রবীন্দ্রনাথের মর্ত্যপ্রীতির প্রতিফলন ঘটেছে ছিন্নপত্রের চিঠিতে।— আলোচনা করো।

ভাব কল্পনার সুউচ্চ শিখরলোকে অবস্থান করলেও স্বরূপত রবীন্দ্রনাথ চিরকাল মানুষের সপক্ষে। তার প্রথম ও প্রধানতম অন্বিষ্ট মানুষ। নিসর্গ-মুগ্ধতা যেমন রবীন্দ্রমানসের এক আশৈশব লালিত ধর্ম, মানব-প্রীতিও তেমনি তাঁর স্বভাবগত।


শিলাইদহ, সাজাদপুর, পতিসর—রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির ভুবনের অত্যন্ত উর্বর ক্ষেত্র। বলা যায়, 'ভূতলের স্বর্গ খণ্ডগুলি', অখ্যাত কতকগুলি গ্রাম আর সাধারণ মানুষের ভূতল একালের মহাকবির জন্য অপেক্ষা করছিল। অথচ এখানেই কবি যোগ্য অভ্যর্থনা পেলেন। তিনি সমাদৃত হলেন—আর এখানেই তিনি খুঁজে পেলেন সেই কোনো পুরাতন আদিম প্রাণের ইশারা। 'জীবন্ত হৃদয় মাঝে' তিনি আপনার স্থান স্থায়ী করে নিলেন। এখানকার নদনদী, তার জনপদ মাটির ভাণ্ডে কবিকে অমৃত দান করল। শিলাইদহ, সাজাদপুর কিংবা পতিসরের ভূমি সিঞ্চিত নরনারী রবীন্দ্রনাথের রচনায় অবশ্য কোনো আঞ্চলিক মাত্রা নিয়ে আসে না। বরং মহাবিশ্বে রবীন্দ্রনাথের মনুষ্য চরিত্র সর্বদা বিশ্বজনীন আবেদন বহন করে চলার বাহক হয়। কবির সৃষ্টির বিশেষ প্রেরণা আমরা এরই মধ্যে খুঁজে পাই।


প্রমথ চৌধুরীর 'রায়তের কথা' গ্রন্থের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “আমার জন্মগত পেশা জমিদারি, কিন্তু আমার স্বভাবগত পেশা আসমানদারি। এই কারণেই জমিদারির জমি আঁকড়ে থাকতে আমার অন্তরের প্রবৃত্তি নেই।” শিলাইদহ, সাজাদপুর, পতিসর অঞ্চলে জমিদারি তদারকির জন্য কবি যান। কিন্তু তিনি কেবল খাজনা আদায় করতে যাননি। প্রজাদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশেছিলেন। তিনি তাদের মধ্যে দেখেছিলেন—“ম্লান মুখে লেখা শুধু শত শতাব্দীর বেদনার করুণ কাহিনি।” ইন্দিরা দেবীকে লিখিত ছিন্নপত্রের বেশকিছু চিঠির পরতে পরতে সেই পদ্মাতীরের সরল প্রাণের কথা তিনি তুলে ধরেছেন।


ছিন্নপত্রের একটি চিঠিতে কবি লিখেছেন, “আহা এমন প্ৰজা আমি দেখিনি—এদের অকৃত্রিম ভালোবাসা আমার কাছে এই সমস্ত দুঃখ পীড়িত অটল বিশ্বাসপরায়ণ অনুরক্ত ভক্ত প্রজাদের মুখে এমন একটি কোমল মাধুর্য আছে, এদের দিকে চেয়ে এবং এদের কথা শুনে সত্যি সত্যি বাৎসল্যে আমার হৃদয় বিগলিত হয়ে যায়। বাস্তবিক এরা যেন আমার একটি দেশ জোড়া বৃহৎ পরিবারের লোক”। দরিদ্র প্রজাদের এই সহজ ভক্তি রবীন্দ্রনাথকে মানবতার অমৃত স্পর্শ দান করেছিল।


এদের কথা ভেবে এদেরই জন্য শিক্ষা, চিকিৎসা কৃষিকাজ, রাস্তাঘাট, বিদ্যালয় স্থাপন, সমবায়, বিচারব্যবস্থা প্রভৃতি নানা কর্মকাণ্ড শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ।


রবীন্দ্র সাহিত্যের অনেক বাস্তব চরিত্র ছিন্নপত্রের যুগেই পাওয়া যায়। ‘পুরাতন ভৃত্য’, ‘দুই বিঘা জমি' এবং ‘পলাতকা’, ‘খাপছাড়া', ছড়ার ছবি-র অনেক চরিত্রই রবীন্দ্রনাথের অভিজ্ঞতালব্ধ। ছোটোগল্পের কিছু চরিত্রও বাস্তব। রবীন্দ্রনাথের জমিদারি পর্বে অনেক অখ্যাত বৈশ্বব, বাউল, কবিয়াল, চাষি, গৃহস্থ, পোস্টমাস্টার, ডাকহরকরা তাঁর সাহিত্যে প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে।


‘পুরাতন ভৃত্য' কবিতার ‘কেষ্টা’ চরিত্রটি কাল্পনিক নয়। উমাচরণ, বিপিন, ভোলানাথ প্রমুখ রবীন্দ্রনাথের ভৃত্য ছিল। এদের কেউ একজন কেষ্টা বলে মনে হয়। ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতার ‘বাবু’ আর ‘উপেন’ চরিত্রদ্বয় ও বাস্তব। শিলাইদহের বর্ধিষ্ণু ধনী গুরুচরণ অধিকারীবাবু আর যদু দত্ত উপেন চরিত্রে রূপান্তরিত।


‘অতিথি’ গল্পের নায়ক আসলে একটি যাত্রা দলের ছেলে। নানা দলে সে ভিড়ে যেত। কোথাও স্থায়ী হত না। এরকম একটি বাস্তব চরিত্রই ‘অতিথি’ গল্পের তারাপদ। রবীন্দ্রনাথের ‘বোস্টমী’ গল্পের অন্যতম চরিত্র 'আনন্দী'। এর আসল নাম সর্বখ্যাপী। গেরুয়া শাড়ি পরিহিতা এই বৈশ্ববীকে রবীন্দ্রনাথ দেখেন। শিলাইদহের পোস্ট অফিসের পিয়ন গগন হরকরা বলে চিনে নিতে অসুবিধা হয় না। এমনকি সাজাদপুরের পোস্টমাস্টার মহেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের ‘পোস্টমাস্টার' গল্পের নায়ক চরিত্র। 'ছুটি' গল্পের ফটিক চরিত্রটিও বাস্তব। দ্বারিকাপুরের চক্রবর্তীদের ছেলে হারানচন্দ্রই এই ফটিক। সাজাদপুরের গোপা হালদারের মেয়ে 'সমাপ্তি' গল্পের মৃণ্ময়ী হয়েছে পদ্মাতীরে বাসকালে রবীন্দ্রনাথের এক ভৃত্যের নাম ছিল মোমিন মিঞা। সদ্য কন্যা হারা এই ভৃত্যটির মধ্যে রবীন্দ্রনাথ চিরকালের পিতৃসত্তার পরিচয় পেয়েছিলেন। তাঁর 'কাবুলিওয়ালা'র গল্পের ‘চৈতালী' কাব্যের 'কর্ম' কবিতার প্রেরণা যে এই মোমিন মিঞা এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।


রবীন্দ্রনাথের শেষপর্বে লিখিত গদ্য কবিতায় যে সাধারণ মানুষের কথা বলেছেন, তার সূচনা হয়েছিল 'চৈতালী কাব্যে'। এর প্রত্যক্ষ প্রেরণা বুঝি কবি পেয়েছিলেন শিলাইদহের মাটি ও মানুষ থেকেই।


‘পুনশ্চ' কাব্যে ‘অপরাধী' কবিতায় দুষ্টু টিনু, 'বাসা' কবিতায় কল্পিত সাধারণ গৃহিণী, ‘ছেলেটা' কবিতায় অযত্নে বেড়ে ওঠা দুরন্ত বালকটি, ‘সাধারণ মেয়ে’ কবিতায় এলোকেশী মালতী, ‘বাঁশী' কবিতায় হরিপদ কেরানি, শিলাইদহের পাড়ের অগুন্তি অখ্যাত সাধারণ মানুষের ভিড়ে মিশে থাকে।


পদ্মা তীরবর্তী জনপদের বেসুর ছন্দহীন খাপছাড়া ও নির্জীব জীবন কবিকে ব্যথিত করে তোলে। জীবনের রুগ্নতা তাঁকে পীড়িত করে—“ঘরে ঘরে বাতে ধরেছে, পা ফুলেছে সর্দি হচ্ছে, জ্বরে ধরেছে, পিলেওয়ালা ছেলেরা অবিশ্রাম কাঁদছে, কিছুতেই কেউ তাদের বাঁচাতে পারছে না—এত অবহেলা অস্বাস্থ্য, অসৌন্দর্য, দারিদ্র্য মানুষের বাসস্থানে কি এক মুহূর্ত সহ্য হয়।" (১২১নং পত্র)—তাই তিনি এদের পরিত্রাণের জন্য আপন শক্তিতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। শিলাইদহে এসেই তিনি পৌঁছেছিলেন মানুষের খুব কাছে, মানুষের উন্মু সান্নিধ্য, তাদের অভাব ও আনন্দ তাকে খুব টেনেছিল। মানুষের জন্যই তাই রবীন্দ্রনাথ নিজেকে নানা কাজে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রেখেছিল। ছিন্নপত্রের ধারায় নানাস্থানে তারই স্বীকৃতি পাওয়া যায়।


দরিদ্র অসহায় প্রজাদের অকৃত্রিম সরলতা ও ভক্তির সৌন্দর্য্যই হয়তো রবীন্দ্রনাথকে ক্রমে বিশ্বমানবতাবোধে পাকা করে তুলেছে। তাই ‘প্রভাত সংগীত’ পর্বের রোমান্টিকতা পেরিয়ে 'চিত্রা'-র এবার ‘ফিরাও মোরে' কবিতায় উচ্চারণ করেছেন “......এইসব মূঢ় ম্লান-মূক মুখে, দিতে হবে ভাষা....।”


এই জন্যই মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ তাঁর ঈশ্বরকে মন্দিরের গর্ভে খুঁজে পান না (স্বর্গ হতে বিদায়), ধূলি তলে মলিন অসংখ্য কৃষক ধীবর, তাঁতি, মজুরের মধ্যেই বিকশিত হয় তাঁর নরদেবতা। তাঁর ধর্মবোধ এসে সংযুক্ত হয় মানবতার তীর্থে। তাই তাঁর ধর্ম হয়ে ওঠে মানুষের তীর্থ। ছিন্নপত্রাবলিতেই তিনি লিখেছেন—“আমাদের ভারতবর্ষের সবচেয়ে জীর্ণতম কুটীরের মলিনতম চাষিকে আমি আমাদের আপনার লোক বলে মনে করতে কুণ্ঠিত হবো না" (৮৯ নং পত্র)।


এই দরিদ্রতম মানুষটিকে শেষ পর্যন্ত শ্রদ্ধায় ভালোবাসায় আত্মস্থ করেই বিকশিত রবীন্দ্রনাথের বৃহৎ মানুষের সাধনা, তাঁর অখণ্ড মানবতার সুকঠিন ব্রত। ছিন্নপত্রাবলির মানবরস আসলে এসে মিলেছে মহামানবের মিলনতীর্থে যেখানে—“সেই মানবকেই মানুষ নানা নামে পূজা করেছে। তাকেই বলেছে, এস, দেব বিশ্বকর্মা-মাহাত্ম্য। সকল মানবের ঐক্যর মধ্যে নিজের বিহ্বলতাকে পেরিয়ে তাকে পরে আশা করে তার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা জানিয়েছে—

“স নো বুদ্ধ্যা শুভয়া স দেবঃ সংযুক্ত”।