“পরিহাসের আবরণে সুগভীর তত্ত্ব পরিবেষণই কমলাকান্তের আসল উদ্দেশ্য”— “আমার মন” প্রবন্ধে কমলাকান্তের এই আসল উদ্দেশ্যটি কীরূপে ব্যক্ত হয়েছে তার পরিচয় দাও।

‘আমার মন' প্রবন্ধে কমলাকান্তের সরস বাচনভঙ্গির ভিতর থেকে উৎসাহিত হয়েছে এক সুগম্ভীর জীবনজিজ্ঞাসা। আমরা সকলেই সুখী হতে চাই, কিন্তু দেখা যায় সুখ আমাদের চির অনায়ত্ত। যে বিষয় নিয়ে সুখের সন্ধানে আমরা মনকে নিবিষ্ট করতে চাই দেখা যায় সেখান হতে মন উধাও। ভেগাবাসনা, বিষয়লিপ্সা বহু কিছুতেই তো আমাদের মনকে বেঁধে রাখতে চাই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেঁধে রাখতে পারি না। মন কখন কীভাবে, কার দ্বারা যে সেই বাসনার কারাগার থেকে অপহৃত হয় তা কেই বলতে পারে না। আত্মসুখের বাসনা মনকে চির অনায়ত্ত করে রাখে। তবে মনকে ধরে রাখবার উপায় আছে। সে উপায় হল পরসুখবন্ধনের জন্য আন্তরিক চেষ্টা। পরসুখের জন্য যে ক্ষুদ্র আত্মসুখ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত, শুধু সেই মানসিক সুখশান্তিলাভের অধিকারী। এই সত্য মানুষ যেদিন বুঝবে সেদিন সে ভোগবিলাসের আকর্ষণ ত্যাগ করে পরের সুখবিধানের জন্য চেষ্টিত হবে।


এ সত্য ভারতবাসীর নিকট নূতন নয়। আড়াই হাজার বৎসর পূর্বে শাক্যসিংহ মনুষ্যজাতির উদ্দেশ্যে এই শিক্ষা প্রচার করেছিলেন। তারপর আরও কত মহামানব এই শিক্ষা দিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু তথাপি মানুষের চৈতন্য হয়নি। বর্তমানে ভারতবাসীর মনে যে অশান্তি ও অস্থিরতার লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে তার মূলে আছে পাশ্চাত্যের ভোগবাদী আদর্শের অনুসরণ। পাশ্চাত্যের এই ভোগবাদই আমাদের মানসিক সুখ-শান্তি অপহরণ করেছে। তাই কমলাকান্তের মুখে তীব্র বিদ্রূপ শুনতে পাওয়া যায়—“কী ইংরেজি, কী বাঙ্গালা সংবাদপত্র, সাময়িক পত্র, স্পীচ, ডিবেট, লেকচর যাহা কিছু পড়ি বা শুনি, তাহাতে এই বাহ্যসম্পদ ভিন্ন আর কোনো বিষয়ের কোনো কথা দেখিতে পাই না। হর হর বম বম। বাহ্যসম্পদের পূজা করো। হর হর বম বম। টাকার রাশির উপর টাকা ঢাল। টাকা ভক্তি, টাকা মুক্তি, টাকা মাটি, টাকা গতি! টাকা ধর্ম, টাকা অর্থ, টাকা কাম, টাকা মোক্ষ!.......এ পূজার তাম্রশ্রুধারী ইংরেজ নামে ঋষিগণ পুরোহিত ; এডাম স্মিথ পুরাণ এবং মিল তন্ত্র হইতে এ পূজার মন্ত্র পড়িতে হয় ; এ উৎসবে ইংরেজি সংবাদপত্র সকল ঢাক-ঢোল, বাঙ্গালা সংবাদপত্র কাসিদার, শিক্ষা এবং উৎসাহ ইহাতে নৈবদ্য, এবং হৃদয় ইহাতে ছাগবলি। এ পূজার ফল, ইহলোকে ও পরলোকে অনত্ব নরক।" এই বিদ্রূপের কশাঘাতের দ্বারাই কমলাকান্ত বোঝাতে চেয়েছেন যে এই বাহাসম্পদপূজা, এই ভোগ-বিলাসসর্বস্ব জীবনযাপন মনুষ্যত্বহীনতারই পরিচায়ক। পরের মঙ্গলের কথা চিন্তা করতে না শিখলে, মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা বৃদ্ধি না পেলে সুখশান্তি লাভের আশা দুরাশামাত্র। গার্হস্থ্যজীবনও আমাদের এই আদর্শই অবলম্বন করতে শিক্ষা দেয়। বিবাহ করে যদি সুখি হতে চাও তবে নিজেকে ভুলে আরেকজনকে ভালোবাসতে প্রস্তুত হতে হবে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে কমলাকান্তের আসল রূপটি তত্ত্বজ্ঞ পণ্ডিতের রূপ।