“বিড়াল” রচনায় লেখকের সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় | ‘বিড়াল’ রচনায় বঙ্কিমচন্দ্রের সাম্যবাদ চিন্তার পরিচয়

“সমাজের ধন বৃদ্ধির অর্থ ধনীর ধন বৃদ্ধি।”-বিড়ালের এই মন্তব্যের আলোকে বঙ্কিমচন্দ্রের অর্থনৈতিক চেতনার পরিচয় দাও।


১২৮১ বঙ্গাব্দের চৈত্রমাসে ‘বঙ্গদর্শনে' প্রকাশিত হয় বঙ্কিমচন্দ্রের বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘বিড়াল’। হাস্য-পরিহাসের বাতাবরণের আড়ালে বহুমুখী বঙ্কিম-প্রতিভার একটি বিশেষ দিক—অর্থাৎ তাঁর সমাজতান্ত্রিক চিন্তা ভাবনা এই রচনাটিতে রূপলাভ করেছে। ঐতিহাসিক দৃষ্টিতেও এই তথ্যটি মূল্যবান যে, মার্কসীয় অর্থনীতিবিদ্যা বিশ্বে প্রচারিত হবার বহু পূর্বেই বঙ্কিমচন্দ্র প্রায় একই ধরনের অনুভব পোষণ করতেন।


সমকালীন সমাজকে অত্যন্ত তীক্ষ্ণ ও নিপুণভাবে প্রত্যক্ষ করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। কখনও ব্যঙ্গ, কখনও কটাক্ষ, কখনও সহানুভূতি বা আদর্শায়িত বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে ‘কমলাকান্তের’ বিভিন্ন অধ্যায় তার প্রকাশ দিয়েছে। 'বিড়াল' রচনাটিতে উপস্থাপিত সমস্যা পৃথিবীর সর্বদেশের সর্বকালের একটি প্রধানতম সমস্যা। তা'হল ধনী-দারিদ্রের বৈষম্য। যে কোনো শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষই এই বৈষম্য দূর করতে চাইবেন। এ-রচনায় অত্যন্ত নৈপুণ্যের সঙ্গে লেখক ধনী ও দরিদ্র উভয় শ্রেণির প্রতিনিধি হিসাবে যথাক্রমে কমলাকান্ত চক্রবর্তী এবং একটি বিড়ালকে মুখোমুখি উপস্থিত করেছেন। তাদের কথোপকথন, আত্মপক্ষ সমর্থন একদিকে যেমন নাটকীয়তার সৃষ্টি করেছে, অন্যদিকে তেমনই বিষয়টি পাঠকের কাছে অধিক মনোযোগ আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছে। আলোচনা বা বির্তকের উপসংহারে দেখি সমাজের ধনী শ্রেণির মুখ পাত্র স্বয়ং কমলাকান্ত চক্রবর্তী বিড়ালের কাছে প্রকাশ্যে না হলেও মনে মনে পরাজয় স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছেন।


অতএব উপসংহারটি যথেষ্ট ইঙ্গিতবহঃ সমাজে ধীরে ধীরে ধনী-দরিদ্রের কৃত্রিম ভেদ লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে এবং সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ঘটছে—তার পূর্বভাস গোপন নেই। দরিদ্র, সর্বহারা শ্রেণির প্রতিনিধি বিড়ালের মতো ধনীর দোষেই দরিদ্র চোর হয়। খেতে গেলে কেউ চুরি করে না। বেঁচে থাকবার জন্য প্রথম এবং প্রধান প্রয়োজন হয় অন্ন। কিন্তু পৃথিবীতে স্বার্থপর এবং কৃপণ ধনীরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভোগ করে, উচ্ছিষ্ট ফেলে দেয়—তবু গরিবদের জন্য তাঁর মানবত্মার জাগরণ ঘটে না। একজন ধনী দশজনকে শোষণ ক'রে তাদের বরাদ্দ অর্থ আত্মাসাৎ ক'রেই বড়োলোক হয়। মুষ্টিমেয় ধনী যত বড়োলোক হতে থাকবে, দরিদ্র মানুষের সংখ্যা এবং তাদের দারিদ্র্য ততই বাড়তে থাকবে।


ধনতন্ত্রবাদীদের প্রতিনিধি হিসাবে কমলাকান্ত তাঁর দারিদ্র্য স্বপক্ষে একটি মুক্তি দিয়ে জানিয়েছেন যে, চোরের জ্বালায় ধনী যদি ধন বৃদ্ধি না করতে পারে, তবে সামাজিক ধন বৃদ্ধির ধারা স্তব্ধ হয়ে যাবে; সমগ্র সমাজেই তার প্রভাব পড়বে। এর উত্তরে বিড়াল দু'টি অতি বাস্তব কথা বলছে—(১) “সামাজিক ধন বৃদ্ধির অর্থ ধনীর ধন বৃদ্ধি।” এবং (২) “আমি যদি খাইতে না পাইলাম, তবে সমাজের উন্নতি লইয়া কি করিব ?”


দুটি বক্তব্যই পরস্পরের পরিপূরক এবং বাস্তব সত্য। বহু মানুষকে তাঁদের প্রাপ্য খাদ্য থেকে বঞ্চিত ক'রে যদি সমাজের ধন বৃদ্ধি ঘটান হয়, তবে সে ধন কাদের জন্য ? সমাজ কি কেবল মুষ্টিমেয় কয়েকজন বিত্তবানের লীলাভূমি ? এই জাতীয় ধন বৃদ্ধি তো আসলে সামাজিক ধন বৃদ্ধি নয়, বরং বলা যায় ব্যক্তিগত ধন বৃদ্ধি। বিড়াল প্রতিবাদ জানিয়েছে এই ব্যক্তিগত ধন বৃদ্ধির ব্যবস্থার বিরুদ্ধে।


এই প্রবন্ধে বিড়াল আর একটি কথা বলেছে যা যথেষ্ট অর্থবহ—“খাইতে দাও, না হইলে চুরি করিব-অনাহারে মরিয়া যাইবার জন্য কেহ পৃথিবীতে আসে নাই।” শব্দগুলি আপাতত নিরীহ মনে হলেও এর পেছনে সমানাধিকারের বোধ থেকে জাত এক ধরনের অসহিষ্ণুতা বা বিদ্রোহের ভাব আছে। অর্থাৎ বিড়াল যেন বলতে চায়—'খাইতে দাও, নইলে কাড়িয়া খাইব।'


বঙ্কিমচন্দ্রের সমাজচেতনা এ প্রবন্ধে স্পষ্টতই বলতে চেয়েছে যে, সমাজে যারা সংখ্যায় বেশি, সেই বহুসংখ্যক দরিদ্রকে বাদ দিয়ে বঞ্চিত করে কোনোরকম সামাজিক উন্নতি হতে পারে না। সে উন্নতি শিক্ষাক্ষেত্রে, অর্থনীতিতে বা রাজনীতিতে—যেখানেই হোক না কেন। সেই সঙ্গে আমাদের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার প্রতিও তিনি তাঁর ক্ষোভ গোপন রাখেননি। দোষীর যথার্থ মূল্যয়ন না করেই এখানে তাকে সাজা দেওয়া হচ্ছে। তবু এ আলোচনায় বঙ্কিমচন্দ্রের অর্থনৈতিক চিন্তা সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে এবং তাঁর সিদ্ধান্ত হ'ল, সমাজের সমস্ত মানুষের জন্য সম-অর্থবন্টন।