ছিন্নপত্র রবীন্দ্রনাথের লুক্কায়িত সাহিত্য বীজ—উক্তিটি ব্যাখ্যা করো | ছিন্নপত্র রবীন্দ্রনাথের প্রেরণাস্বরূপ বলতে কী বোঝ?

ছিন্নপত্রের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সৃষ্টির বীজ কোথায়?

রবীন্দ্রনাথ বিচিত্র প্রতিভার অধিকারী। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক ইত্যাদি সাহিত্য শাখায় তাঁর অনায়াস পরিভ্রমণ। বলা যায় রবীন্দ্রসাহিত্য ব্যাপক এবং বিচিত্র। এই ব্যাপক বিচিত্র সাহিত্য সৃষ্টির পটভূমিতে ছিন্নপত্রের পত্রগুলি উপস্থিত করলে দেখা যায় এই পত্রগুলি রবীন্দ্রনাথ সৃষ্ট গল্প কবিতা উপন্যাসবলির সাহিত্য-বীজ, অর্থাৎ রবীন্দ্র সাহিত্যের প্রেরণা কেন্দ্রে ছিন্নপত্রাবলির নিগূঢ় ভূমিকা রয়েছে। ছিন্নপত্রাবলিতে যা সংকেতাকারে বা বীজরূপে কবির অনুভব ব্যাখ্যাত হয়েছে পরবর্তীকালে তাই-ই নানান কবিতা, গল্প ও উপন্যাসে রসময় সৃষ্টিতে উত্তরিত হয়েছে এবং ছিন্নপত্রাবলির বিশ্লেষণী আলোচনার মাধ্যমে তা কতখানি রবীন্দ্র সাহিত্যের প্রেরণা ভূমি হতে পেরেছে তার আলোচনা করা হল।


রবীন্দ্র কবিতার প্রেরণা হিসাবে ছিন্নপত্রাবলি :

রবীন্দ্রকাব্য জীবনের ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায় সন্ধ্যাসংগীত থেকে মানসী পর্যন্ত কবি তাঁর কবি মানসের পরিচয়কে নির্দিষ্ট করে খুঁজে পাননি—জগৎ ও জীবনের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রচনা করতে না পেরে বিষাদময় আকুলতায় তিনি আচ্ছন্ন হন। 'সোনার তরীতে’ কবি সেই পরিণতি লাভ করেন। এই সময় পদ্মানদীর বুকে বিচরণকালে গ্রামীণ প্রকৃতির উদার—উন্মুক্ত লীলা বৈচিত্র্য এবং জীবনাভিজ্ঞতায় রবীন্দ্র কবি মানস সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। সাধনা পত্রিকায় এই সমৃদ্ধ শিল্পী মানসের সৃষ্টি প্রেরণা পদ্মার বিচিত্র প্রবাহের মতোই রবীন্দ্রনাথের নানা সৃষ্টির মধ্যে আত্মপ্রকাশ লাভ করেছে।


‘সোনার তরী’র শৈশব সন্ধ্যা কবিতাটিতে বৃহত্তর জীবনের যে অবিচ্ছিন্ন প্রবাহমানতার সত্য এবং সৌন্দর্যের উপলব্ধি সূর্যাস্তের আলোয় পদ্মতীরের দৃশ্যের পটভূমিতে অভিষিক্ত হয়েছে, ছিন্নপত্রাবলির ১২৮ সংখ্যক পত্রে তার বিবরণ পাওয়া যায়—


"..অন্ধকারের আবরণের মধ্য দিয়ে এই লোকালয়ের একটি যেন সজীব হৃদস্পন্দন আমার বক্ষের উপর এসে আঘাত করতে লাগল।.... বৃহৎ জনতার সমস্ত ভালো মন্দ সমস্ত সুখ দুঃখ এক হয়ে তরুলতা বেষ্টিত ক্ষুদ্র নদীর দুই তীর থেকে একটি সকরুণ সুন্দর রাগিণীর মতো আমার হৃদয়ে এসে প্রবেশ করতে লাগল। আমার শৈশব সন্ধ্যা কবিতায় বোধ হয় কতকটা এই ভাব প্রকাশ করতে চেষ্টা করেছিলুম।”


ছিন্নপত্রাবলির ৪২ সংখ্যক পত্রে এবং ২৩ সংখ্যক পত্রে যে রোমান্টিক সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়েছে তা, 'সোনার তরী'র ‘নিদ্রিতা' কবিতাটিতে রসাভিব্যক্তি লাভ করেছে। রবীন্দ্রনাথের কাব্য চেতনার একটি বড়ো বৈশিষ্ট্য, হল মর্ত্যপ্রীতি। তাঁর 'বসুন্ধরা' 'সমুদ্রের প্রতি’, ‘অহল্যার প্রতি' ইত্যাদি কবিতায় বৃহৎ ধরণির উপর কবির যে নাড়ির টান অপূর্ব ছন্দ বন্ধে উদ্‌গীত হয়েছে তা ছিন্নপত্রে ১৩, ৭০ এবং ৭৪ সংখ্যক পত্রে প্রাথমিকভাবে মূর্ত হয়েছে। যথা—


“....এ যেন বৃহৎ ধরণির প্রতি একটা নাড়ির টান। এক সময়ে যখন আমি এই পৃথিবীর সঙ্গে এক হয়েছিলুম, যখন আমার উপর সবুজ ঘাস উঠত, শরতের আলো পড়ত, সূর্যকিরণে আমরা সুদূর বিস্তৃত শ্যামল অঙ্গের প্রত্যেক রোমকূপ থেকে যৌবনের সুগন্ধি উত্তাপ উত্থিত হতে থাকত....তখন শরৎ সূর্যালোকে আমার বৃহৎ সর্বাঙ্গের একটি আনন্দরস একটি জীবনীশক্তি.... বৃহৎভাবে সঞ্চারিত হতে থাকত.... আমার এই যে মনের ভাব সে যেন এই প্রতিনিয়ত অঙ্কুরিত, মুকুলিত, পুলকিত সূর্যসনাথা আদিম পৃথিবীর ভাব।” এমনিভাবে দেখা যাবে রবীন্দ্রকাব্য সৃষ্টির উৎস ছিন্নপত্রাবলিতে রয়েছে।


রবীন্দ্র গল্পের প্রেরণা হিসাবে ছিন্নপত্রাবলি :

রবীন্দ্র সাহিত্যে পদ্মা নদীর অমোঘ ভূমিকা রয়েছে। পদ্মানদী কেন্দ্রিক জীবনাভিজ্ঞতার যে বর্ণনা ছিন্নপত্রাবলিতে রয়েছে তা রবীন্দ্র জীবনের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বে গল্পগুলিতে রসময় বিস্তারলাভ করেছে। ছিন্নপত্রের ১০৭ সংখ্যক পত্রে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—


“এক এক সময় মনে হয় আমি ছোটো ছোটো গল্প অনেক লিখতে পারি এবং মন্দ লিখতে পারিনে—লিখবার সময় সুখও পাওয়া যায়।”


রবীন্দ্রনাথের খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন গল্পে পদ্মার যে ভয়ংকর ছবির চিত্র পাওয়া যায় তা ছিন্নপত্রের ১৪১-১৪২ সংখ্যক চিত্রে উক্ত হয়েছে। যথা—


“নদী একেবারে কানায় কানায় ভরে এসেছে। পারটা প্রায় দেখা যায় না। জল এক এক জায়গায় টগবগ করে ফুটছে। আবার এক এক জায়গায় কে যেন স্থির জলকে দুহাত দিয়ে চেপে সমান করে ঠেলে দিয়ে যাচ্ছে"।


ছিন্নপত্রাবলির ২৪নং পত্রে গঙ্গার ঘাটে ছেলে মেয়েদের ক্রিয়া কৌতুকের যে বর্ণনা আছে ‘ছুটি' গল্পের উপাদান রূপতা ব্যবহৃত হয়েছে। বাস্তব জীবনের যে পোস্টমাস্টারকে দেখে রবীন্দ্রনাথ ‘পোস্টমাস্টার' গল্পটি লিখেছিলেন ছিন্নপত্রাবলির ৬২ নং পত্রে তার উল্লেখ পাওয়া যায়। 'অতিথি' গল্পের প্রেরণা কেন্দ্র হয়েছে ২১৬নং পত্রটি। এভাবে বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয় রবীন্দ্র গল্পের প্রেরণা কেন্দ্ররূপে ছিন্নপত্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।


ছিন্নপত্রের প্রেরণা ও রবীন্দ্র উপন্যাস :

কবিতা ও গল্পের মতো রবীন্দ্র উপন্যাসেরও বীজ ছিন্নপত্রের কোথাও কোথাও আছে। এখানে একটি উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটিকে স্পষ্ট করার চেষ্টা করা হল। ছিন্নপত্রের ৪ নং পত্রে ধূ ধূ বালির চরার যে বর্ণনা আছে তা চতুরঙ্গ উপন্যাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও বর্ণনার সঙ্গে মিলে যায়। শচীশ যখন সমস্ত দ্বৈততার বাহিরে গিয়ে অসীমের সাধনায় মগ্ন তখন সে ধূ ধূ বালির চরার মধ্যে অবস্থান করেছে সেখানে গিয়ে গৃহী দামিনী বুঝেছে তার পায়ের তলায় পড়ে আছে একটি ‘না’। চতুরঙ্গ উপন্যাস ও ছিন্নপত্র থেকে পরপর উদাহরণ নিলে দেখি—


১. চতুরঙ্গ : ...পায়ের তলায় কেবল পড়িয়া আছে একটা 'না'। তার না আছে শব্দ, না আছে গতি, তাহাতে না আছে রক্তের লাল, না আছে গাছপালার সবুজ, না আছে আকাশের নীল, না আছে মাটির গেরুয়া। যেন একটা মড়ার মাথার প্রকাণ্ড ওষ্ঠহীন হাসি, যেন দায়হীন তপ্ত আকাশের কাছে বিপুল একটা শুষ্ক জিহ্বা মস্ত একটা কৃথ্বার দরখাস্ত মেলিয়া ধরিয়াছে।


২. ছিন্নপত্র : প্রকাণ্ড চর ধূ ধূ করছে কোথাও শেষ দেখা যায় না। কেবল মাঝে মাঝে এক এক জায়গায় নদীর রেখা দেখা যায়। আবার অনেক সময় নদীকে বালি বলেও ভ্রম হয়। গ্রাম নেই, লোক নেই, তরু নেই, তৃণ নেই বৈচিত্র্যের মধ্যে জায়গায় জায়গায় শুকনো সাদা বালি।


এইভাবে কবিতা-গল্প-উপন্যাস রচনার প্রেক্ষিতে বিচার করলে দেখা যায় ছিন্নপত্র রবীন্দ্র সাহিত্যের বীজভূমি—এমন সিদ্ধান্ত সার্থক।