সোভিয়েত ইউনিয়নের বিস্ময়কর প্রগতির পিছনে সে দেশের গৃহীত পরিকল্পনার মূল সূত্রগুলি নির্দেশ করো। প্রাথমিকভাবে সেখানে সাফল্য এলেও, কোন জায়গায় অঙ্ক মেলেনি? কৃষির ক্ষেত্রে সেখানে প্রধান দুটি ভুল কী হয়েছিল বলে লেখক মনে করেন, তা বিশদভাবে বুঝিয়ে দাও।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, খ্যাতিনামা অধ্যাপক ও সমালোচক ড. অশোক মিত্র তাঁর ‘ভারতের কৃষিসমস্যা ও আমরা' প্রবন্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিস্ময়কর প্রগতির বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। বিষয়ের আলোচনা করতে গিয়ে প্রথমেই ধনবিজ্ঞানের একটি সাধারণ সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করছেন। সিদ্ধান্তটি হল—বিনিময়ের সঙ্গে আর্থিক উন্নতির সম্পর্কে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। বিনিময় বাড়ালে আর্থিক উন্নতি বাড়বেই। আর্থিক উন্নতির ক্ষেত্রে রাশিয়া কয়েকটি সূত্র মেনে চলেছে—

  • প্রথমত–বিনিয়োগ বাড়ানো।

  • দ্বিতীয়ত—বিনিয়োগের বৃহৎ অংশ যন্ত্রপাতি নির্মাণে ব্যয় করা।

  • তৃতীয়ত—ভোগ্যপণ্য উৎপাদন নিয়ন্ত্রিত করা।


সোভিয়েত ইউনিয়নের আশ্চর্য উন্নতির কারণ হল সেই দেশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাগুলির একেবারে সূচনা থেকেই বিনিয়োগের হার যথাসম্ভব বাড়িয়ে চলেছিল। ঠিক করে নিয়েছিল বিনিয়োগের সাহায্যে যে যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য উৎপাদন উপকরণ তৈরি হবে, তার সবগুলিকে ভোগ্যপণ্য উৎপাদনে নিয়োগ না করে, তার একটা বড়ো অংশকে আরও যন্ত্রপাতি তৈরি করার জন্য ব্যবহার করবে। তাহলে কয়েক বছরের মধ্যে কলকারখানা যন্ত্র বিদ্যুতে সারা দেশে ছেয়ে যাবে। এই যন্ত্র, বিদ্যুৎ ও পরিবহনের সাহায্যে দ্রুত উৎপাদন বাড়িয়ে ফেলবে। সে বুঝেছিল প্রথমদিকে কৃচ্ছসাধন করলে অন্তিমে ভালো ফল পাওয়া যাবেই।


ভবিষ্যতের কথা না ভেবে নতুন নতুন যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য উপকরণ বৃদ্ধির দিকে নজর না দিলে বিপদ ঘনিয়ে আসবে। যন্ত্র এবং অন্যবিধ সরঞ্জাম যদি না বাড়ানো হয় তাহলে উৎপাদন একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবে। কিন্তু লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করে জনসাধারণের মধ্যে আরও স্বাচ্ছন্দ্যের বাসনা জাগবে। অথচ খাদ্য পরিধেয় এবং বিলাস ব্যসনের সামগ্রীর উৎপাদন আগের মতোই থাকবে। সুতরাং দুঃখ নিশ্চিন্তভাবেই ঘনিয়ে আসবে। তাই সে স্থির করেছিল ভোগ-বাসনার প্রতি আপাত মনোযোগ না দিয়ে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং বিনিয়োগের বড়ো অংশ প্রতিনিয়ত আরও বেশি যন্ত্র-পরিবহন ও বিদ্যুতের প্রসারে নিয়োগ করতে হবে।


সোভিয়েত রাশিয়া এই সূত্রগুলি উন্নয়নের কাজ করেছে। বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত দেশে প্রতিরক্ষার প্রয়োজন ছিল সর্বাধিক। আর এই প্রয়োজনেই তার ইস্পাত ও কলকারখানার ওপর জোর দেওয়ার দরকার হয়েছিল। তাছাড়া বিনিয়োগের মাত্রা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ভোগ বিলাসের ইচ্ছা সে অনেক পরিমাণে কমিয়ে এনেছিল। এরজন্য সে দুটি পথ অনুসরণ করেছিল—প্রথমত, বিদেশ থেকে ভোগ্যপণ্য আমদানি একেবারে বন্ধ করে দিয়েছিল। যা সম্ভব হয়েছিল বহির্বাণিজ্যকে রাষ্ট্রায়ত্ত করার ফলে। দ্বিতীয়ত, দেশের মধ্যে ভোগ্যপণ্য উৎপাদনে নিযুক্ত হতে পারে এমন সব যন্ত্রপাতি নির্মাণ ভীষণভাবে কমিয়ে দিয়েছিল। ভোগ্যপণ্য না থাকায় জনসাধারণের তাদের উপার্জিত অর্থ সম্ভোগে ব্যয় করতে পারেনি। ফলে সেই অর্থ সঞ্চিত হয়েছে আরও সঞ্চিত অর্থ বিনিয়োগে নিয়োজিত হয়েছে।


সোভিয়েত রাশিয়া প্রথম দিকে কৃচ্ছসাধনার ফল পেলেও একটি ক্ষেত্রে সে ব্যর্থ হয়েছে, তা হল কৃষিক্ষেত্র। অবাক হতে হয় যে, সোভিয়েত রাশিয়ার সামগ্রিক উৎপাদন বিগত পঁয়ত্রিশ বছরে যেখানে কুড়িগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে সেখানে কৃষি উৎপাদন দ্বিগুণও হয়নি। কৃষিতে যে উৎপাদন বেড়েছে তার সবটাই নতুন জমি আবাদ করে, জমির গড় উৎপাদন বাড়িয়ে নয়। ফলে সোভিয়েট রাশিয়ার আর্থিক উন্নতির হার দ্রুত কমে গেছে।


কৃষিতে সোভিয়েতের ব্যর্থতা : কৃষি উন্নয়নের ক্ষেত্রে সোভিয়েট রাশিয়ার ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে লেখক দুটি মারাত্মক ভুল লক্ষ্য করেছেন।


প্রথম ভুল : যে পরিমাণ অর্থ কৃষিক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা উচিত ছিল, তা করা হয়নি। প্রতিরক্ষা ও শিল্পখাতের তুলনা কৃষিখাতের বরাদ্দ ছিল কম। আবার কৃষি উৎপাদনে যে অর্থ বরাদ্দ করা হল তারও সুষম বণ্টন হয়নি। ফসলের উৎপাদন বাড়াতে বিদ্যুৎ ও ট্রাক্টরের পাশাপাশি রাসায়নিক সার, উন্নত বীজ, কীটনাশক ঔষধেরও একান্ত প্রয়োজন। এইসব উপকরণগুলির সমন্বয়ের মাধ্যমেই কৃষি উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। রাশিয়ার তৎকালীন শাসনকর্তারা এই সহজ সত্যটি বুঝতে পারেননি। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ট্রাক্টর তৈরিতে যত টাকা ব্যয় করা হয়েছিল তার সামান্য অংশও সার, কীটনাশক তৈরিতে ব্যয় করা হয়নি। উন্নত মানের বীজের ব্যাপারেও অবহেলা লক্ষ করা গেছে। ক্রুশ্চভ ক্ষমতায় আসার আগে পর্যন্ত কৃষির ব্যাপারে চিন্তাভাবনা ছিল সামঞ্জস্যহীন। কৃষিক্ষেত্রে কম অর্থ বিনিয়োগ একটা বিরাট সমস্যার সৃষ্টি করেছিল।


দ্বিতীয় ভুল : শিল্প উৎপাদনের সঙ্গে বিরাট পার্থক্য আছে তা সঠিকভাবে অনুধাবন না করা। কলকারখানা স্থাপনের একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। যিনি কারখানা স্থাপন করবেন তাঁকে প্রথমে মূলধন জোগাড় করতে হয়। সেই মূলধনে যন্ত্র বসান, কাঁচামালের ব্যবস্থা করেন। শ্রমিকরা পয়সার বিনিময়ে খাটে এবং পণ্য উৎপাদন করে। ধনতান্ত্রিক কিংবা সমাজতান্ত্রিক উভয় দেশের শিল্প উৎপাদনের প্রক্রিয়াটি একইরকম। শিল্পের ক্ষেত্রে যন্ত্রে ভূমিকা দিনের পর দিন বাড়ছে এবং শিল্প উৎপাদনের প্রক্রিয়াও সহজ হয়ে আসছে। বৃহৎ কারখানাগুলির সুষ্ঠু পরিকল্পনার ব্যবস্থা করতে পারলেই পণ্য উৎপাদন যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে।


কৃষির ক্ষেত্রে বিষয়টি এত সহজ নয়। কৃষির বিস্তার সমগ্র দেশ তথা হাজার হাজার গ্রাম জুড়ে। এই সব গ্রামের লক্ষ লক্ষ কৃষিজীবী মানুষকে একই মন্ত্রে দীক্ষিত করতে পারলে তবেই কৃষিতে উৎপাদন বাড়বে। অন্যথায় উৎপাদনে সাফল্য অর্জন অসম্ভব। অতএব প্রত্যেক চাষিকে সচেতন করতে হবে, চাষিদের একে অপরের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগের ব্যবস্থা করতে হবে।


সোভিয়েত ইউনিয়ন কৃষকদের মানসিকতা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারেনি। তাঁর ধারণা ছিল জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হওয়ায় চাষিরা রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধিতে আত্মনিয়োগ করবে। জমি ব্যক্তিগত হলে প্রবল উদ্যমে চাষি সেই জমিতে ফসল ফলাবার চেষ্টা করে কিন্তু জমি রাষ্ট্রায়ত্ত হওয়ায় এবং রাষ্ট্রের সাক্ষাৎ তত্ত্বাবধানে চাষের ব্যবস্থা হওয়ায় চাষির মোহ বা আকর্ষণ কমতে থাকে। জমি রাষ্ট্রের হলেও তারও অধিকার আছে এই বিষয়টি সুনিশ্চিত করতে সোভিয়েট ইউনিয়নে সুদীর্ঘ সময় কেটে গেছে, ফলে উৎপাদন স্বাভাবিকভাবেই কমে গেছে। তাছাড়া চাষিদের নিজেদের মধ্যে মনের আদান প্রদান দীর্ঘকাল বন্ধ ছিল। এক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের একটা ভূমিকা ছিল। কিন্তু তারা সর্বজ্ঞ নন, কোনো গ্রামে কীসের অভাব নির্ভুলভাবে তা জানা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া সব গ্রামেই সেইসময় কমিউনিস্ট পার্টির সমান প্রভাব ছিল না। ফলে গ্রামের প্রয়োজন এবং কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের মধ্যে প্রায়ই পার্থক্য দেখা যেত। অবস্থা এমন হত যে, যে গ্রামে সারের প্রয়োজন সেখানে পৌঁছেছে ট্রাক্টর, আবার যেখানে জলের দরকার সেখানে পৌঁচেছে কীটনাশক। অনিবার্যভাব বহুল পরিমাণে কমে গেছে উৎপাদন। কৃষির ক্ষেত্রে এই ভুলগুলি হয়েছিল বলে লেখক অশোক মিত্র মনে করেন।