‘ছিন্নপত্র আকারে চিঠি কিন্তু প্রকারে রবীন্দ্র মনের আয়না'— বিচার করো | 'রবীন্দ্র জিজ্ঞাসু যিনি, তাঁর কাছে ছিন্নপত্র হয়ে উঠতে পারে এক আশ্চর্য মায়ামুকুর'। সমালোচকের মন্তব্যের আলোকে রবীন্দ্র জীবন ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে ছিন্নপত্রের গুরুত্ব নিরূপণ করো।

‘ইহাদের মধ্যে রবীন্দ্র মানসের বিশেষত তাহার ব্যক্তি সত্তার অভিরুচি, ইচ্ছা ও মেজাজের যে অন্তরঙ্গ পরিচয় উদ্ঘাটিত হয়েছে তা তার বিপুল ও বিচিত্র সাহিত্য সৃষ্টি, অন্য কোনো বিভাগে এত সহজ ও সাবলীল প্রকাশ পায় নাই। ছিন্নপত্র প্রসঙ্গে মন্তব্যের যথার্থতা বিচার করো।
‘আমরা দৈবক্রমে প্রকাশ হই, আমরা ইচ্ছা করলে, চেষ্টা করলেও প্রকাশ হতে পারিনে'—ইন্দিরা দেবীকে লিখিত রবীন্দ্রনাথের এই উক্তির আলোকে ছিন্নপত্র রবীন্দ্রনাথের আত্মপ্রকাশের রূপ ব্যক্ত করো।


‘পৃথিবীর অনেক মহামূল্য উপহার আছে, তার মধ্যে সামান্য চিঠিখানি কম জিনিস নয়। —ছিন্নপত্র—১৪১। মনীষীদের সাহিত্য-জীবন, কর্মজীবনের সাথে সাথে ব্যক্তিজীবনের অন্তরঙ্গ পরিচয় গ্রহণের অদম্য আগ্রহ থেকেই চিঠিপত্রের মূল্য স্বীকৃতি পেয়েছে। সাহিত্য বা শিল্পের প্রকাশ অনেক ক্ষেত্রে শিল্পিত, কৃত্রিম—কিন্তু চিঠিপত্রে শিল্পী নেমে আসেন অনেক নীচে, ভাব থেকে, বাস্তব থেকে। শশিভূষণ দাশগুপ্ত লিখেছেন যে, চিঠিপত্রের মধ্য দিয়ে আমরা—'নির্ভয়ে অসংকোচ, অকুণ্ঠিত চিত্তে নিজেকে প্রকাশ করি। বঙ্গভাষা ও সাহিত্য সংস্কৃতির উনিশ শতকের ও রসচেতনার জগতের এক অত্যুজ্জ্বল কাণ্ডারী রবীন্দ্রনাথও তাঁর সমগ্র জীবনে কমবেশি সাত হাজার পত্র লিখেছেন। বেশির ভাগ পত্রেই তাঁর আপন অন্তরের কথা উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। ছিন্নপত্রের অধিকাংশ পত্রই তাই রবীন্দ্র মনের আয়না।


ছিন্নপত্রের চিঠিগুলির মধ্যে রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ জীবন-পর্বের বিচিত্র অভিজ্ঞতা অনুভূত। লঘুচিন্তা, গভীর দর্শন, ব্যক্তিজীবনের ছায়া কবি-জীবনের দীপ্তি, সৌন্দর্য প্রীতি, প্রকৃতি ও মানব-প্রেম যে বিপুল ও বিচিত্র ধারায় অনর্গল প্রবাহিত হয়েছে অন্য কোনো রচনায় তা দুর্লভ।


ছিন্নপত্রে একদিকে যেমন পাই তাঁর সরস, মনের ছোঁয়া কৌতুককরে নানা চিত্র—যেমন, তাঁর কোমরের যন্ত্রণা নিয়ে লেখা চিঠি দুটি পত্রে অসাধারণ হাস্যরস পরিবেশন করেছেন, ছিন্নপত্রাবলির দুই সংখ্যক পত্রে তিনি ইন্দিরা দেবীকে জানান—“আজকের চিঠিটা যদি একঘেয়ে রকম হয়.....তবে জানবি আমার এই ভাঙা কোমরের দোষ, তার জন্য আর কারো দোষ দেখা যায় না। এর ওপরে আবার একেকটা বিপর্যয় হাঁচি বেরোচ্ছে—মনে হচ্ছে যেন শরীরের ঊর্ধ্বভাগ ভাঙা কোমর থেকে ছিটকে পড়ে যাবে।” আবার এই একই কথা শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে জানান—“কোমর ভেঙে গেলেই মানুষ একেবারে কাৎ, তার আর উত্থান শক্তি থাকে না। তখন প্রেমের আহ্বান, স্বদেশের আহ্বান, সমস্ত পৃথিবীর আহ্বান এলেও সে কোমরে তার্পিন তেল মালিশ করবে।” (ছিন্নপত্র—–৭) তেমনি হাস্যরসের পাশাপাশি পাই নদীতীরবর্তী মানবজীবনের চিত্রের সাথে সাথে তাঁর মনের ও পৃথিবী প্রীতি অসামান্য চিত্ররূপ—“আমার এই দরিদ্র চাষি প্রজাগুলোকে দেখলে আমরা ভারি মায়া করে, এরা যেন বিধাতার শিশু সন্তানের মতো নিরুপায়।” (ছিন্নপত্র—৮১) পৃথিবীকে ভালোবাসার সাক্ষ্যও মেলে বেশ কিছু পত্রে—“ওই যে মস্ত পৃথিবীতে চুপ করে পড়ে আছে, ওটাকে এমন ভালোবাসা—ওর এই গাছপালা, নদী, মাঠ, কোলাহল, নিস্তব্ধতা, প্রভাত, সন্ধ্যা সমস্যা শুদ্ধ দুহাতে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করে। মনে হয় পৃথিবীর কাছ থেকে আমরা যেসব ধর্ম পেয়েছি এমন কি কোনো স্বর্গ থেকে পেতাম ?” (ছিন্নপত্র—১৮) ছিন্নপত্রে এসেছে ব্যক্তিগত পারিবারিক প্রসঙ্গও। যেমন ছিন্নপত্রের ১০৬ সংখ্যক পত্রে পাই কবির ছেলেবেলাকার স্মৃতি। পেনেটির বাগান, পৈতের নেড়া মাথা নিয়ে বোলপুরের বাগান দর্শন, চাকরের কথা ইত্যাদি উত্থাপিত হয়েছে। যেমন পারিবারিক প্রসঙ্গে একটি পত্রে লিখেছেন—“বেলি খোকার জন্য এক-একবার মনটা ভারি অস্থির হয়।" ছিন্নপত্রে ঘুরে ফিরে বারংবার এসেছে প্রকৃতি প্রীতির প্রসঙ্গ। সৌন্দর্য পিয়াসী রবীন্দ্রনাথের চোখে পদ্মা অনন্য সাধারণ রূপের ডালি নিয়ে ধরা দিয়েছে। পদ্মার সাথে যেন তার জন্ম-জন্মান্তরের সম্পর্ক—“আমাদের দুজনের মধ্যে একটা খুব গভীর এবং সুদূরব্যাপী চেনাশোনা আছে।” (ছিন্নপত্র-৬৭) নদীবিধৌত-তা এককথায় অনবদ্য যেমন “সূর্য সম্পূর্ণ অস্ত যায়, আকাশের সুবর্ণ আভা মিলিয়ে যায়, অন্ধকারে চারদিক অস্পষ্ট হয়ে আসে.....পাণ্ডুবর্ণ বালির ওপরে এ পাণ্ডুবর্ণ জ্যোৎস্নায় চোখে আরও কেমন বিভ্রম জমিয়ে দেয়।” (ছিন্নপত্র—১০) শুধুই হাস্যরস, প্রকৃতি ও পদ্মাপ্রীতি, মনের ও পৃথিবীর প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার অপকট প্রকাশই নয় এই পদ্মাই ‘ছিন্নপত্রে’-র যুগে কবিচিত্তে জন্ম দিয়েছে অজস্র কবিতার বীজ ও বহু ছোটোগল্পের বীজ। 'ছুটি' গল্পের ফটিক, ‘সমাপ্তি'র মৃন্ময়ী, ‘অথিতি’র তারপদ, ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পের পোস্টমাস্টার, ‘মেঘ ও রৌদ্রের’ গিরিবালা অনেকেই উঠে এসেছে পদ্মতীরের মাটি থেকে। রবীন্দ্রনাথের ‘বলাকা' কাব্যের বীজও সম্ভবত অঙ্কুরিত হয়েছে এই পদ্মাতীরে। সেদিনের সেই পদ্মাই ‘বলাকা'য় ‘চঞ্চলা' হয়ে দেখা দিয়েছে বলে মনে হয়।


সুতরাং উপসংহারে বলাই যায়, রবীন্দ্রনাথ সঠিকভাবে প্রকাশিত ছিন্নপত্রের প্রায় প্রতিটি পত্রে। কোনো কৃত্রিমতা নয়, একেবারে খাঁটি ও সরলভাবে রবীন্দ্র মানসের প্রতিচ্ছবি ধরা পড়েছে ছিন্নপত্রে। তাই রবীন্দ্র মানসকে বোঝার ক্ষেত্রে ছিন্নপত্রের অবদান অনেক। কারণ এই পত্র সংকলনেই তাঁর নির্ভেজাল আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল—এ বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই।