প্রকৃত সমালোচনা কাকে বলে? বাংলা সাহিত্যে বিভিন্ন শ্রেণির সমালোচনার নাম করো।

সাহিত্যর উৎকর্ষ বা অপকর্ষ নির্ণয়ে বিচারমূলক পদ্ধতিতে যখন তার ভাব, বস্তু, রীতি, অলংকার ও স্রষ্টার বিশিষ্ট মানস দৃষ্টি প্রভৃতির বিষয় যে আলোচনার মধ্যে প্রকাশ পায় তাকে সমালোচনা (Criticism) বলে।


রূপ ও রীতি :

(১) বিশ্লেষণাত্মক পদ্ধতি (Analitical method) : যে কাব্য বিচারে শব্দ চিত্রকল্প বা প্রসাধন কলার আস্বাদনীয় রূপ স্থান পায় তাকে বিশ্লেষণাত্মক পদ্ধতির সমালোচনা বলে। এর মধ্যে সাহিত্যের দোষগুণ পুরোপুরি আত্মপ্রকাশ করতে পারে না, প্রকাশকলাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়।


(২) ঐতিহাসিক পদ্ধতি (Historical method) : যে সমালোচনা যুগচিত্ত, পারিপার্শ্বিক ঘটনা গ্রন্থকারের ব্যক্তি মানস সৃষ্ট সাহিত্যে কতখানি মূর্ত হয়েছে তার বিচার করে, তাকে ঐতিহাসিক পদ্ধতি বলে। যেমন—বিনয় ঘোষের ‘নূতন সাহিত্য সমালোচনা।


(৩) সনাতনবিধি সম্মত পদ্ধতি (Classical method) : বাহ্যিক কতকগুলি সনাতন বা প্রাচীন নিয়মাবলির সাহায্যে সাহিত্যের যে বিচার বিশ্লেষণ করা হয় তাকে সনাতন বিধিসম্মত পদ্ধতি বলে। যেমন- হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘মেঘদূত’।


(8) মনস্তত্ত্বমূলক পদ্ধতি (Psycho-analytical method) : যে সমালোচনা সাহিত্যবিচার গ্রন্থকারের ব্যক্তিগত জীবন এবং তাঁর অবচেতন মনের ছাপ সাহিত্যে কতখানি মূর্ত হয়েছে তার বিচার করে তাকে মনস্তত্ত্বমূলক পদ্ধতি বলে।

ইংরেজি সাহিত্যের Herbert Read এই শ্রেণির সমালোচক বাংলায় বিরল।


(৫) ব্যক্তিগত সমালোচনা (Personal criticism) : যে সমালোচনায় গ্রন্থবিশেষ সমালোচকের নিকট কেমন লেগেছে এই কথাটাই ‘বড়ো হয়ে ওঠে তাকে ব্যক্তিগত সমালোচনা বলে। যেমন—পূর্ণচন্দ্র বসুর 'সাহিত্যে খুন'।


(৬) তত্ত্ব সন্ধানী পদ্ধতি (Philosophical method) : আলোচ্য সাহিত্য বা কাব্য কতখানি সমাজ কল্যাণ সাধন করে বা তার মধ্যে কোনো সত্য নিহিত আছে অথবা তার সৌন্দর্য বা রসতত্ত্বের স্বরূপইবা কী, যে সাহিত্য বিচারে এই সকল তত্ত্বই প্রাধান্য পায় তাকে তত্ত্বসন্ধানী সমালোচনা বলে। যেমন-ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকের সমালোচনা।


রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অজিত চক্রবর্তী এই শ্রেণির অনেক সমালোচনা করেছেন।


(৭) তুলনামূলক পদ্ধতি (Comparative criticism) : দুটি ভিন্ন লেখকের শব্দ সম্পদ বা পক্তি কিংবা রচনা সম্ভার নিয়ে পারস্পরিক তুলনার দ্বারা উভয়ের কৃতিত্ব নিরূপণ করার নামই তুলনামূলক সমালোচনা। যেমন- কালিদাস ও শেকসপিয়রকে নিয়ে আলোচনা, রবীন্দ্রনাথ ও ওয়ার্ডসওয়ার্থের মধ্যে সমালোচনা ইত্যাদি।


(৮) পরিসংখ্যান পদ্ধতি (Statistical method) : এটি অতি সাম্প্রতিককালের পদ্ধতি। লেখকের ব্যক্তিগত জীবন, পারিপার্শ্বিক সমাজ জীবন ও ব্যক্তি প্রতিভার স্বরূপ প্রকাশে যে সাহিত্য সৃষ্ট হয়, তার বিচারকালে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা না করে যদি রেখাচিত্র এবং পরিসংখ্যান-এর সাহায্যে আলোচনা করা হয় তখন তাকে পরিসংখ্যান সমালোচনা বলে। যেমন—ইংরেজি সাহিত্যে এই জাতীয় সমালোচনা সৃষ্টি হলেও বাংলায় এখানও আবির্ভাব ঘটেনি।


(৯) বস্তুনিষ্ট সমালোচনা (Objective method) : যে পদ্ধতি সাহিত্যকে সাহিত্য হিসাবে বিশিষ্ট এবং একক সৃষ্টি কর্ম হিসাবে বিচার করে তাকে বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা বলে। যেমন বাংলা সাহিত্যে এই জাতীয় সমালোচনা অপ্রতুল নয়। লেখকের সৃষ্ট চরিত্রকে নিয়ে সমালোচক তাঁর আলোচনার মধ্য দিয়ে ব্যক্তিগত অভিমত প্রকাশ করেন। বঙ্কিমচন্দ্রের গোবিন্দলাল ভ্রমর কুন্দ প্রভৃতির চরিত্রের সমালোচনা এই গোত্রের।


জীবন সাহিত্য : নবীনচন্দ্রের আমার জীবন/রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি, শিবনাথ শাস্ত্রীর আত্মচরিত/সজনীকান্ত দাসের আত্মস্মৃতি।


ভ্রমণ সাহিত্য : প্রবোধ সান্যালের ‘মহাপ্রস্থানের পথে', অন্নদাশংকর রায়ের ‘পথে প্রবাসে’, শঙ্কুমহারাজের ‘বিগলিত করুণা ও জাহ্নবী যমুনা’। অবধূতের—‘মরুতীর্থ হিংলাজ'।