‘একা' প্রবন্ধের মূল বক্তব্য সংক্ষেপে লেখো | 'একা' প্রবন্ধের নামকরণের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।

নামকরণ : 'একা' প্রবন্ধের মধ্যে মানুষের নিঃসঙ্গ একাকীত্বের কথা বলা হয়েছে। কোনো এক জ্যোৎস্নালোকিত রজনিতে রাজপথে এক অজানা পথিকের মুখে পুরাতন এক গীত শুনে কমলাকান্তের মুখে অতীতের সুখস্মৃতি জেগে উঠল। তিনি ভাবলেন, এই সংসারে তিনি একা বলেই তাঁর মনে কোনো আনন্দ নেই। এই পৃথিবীতে যে একা থাকা বড়ো যন্ত্রণাদায়ক, তা-ও তিনি বুঝতে পেরেছেন। এই একাকীত্বের সূত্র ধরেই তার মনে নানা ভাবনানুসঙ্গ জেগেছে। তিনি বুঝতে পেরেছেন, যৌবনে আসা দিন, তাই তাঁর মনে আনন্দ ছিল। আজ পরিণত বয়সে তার মনে কোনো আশা নেই, তাই তার মনে কোনো আনন্দ নেই। একথাও বুঝতে পেরেছেন যে তিনি সংসারচক্রে আরোহণ করে যেখান থেকে যাত্রা করতে হয়, সেখানেই আবার ফিরে আসতে হয়। কমলাকান্ত একা থাকার যন্ত্রণাদায়ক উপলব্ধি থেকেই বলেছেন, এ সংসারে কেউ যেন একা না থাকে। কেউ যদি প্রণয়ভাগী না হয়, তবে তাঁর মনুষ্যজন্মটাই বৃথা। জোৎস্নালোকিত রজনিতে আজানা গায়কের গীতের সূত্র ধরে একাকীত্বের যন্ত্রণা বর্ণিত হওয়ায় আলোচ্য প্রবন্ধের নামকরণ সার্থক হয়েছে।


সংক্ষিপ্তসার : কমলাকান্ত একাকী নিঃসঙ্গ অবস্থায় বসেছিলেন কোনো এক জ্যোৎস্নাপুলকিত রজনিতে। সেইসময় একজন পথচারী পথ দিয়ে একটি গীত গাইতে গাইতে যাচ্ছিল। দূর থেকে ভেসে আসা সেই গীতটি কমলাকান্তের মনের মধ্যে অপূর্ব পুলক সৃষ্টি করল। তাঁর স্মৃতিপথে উদয় হল পূর্বেকার অনেক সুখস্মৃতি। পথিক যে গীতটি গাইতে গাইতে যাচ্ছিল, সেটি সুন্দরও নয়, কিংবা গায়কের কণ্ঠও তেমনি সুমিষ্ট নয়। কিন্তু তথাপি সেই পুরোনো গীতটির বাণী কমলাকান্তের হৃদয়কে আলোড়িত করে তুলল।


রাজপথ দিয়ে কত নরনারী জোৎস্নাপুলকিত রজনিতে আনন্দিত চিত্তে ভ্রমণরত। ঘরের মধ্যে কমলাকান্তই শুধু একাকী নিঃসঙ্গ। চারধারের এই উদ্বেল আনন্দের সঙ্গে কমলাকান্তের কোনো সংযোগ নেই, আনন্দধারার মধ্যে তিনি নিরানন্দ। কমলাকান্ত আজ হৃদয় দিয়ে বুঝতে পারলেন, তিনি একা নিঃসঙ্গ বলেই এত আনন্দের অংশীদার হবার মতো তাঁর কোনো ক্ষমতা নেই। এই প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য : কেউ যেন এ সংসারে একা না থাকে।


কমলাকান্ত কিন্তু চিরকাল এমন একলা ছিলেন না। অতীতে তিনিও সকলের আনন্দের অংশ ভাগ করে নিতেন, সংসারকে সুন্দর দেখতেন, গীত শুনে আনন্দ পেতেন। তখন তাঁর অনেক বন্ধু ছিল, ছিল আপনজন। সেইসময় তিনিও তাদের মধ্যে থেকে কত সুখের হাসি হাসতেন। তারপর তিনি নিঃসঙ্গ হয়ে গেলেন। তাঁর জীবন থেকে হাসি গান চলে গিয়েছিল। আজ আবার এই গীত শুনে পুরানো সব কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল অতীতের ফেলে আসা দিনগুলির সুখস্মৃতি। আর সেই স্মৃতি আবার নতুন করে তাঁর মনে পুলক এনে দিয়েছে।


কমলাকান্ত এবার নিজের হৃদয় অনুসন্ধানে মগ্ন হয়েছেন। তিনি দেখেছেন যে চারদিকে সুখের লেশ তো একটুও কমেনি। বরঞ্চ দীর্ঘ জীবনে সুখের উপকরণ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।তথাপি তাঁর মনে এখন আনন্দ নেই। পৃথিবীকে এখন আর আগেকার মতো ভালো লাগে না। প্রকৃতির রূপরাশি আর তেমন করে উপভোগ করতে পারবে না। অতীত যেসব সামগ্রী মনকে মুগ্ধ করে রাখত, এখন আর সেইগুলি মনকে মুগ্ধ করতে পারে না। কোনো জিনিসের অভাবের ফলে মনের এই অবস্থা।


কমলাকান্ত নিজের মনের দিকে তাকিয়ে এই জিজ্ঞাসারও উত্তর খুঁজে পেয়েছেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন যে এখন এই পরিণত বয়সে মনের মধ্যে কোনো আশা নেই বলে মন আর আগেকার মতো আনন্দ পায় না। আশা আগে নানারকম রঙিন ছবি দেখিয়ে মনকে মুগ্ধ করত, এখন মনে আশা নেই বলে মন আর মুগ্ধ হয় না। জীবনের অভিজ্ঞতায় কমলাকান্ত অনেক কিছু বুঝতে শিখেছেন। এখন তিনি বুঝতে পেরেছেন যে সংসার হ’ল পথবিহীন নিবিড় অরণ্য। এই অরণ্য থেকে বেরিয়ে আসবার কোনো পথ নেই। একদা তাঁর মনে কত অফুরন্ত, সৌন্দর্যের লীলাভূমি, এখন তার বীভৎস রূপ মনকে স্তম্ভিত করে। যে গীত শুনে অতীতে তিনি আনন্দপ্লুত হতেন, সেই গীত এখন আর তিনি শুনতে চান না। সংসারের রস তিনি আর উপভোগ করতে পারেন না, সংসার-সংগীতে তিনি আর কোনো আনন্দ পান না। সেই সংগীতের বদলে তিনি এমন সংগীত শুনতে চান যা প্রীতি ও প্রেম দিয়ে ভরা। সর্বভূতে যদি প্রেম ও প্রীতি থাকে, তবে তিনি সেই প্রেম ও প্রীতিরই প্রত্যাশী। তাঁর মতে, প্রীতিই ঈশ্বর।