'ছিন্নপত্র' অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথের মানস বৈশিষ্ট্য-র সম্পর্কে পরিচয় দাও।

প্রিয় ভাইঝি শ্রীমতি ইন্দিরা দেবীকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ছিন্নপত্র' সম্বন্ধে একদা লিখেছিলেন—“তোকে আমি যে সব চিঠি লিখেছি তাতে আমার মনের সমস্ত বিচিত্র ভাব যে রকম ব্যক্ত হয়েছে এমন আমার আর অন্য কোনো লেখায় হয়নি। বিশেষ সময়কার বিশ্ব প্রকৃতি, পদ্মার চর এবং আত্মানুভব বিচিত্র তরঙ্গ মালায় সজ্জিত হয়ে প্রকাশ পেয়েছে ছিন্নপত্রের প্রতি পত্রের ছত্রে ছত্রে।" এ কোনো গল্প উপন্যাস নয়, কাব্য কবিতা বা সাহিত্যের ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির কোনো গদ্য রচনা নয়, গোত্র বা জাত হিসাবে ছিন্নপত্র এক অভিনব কবিমনের জীবনকথা। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে লিখিত ১৫৩টি পত্রের সমন্বয়ে ‘ছিন্নপত্রের’ অবয়ব গঠিত। সময় ও স্থান ভিন্ন হলেও প্রত্যেকটি পত্র অপর পত্রের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত। এই সংযোগের সূত্র হিসাবে রয়েছে কবিমন, বিশ্বপ্রকৃতি ও মানব জীবন সম্পর্কের অনুভবের সফল বিচিত্র দ্যোতনা। চিঠিপত্রে মানুষের আত্মানুভবের বিচিত্র অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটে। কবির ব্যক্তিত্ব পারিপার্শ্বিক ঘটনাবৃত্ত সাংসারিক জীবনধারার বিচিত্র অনুভব ও ভাবব্যঞ্জনা ও সম্যক রূপে উপস্থিত হতে পারে। রবীন্দ্রনাথের ‘ছিন্নপত্র’ কেবল কবিমনের অভিব্যক্তি সমৃদ্ধ সৃষ্টি নয়, সমকালীন যুগের বিচিত্র সাহিত্য কর্মের নেপথ্যে ‘ছিন্নপত্রের’ দুর্নিবার উপস্থিতি গ্রন্থটির অশেষ মূল্য নিরূপণে সহায়কও বটে।


রবীন্দ্রনাথ কোনোদিনই তাঁর ব্যক্তিগত জীবনকথার ব্যাপক উল্লেখ পছন্দ করেননি, এমনকি তাঁর জীবনের বহু দুঃখজনক ঘটনাকে অন্তরে গোপন রেখে সাহিত্য শিল্পের আরাধনাময় জগতকে বড়ো করে তুলেছিলেন। আর এই শিল্প জগতের সঙ্গে তাঁর যে নাড়ীর যোগসূত্র অতি অল্প বয়স থেকে রচিত হয়েছিল তারই বিচিত্র অভিব্যক্তি ও অনুভবের প্রকাশ হল ‘ছিন্নপত্রাবলি'। সুতরাং রবীন্দ্রনাথের শিল্পোজনোচিত উপলব্ধির ব্যঞ্জনায় আশ্লিষ্ট বলে গ্রন্থটির স্বতন্ত্র অস্তিত্বকে স্বীকার করতেই হয়। কোনো বিশেষ বিশেষ কাহিনি প্রধান বক্তব্য এ-পত্রে নেই—দু একটা টুকরো টুকরো চিত্র ও ঘটনা সন্নিবেশে প্রকৃতির স্নিগ্ধ কোমল নির্বিকার উদাসীন চলমান রূপের প্রেক্ষাপটে এক ধরনের অনুভূতিময় জগৎ আবিষ্কার করেছেন পত্রকার। কাহিনি, ঘটনা, ইতিহাস, প্রকৃতি, মানব জীবনের নানান দৃশ্যপট কোনোটাই এখানেই স্বতন্ত্র সত্তায় অভিষিক্ত নয়। সাবলীল ও স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিমায় কেবলমাত্র খণ্ড খণ্ড দৃশ্যের অবতারণা করা হয়েছে। আত্মদৃষ্টিভঙ্গির আলোয় আমরা জগৎ ও জীবনকে প্রত্যক্ষ করি। রবীন্দ্রনাথও জীবন জিজ্ঞাসার ক্রমিক পর্বে প্রকৃতি ও মানব জীবন থেকে তাঁর আত্মদর্শনের উপকরণ সংগ্রহ করে নিয়েছিলেন। তাই ‘ছিন্নপত্র' কেবল কয়েকটি ছেঁড়া পাতা নয়, রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য কর্মের উপযুক্ত প্রেক্ষিতরূপে বিদ্যমান।


প্রকৃতির কাছে প্রথম পাঠ নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ কলকাতা থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে এক স্বচ্ছন্দ জীবনযাপন করতে গিয়ে, বদ্ধজীবন থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন যে ব্যস্ত জগতে, তার উচ্ছ্বাস ব্যক্ত হয়েছে তাঁর প্রথম দিকে লেখা প্রায় প্রত্যেক চিঠিতে। নাগরিক পৃথিবী নয়, গ্রাম্য যে জগৎ তিনি আবিষ্কার করলেন সেই পৃথিবীকেই তিনি অচিরেই ভালোবেসে ফেললেন, এবং ভালো যে বেসেছেন তা গোপন না করেই লিখলেন—“ওই যে মস্ত পৃথিবীটা চুপ করে পড়ে রয়েছে, ওটাকে এমন ভালোবাসি—ওর এই গাছপালা নদীমাঠ কোলাহল নিস্তব্ধতা প্রভাত সন্ধ্যা সমস্তটা সুদ্ধ দু'হাতে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছা করে।" (১৮) এই তন্ময়তা বিমুগ্ধতার মধ্যেই নিহিত ছিল নানান ছোটোগল্প উপন্যাসের বীজ। সেই সঙ্গে পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের তৎকালীন মানসিকতা ও ছোটোগল্প রচনায় তাঁর আন্তরিক উৎসাহের পরিচয়। সাজাদপুর থেকে লেখা একটি চিঠিতে সেকথা তিনি সশ্রদ্ধ চিত্তে স্বীকারও করেছেন : “আমি বাস্তবিক ভেবে পাইনে কোনটা আমার আসল কাজ, এক এক সময় মনে হয়, আমি ছোটো ছোটো গল্প অনেক লিখতে পারি এবং মন্দ লিখতে পারিনে—লেখবার সময় সুখও পাওয়া যায়।" (১২)


রবীন্দ্রনাথের প্রত্যয় ছিল—“আমি যদি জন্ম নিতেম কালিদাসের কালে–দৈবে হতেম দশম, রত্ন নবরত্নের ভালে।" তাই বলে কালিদাসের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা কম ছিল না। কালিদাসের রচনার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় আবাল্য, তাই পরবর্তীকালে রবীন্দ্র রচনায় কালিদাসের প্রভাব পড়েছে। মেঘদূত কাব্য নিয়ে তিনি একাধিক কবিতা ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন। জীবনস্মৃতি গ্রন্থেও উল্লেখিত হয়েছে—এমনকি ‘ছিন্নপত্র’ও বাদ যায়নি। কালিদাসকে স্মরণ করে শিলাইদহ থেকে তিনি লিখছেন—'মেঘদূত লেখার পর থেকে আষাঢ়ের প্রথম দিনটা একটা বিশেষ চিহ্নিত দিন হয়ে গেছে আমার পক্ষে। (৫২) কালিদাসের এই 'মেঘদূত' কাব্যই রবীন্দ্রনাথের সমগ্র মনোজগৎকে আলোড়িত করেছিল, মানুষের মন যে এক বিচিত্র, রহস্যের উৎস, যা মানুষকে শুধু অস্থির করে তোলে তাই নয়, তার আচরণকে অনেক সময় যুক্তি গ্রাহ্যতার বাইরে এনে দেয় দিশাহীন করে দেয় রবীন্দ্রনাথ তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে তা পত্রের মধ্যে সন্নিবেশ করে দেন : “মনে হয় কিছুই না জেনে আমি এক একটা প্রকাণ্ড কাণ্ড সর্বদাই স্কন্ধে বহন করে নিয়ে বেড়াই, আয়ত্ত্ব করতে পারেনি অথচ এর হাতও কিছুতেই এড়াতে পারেনি।” (১০২) তাঁর মন নামক প্রবন্ধেও ওই একই কথা ধ্বনিত হয়েছে।


একদা রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে লিখেছিলেন—“আবার যদি ইচ্ছা করো আবার আসি ফিরে....” মনে করিয়ে দেয় পরবর্তী কবি জীবনানন্দের সেই অমর উক্তি—“আবার আসিব ফিরে ধান সিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়।" এমন অভিব্যক্তি ‘ছিন্নপত্র' গ্রন্থেও পরিলক্ষিত হয়— “আমি প্রায় রোজই মনে করি, এই তারাময় আকাশের নীচে আবার কি কখনো জন্মগ্রহণ করবো ?" (৮৪)। সেই জন্মগ্রহণ যে অন্য কোথাও নয়, এমন এক গ্রামবাংলার পরিচিত ও ভালোলাগা পরিবেশে হলেই ভালো—তা তিনি পত্র মধ্যে স্পষ্ট করেছেন। হৃদয়ের এই দাবিই, আশা, আকাঙ্ক্ষা ছিন্নপত্রের ছত্রে ছত্রে প্রকটিত। নিজের ক্ষণকালের সত্তা থেকে মুক্ত হয়ে চিরকালের আমির অনুভূতিই লাভ করলেই সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে নিজের অভিন্নতা স্থাপিত হয়ে যায় এবং তখন সমস্ত বসুধা এবং সৃষ্টি জগতই নিজের বলে মনে হয়। সজীব মনের বিস্ময় বোধ কতখানি তীব্র ছিল, জাগতিক ও মহাজাগতিক সব কিছুর উপর তিনি হৃদয়ের অধিকার কতটুকু বিস্তার করতে পারতেন একটি পত্রে তার দৃষ্টান্ত মেলে “আজকাল আমার সান্ধ্য ভ্রমণের একমাত্র সঙ্গীটির অভাব হয়েছে। সেটি আর কেউ নয়, আমাদের শুক্ল পক্ষের চাঁদ (১০১) ।" আসলে এই অনুভবেই সারা বিশ্বচরাচর জীবন্ত হয়ে ওঠে, সে জীবনের পরিপূরক হয়ে পড়ে এবং কবির অধিকারের জগতের ব্যাপ্তি দেখে আমরা পুলকিত ও সতর্কিত হই।


বিশ্বকবির জবানীতেই পাই, নিজেকে জানার পালা কোনো দিনই ফুরাবে না। প্রকৃতির মুক্ত অঙ্গনে নিজেকে ছড়িয়ে দেবার পর ক্ষণে ক্ষণে তাঁর মনে অনাস্বাদিত পূর্ব রোমাঞ্চ, সঠিক অনুধাবন করতে না পারা এক ব্যথা কিংবা প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে হঠাৎ জেগে ওঠা অকারণ পুলক এই কথাই প্রমাণ করে। ছিন্নপত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রবীন্দ্রনাথের এই উপলব্ধির অভিব্যক্ত হয়ে উঠেছে। তবে যে-কোনো বিচ্ছেদই যে রবীন্দ্রনাথকে পীড়া দেয়, পত্রের অন্তরঙ্গ কথনে সেকথা তিনি বার বার বলেছেন— এইসব বিচ্ছেদের সূত্রে মৃত্যুর কথাও তাঁর মনে পড়েছে। লেখনীর মধ্যে মৃত্যুর উল্লেখ করেছেন বারবার। অবশ্য এ দেখে তা মৃত্যু চেতনা বলে আখ্যাত না করাই শ্রেয়। কারণ, যৌবনে সঙ্গত কারণেই, মৃত্যু সম্বন্ধে ছিল তাঁর এক রোমান্টিক দৃষ্টিভঙ্গি। তাই তিনি ভানুসিংহের পদাবলিতে লিখতে পেরেছিলেন—“মরণরে, তুঁহু মম শ্যাম সমান।” একটি পত্রে এর স্বরূপ ব্যক্ত করতে তিনি লিখেছেন : “এক একটা বিচ্ছেদ এবং এক একটা মৃত্যুর সময় মানুষ সহসা জানতে পারে এই ব্যথাটা কী ভয়ংকর সত্য।... কেউ থাকে না—এবং সেইটে মনে করলে মানুষ আরও ব্যাকুল হয়ে ওঠে। কেবল যে থাকবে না তা নয়, কারও মনেও থাকবনা (৩০)।" এই ধরনের চিন্তা থেকে কবি অবশ্য উত্তরকালে মুক্তি পেয়েছিলেন। মৃত্যু মানে যে সম্পূর্ণ বিলুপ্তি নয়, পরিপূর্ণ শেষ নয়—এই চেতনায় উপনীত হয়ে যে সান্ত্বনা তিনি পরে পেয়েছিলেন, এখানে সেই আশ্রয় নেই বলেই বেদনা এত তীব্র।


শিলাইদহ-সাজাদপুর-পাতিসরের প্রকৃতি ও মানব জীবন দর্শনে কবির যে আত্মানুভবের জন্ম হয়েছিল তারই প্রকাশ আছে সমকালীন গল্পে কবিতায় প্রবন্ধে। কিন্তু ছিন্নপত্রে কেবল নির্দিষ্ট সময়সীমায় শিল্পকর্মের মধ্যে প্রভাব ফেলেছিল তা নয়, সমগ্র রবীন্দ্র জীবন দর্শনে তা প্রেরণার উৎসরূপে বিবেচিত হয়েছিল। উত্তরকালে সমগ্র রচনা ধারায় ছিন্নপত্রের প্রচ্ছন্ন প্রভাব দেখা যায়, অধ্যাপক প্রমথনাথ বিশী এ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন–“মানব ও কবির জমিদারি ও আসমানদারী সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচয় বহন করছে ছিন্নপত্রাবলি গ্রন্থখানি।” এই পরিচয়ই হল ছিন্নপত্রাবলির ঐশ্বর্য। অধ্যাপক বুদ্ধদেব বসু জানিয়েছেন : “গল্পগুচ্ছ, আর তার যমজ বই ছিন্নপত্র, রবীন্দ্রনাথের গদ্য বইয়ের মধ্যে এই দুটির আমি নাম করবো যা অসংখ্যবার পড়েও পুরনো হয় না।” এই চির নতুন থাকার মূল কারণ হল রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক মানস বৈশিষ্ট্য যা খণ্ড ছিন্ন অসংলগ্ন অথচ চিত্তাকর্ষক রূপেই এই ছোটো ছোটো পত্রের মধ্যে দিয়ে ব্যক্ত হয়ে উঠেছে।