলা যায় প্রত্যেক মানুষের মধ্যে রয়েছে দুটি সত্তা—তার মধ্যে কার এক ‘আমি’ প্রাত্যহিকতার বেড়ার মধ্যে থেকে তার প্রতিদিনের পরিচয় বহন করে। আর এক ‘আমি’ তার বিরাটত্বের পরিচয়বাহী। প্রাত্যহিক সাধারণ আমিত্বের সত্তায় থাকে অহংকার, আর বৃহত্তর আমিত্বের সত্তায় থাকে অহংবোধ। রবীন্দ্রনাথ এই দুটো সত্তাকে পৃথকীভূত করে বোঝাতে গিয়ে বলেছেন, 'ছোট আমি' ও 'বড়ো আমি'। আধ্যাত্মিক পরিভাষায় একটি জীবাত্মবোধ, অপরটি পরমাত্মবোধ। দর্শনের কথায় এই 'বড়ো আমি' বা বিরাট আমি হচ্ছে মানুষের একধরনের আত্মব্যক্তিত্ব বা ego।


সাধারণভাবে মানুষ তার 'ছোট আমি'র প্রাত্যহিকতায়ই বদ্ধ থাকে। কিন্তু কখনো কখনো তার জীবনে বৃহতের প্রসাদ নামে, মহাজীবনের ডাক এসে পৌঁছায়। মানুষের মধ্যে অকস্মাৎ (অহংকারের নয়) অহংবোধের জাগরণ ঘটে। আমিত্বের সম্প্রসারণ ঘটে, তাকে এক বিরাট শক্তি দান করে। এই শক্তিতে উদ্বুদ্ধ হয়েই মানুষ অসাধ্য সাধনে এগিয়ে যায়। এই শক্তির প্রেরণাতেই উদ্বুদ্ধ হয়ে 'আমি' হিসেবে নজরুল আপন বৃহত্তর সত্তাকে প্রকাশ করেছেন।


কাজেই আত্ম-অহংকারের বলয়ে বেষ্টিত সাধারণ মানবত্বের সমগ্র উচ্চারিত আমিত্ববোধ নয়, বৃহত্তর বোধে উজ্জীবিত অহংবোধের জাগরণ, তথা বৃহৎ আমিত্বের প্রসারণই এখানে ঘটেছে এবং এই বোধের মধ্য দিয়েই তিনি সমস্ত মানুষের সঙ্গে, বিশেষ করে দেশের নিপীড়িত মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছেন, তিনি দেশের প্রতিটি মুক্তি পাগল মানুষের সঙ্গে এক হয়ে গেছেন। তাদের শুনিয়েছেন চিত্ত-জাগরণের মন্ত্র। এই মুক্তি ভাবনার সমিধ তিনি শুধু একাল থেকেই গ্রহণ করেন নি। দূর অতীত থেকেও, এমন কি পৌরাণিক এবং প্রাগপৌরাণিক যুগ থেকেও ভাবনার প্রয়োজনীয় সমিধ তিনি গ্রহণ করেছেন এবং তাদের সঙ্গেও নিজেকে এক করে ভেবেছেন। ফলে করতলস্থ আমলকীর মত বিশ্ব ইতিহাস ও বিশ্বপ্রকৃতি কবির আমিত্বের পরিধিতে ধরা দিয়েছে। এর ফলে যথার্থই এই ‘আমি’ যেন বিশ্বময় ব্যাপ্ত হয়ে কবির মনে বিশ্বরূপেরই প্রতিফলন ঘটিয়েছে। কবির অনুভবে রোমান্টিক ভাবনা ও মিষ্টিক চেতনা এক অদ্বয়যোগে মিলে গেছে। ফলে ‘বিদ্রোহী' কবিতায় ‘আমি’ হয়ে উঠেছে সমষ্টিচেতনার যোগফল। ব্যক্তি ‘আমি’ হয়েও এই 'আমি' ব্যক্তি আমি নয়, বিদ্রোহী এই 'আমি' বিশ্বাত্মবোধে দৃপ্ত, উন্নতশির বিশ্ব ‘আমি'।


‘বিদ্রোহী’ কবিতায় সহসা নিজেকে চিনতে পারা 'আমি'র যে বিদ্রোহ ঘোষিত হয়েছে, প্রাথমিকভাবে এই বিদ্রোহ ভগবানের বিরুদ্ধে, খেয়ালী ভগবানের সৃষ্ট এই সৃষ্টির বিরুদ্ধে, এই জগতের অনিয়ম, বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে এবং এই বিদ্রোহ মানুষের যে কোনরকম পরাধীনতার বিরুদ্ধে। মানুষের শুধু রাজনৈতিক পরাধীনতাই নয়—সামাজিক, নৈতিক, ধর্মীয় সর্বক্ষেত্রেই অধীনতার যে বশ্যতা, হতাশা ও অবসাদ রয়েছে সবকিছুর বিরুদ্ধেই একটা সর্বাত্মক বিদ্রোহের আহ্বান এই কবিতাটিতে ধ্বনিত হয়েছে। ধ্বনিত হয়েছে সর্বক্ষেত্রে মানুষকে স্বাধীন করবার এক উদ্যত্ত উদার আহ্বান।


তাই যে সমস্ত শক্তি মানুষকে অবদমিত করে রেখেছে, নানাদিকের উৎপীড়নের চাপে মানুষের স্বাধীন সত্তার বিকাশের পথ রুদ্ধ করেছে–কবির বিদ্রোহ তারই বিরুদ্ধে। সামাজিক ক্ষেত্রে অকারণ বিধি-নিষেধের যে-সব সংস্কার কুসংস্কারের রূপ ধরে মানুষের পায়ে শৃঙ্খল রচনা করে, ধর্মীয় ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতা, গোষ্ঠীবদ্ধতা এবং যে সমস্ত ধর্মীয় অত্যাচার মানুষের স্বাভাবিক বিচারবোধকে অবসাদগ্রস্ত করে রাখে; অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সামস্ততান্ত্রিক ও ধনতান্ত্রিক শোষণব্যবস্থা যা সমাজের বৃহত্তর মানুষকে পঙ্গু করে রাখে; এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ সরকারের শাসন যা উৎপীড়নের চাপে মানুষের স্বাধীনতা গুঁড়িয়ে দেয়, সেই সামাজিক ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সমস্ত রকম উৎপীড়নের বিরুদ্ধেই কবির আপসহীন বিদ্রোহ ‘চিরবিদ্রোহী’ কবির কণ্ঠে ভাষা পেয়েছে। উন্নত শিরে কবি বলেছেন

“যবে উৎপিড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,

অত্যাচারীর খড়্গ-কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না 

বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত

আমি সেই দিন হব শান্ত।”


কিন্তু চিরবিদ্রোহী কবির বিদ্রোহভাবনা এখানেই শেষ হয়ে যায় নি। আর একটু ঘনিষ্ঠভাবে লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাব যে ব্যাপক অর্থে এই বিদ্রোহ কবির নিজেরও বিরুদ্ধে, কবির নিজের প্রাত্যহিকতার বেড়া দিয়ে ঘেরা তাঁর 'ছোট আমি'র বিরুদ্ধে। আত্মোপলব্ধি ও বিশ্বাত্মবোধের মধ্য দিয়ে কবিচিত্তের যে মহাজাগরণ ঘটল, যার ফলে সহসা তিনি নিজেকে, নিজের স্বরুপকে চিনতে পারলেন, প্রাত্যহিকতার বেড়া দিয়ে ঘেরা সীমাবদ্ধ জগতের সব বাঁধ খুলে গেল। সেইদিনই বিশ্বের সঙ্গে যোগে তাঁর মধ্যে ঘটল ‘বড় আমি'র উদ্বোধন। শুধু উদ্বোধন নয়, ‘বড় আমি'র বিদ্রোহও ঘোষিত হল। সে বিদ্রোহ আপন ক্ষুদ্রতা, তুচ্ছতা, ক্লীবতা, সীমাবদ্ধতার বিরুদ্ধে ; সেই সঙ্গে সঙ্গে সেই বিদ্রোহ বিশ্বের যেখানে যত ক্ষুদ্রতা তুচ্ছতা রয়েছে তার বিরুদ্ধেও। স্বার্থবোধের বিরুদ্ধে বিশ্বাত্মবোধ, নিঃস্বার্থবোধের, তথা ক্ষুদ্র জীবনের সঙ্গে মহাজীবনের সংগ্রামী চেতনাই এই ‘বিদ্রোহী' কবিতাতেই বিদ্রোহীচেতনার রূপ পেয়েছে। তাই কবি বলেছেন—

“আমি চির-বিদ্রোহী বীর-

আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!”


কবির বিদ্রোহী মনের এই নতুন উপলব্ধিই কবিতাটিতে নতুন মাত্রা সংযোজিত করেছে।


তাই, এই ‘বিদ্রোহী' কবিতাতে কবির বিদ্রোহ রাজনৈতিক, সামাজিক বা ধর্মীয় কোন প্রথা বা সংস্কারের বিরুদ্ধে কোন বিদ্রোহের বজ্র নির্ঘোষ নয়। এই বাণী ক্ষুদ্র আমিত্বের খোলসকে ভেঙ্গে ফেলে বৃহৎ আমির বেরিয়ে আসার বাণী, আত্মজাগরণের বাণী। আর এই বৃহতের উপলব্ধিতে কবি সত্যই দিশেহারা।