‘প্রবন্ধ’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত ব্যাখ্যায় ‘প্রকৃষ্ট’ ও ‘বন্ধন’ শব্দ দুটির তাৎপর্য বুঝিয়ে দাও। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একটি বিশেষ সংরূপ হিসেবে প্রবন্ধের অবির্ভাবের কারণ এবং তার লক্ষণগুলি নির্দেশ করো।

প্রাচীনকালে প্রবন্ধ শব্দটির অর্থ ছিল 'উপায়' বা 'ব্যবস্থা'। সংস্কৃত ভাষায় ‘প্রবন্ধ শব্দের অর্থ হিসেবে বোঝাতো ‘প্রকৃষ্ট রূপে বন্ধন'। অর্থাৎ ‘প্রবন্ধ' শব্দের উদ্ভব ‘বন্ধ’ ধাতু থেকে। বন্ধ ধাতুর অর্থ ব্যঞ্জন করা। তাই প্রবন্ধে ‘প্রকৃষ্ট ব্যঞ্জন’ বিশেষ ইঙ্গিতবহ, পাশাপাশি ‘নিবন্ধ’ শব্দ নিয়ন্ত্রিতভাবে গ্রথিত করা অর্থে নিযুক্ত। প্রবন্ধ নিবন্ধের সমার্থক শব্দ সন্দর্ভ, ‘দুভ' ধাতু (অর্থ গ্রহণ) থেকে নিষ্পন্ন।


সংস্কৃত সাহিত্যে ‘প্রবন্ধ’ নানা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ছন্দগত বন্ধন, বিষয়বস্তুর সুষ্ঠু সম্বন্ধ রূপ বন্ধন, সর্গ পর্ব অধ্যায়াদির বন্ধন, রচনাক্রমের ধারাবাহিক পারম্পর্যরূপ বন্ধন ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকারের বন্ধন সমন্বিত গদ্য-পদ্য উভয়বিধ রচনাকেই সংস্কৃতে প্রবন্ধ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। বস্তুত রামায়ণ, মহাভারত, মালতী মাধব সব কিছুকেই কাব্য, নাটক ইত্যাদিকে প্রবন্ধরূপে আখ্যাত করা হয়েছে। মধ্যযুগে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, কৃত্তিবাসী রামায়ণ, চণ্ডীমঙ্গল, মনসামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, শিবায়ন, শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত কাশীদাশী মহাভারতে প্রবন্ধ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে প্রবন্ধ শব্দের অর্থ কৌশল বা উপায় বোঝানো হয়েছে। কিন্তু বাংলা গদ্যের আধুনিক যুগে ‘প্রবন্ধ’ একটি বিশিষ্ট সাহিত্যরূপ হিসাবে স্বীকৃত হয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রবন্ধ নিবন্ধ, সন্দর্ভ প্রভৃতি শব্দের ব্যবহার বিশেষ লক্ষণীয়।


প্রবন্ধ যদি কল্পনা, বুদ্ধি ও তথ্যকে অশ্রয় করে গদ্য সাহিত্য হয়ে থাকে, তাহলে এরই উপর নির্ভর করে প্রবন্ধ সম্পর্কিত কয়েকটি লক্ষণ আমরা লিপিবদ্ধ করতে পারি।

  • (ক) প্রবন্ধ শিল্পের স্বাভাবিক মাধ্যম হল গদ্য।

  • (খ) প্রবন্ধ যুক্তি-তর্ক বিচার বিশ্লেষণ ও তথ্যের ব্যবহার হয়ে থাকে।

  • (গ) যৌক্তিক পারম্পর্য তথা বিশ্লেষণী মনোভঙ্গির সঙ্গে কল্পনা ও আবেগের যথাযথ মিলন ঘটে প্রবন্ধে।

  • (ঘ) প্রবন্ধে বিষয় ও উপস্থাপন রীতির বৈচিত্র্য সাধিত হয়।

  • (ঙ) বিতর্কিত বিষয় সম্পর্কে পাঠককে মূল সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সাহায্য করে।

  • (চ) আয়তনের স্বল্পতাই প্রবন্ধের অন্যতম লক্ষণ।