“চিনে কী হচ্ছে না হচ্ছে তার হদিশ রাখা”— ভারতবর্ষের পক্ষে প্রয়োজন কেন? আমাদের সমস্ত ব্যবস্থার মধ্যে ফাঁকি কোথায় এবং পরীক্ষা নিরীক্ষা সফল করার কাজে লেখক কীভাবে আমাদের উদ্যোগী হতে বলেছেন? লেখকের বক্তব্যে তাঁর অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার মিলন কতটা ঘটেছে, সে বিষয়ে তোমার অভিমত দাও।

অর্থনীতিবিদ শ্রী অশোক মিত্র ‘কৃষি সমস্যা ও আমরা' প্রবন্ধে চিনের কৃষি ব্যবস্থাকে ভারতের কৃষকদের দেখতে বলছে। সোভিয়েত রাশিয়াতে কৃষি ব্যবস্থার প্রচুর উলোট পালোট হয়েছে এবং এর ফলে তাদের বিশাল ফল ভোগ করতে হয়েছে। যেমন যেখানে সার পৌঁছানো দরকার সেখানে পৌঁছেছে একটা ঝকঝকে ট্রাক্টর, যেখানে সেচের জল দরকার সেখানে হয়তো পৌঁছেছে সার। এই গরমিল হওয়ার জন্য সোভিয়েত রাশিয়াতে একটু বেশি পরিমাণ উৎপাদন ব্যহত হয়েছে। কিন্তু চিন দেশ সোভিয়েত দেশের অভিজ্ঞতা থেকে ঠকে গিয়েছে। “কৃষি উৎপাদনে সোভিয়েত অসাফল্যের দৃষ্টান্ত চিনেদের সাবধানতা শিখিয়েছে।” তারা বুঝেছে যে কেবলমাত্র বিদ্যুৎ-পরিবহন-যন্ত্রের প্রসারের দিকে নজর দিলে চলবে না, চাই কৃষিক্ষেত্রে বিনিয়োগের হার বৃদ্ধি। “নইলে সোভিয়েট দেশের দশা হবে।” যেহেতু চিন দেশের সঙ্গে ভারতের কৃষি সমস্যার সাদৃশ্য বেশি তাই তারা চিনেদের কৃষি ব্যবস্থার দিকে বেশি করে নজর দিয়েছিল, চিন দেশের কৃষি সমস্যা ভারতের মতো। এই সমস্যা ‘পুঞ্জ পুঞ্জ সমস্যা'। শিল্প-বিদ্যুৎ-পরিবহনের অভাব। কৃষিক্ষেত্রে জরা জীর্ণতা, জনসংখ্যা বৃদ্ধির বর্তমান হার এসবই ভারতের মতো চিনেও বর্তমান। চিনের সঙ্গে ভারতের কৃষি সমস্যার মিল হল পাঁচলক্ষ গ্রামে ছড়ানো পঁয়ত্রিশ কোটি কৃষকের মানসিক সহযোগিতার প্রশ্ন। এঁদের সকলকে বুঝতে হবে, “কৃষি উৎপাদন স্রোতস্বিনী না হলে আমাদেরও মুক্তির আশা পরাহত।” তাই কৃষি সমস্যার জন্য যদি চিন ও ভারত এগিয়ে যায় এবং চিনের আদব কায়দা ভারত শেখে তাহলে ভারতের কৃষি ব্যবস্থার উন্নতি হবে।


আলোচ্য প্রবন্ধে লেখক বহু সিন্ধান্তকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। নতুন নতুন সিদ্ধান্তকে রদবদল করে অভিজ্ঞতার কষ্টি পাথরে যাচাই করে তবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রথমত, ভারত সম্পর্কে লেখকের নির্মহ দৃষ্টি ভারতের আর্থিক প্রগতির ধীরগতিকে সাহায্য করেছে। এ বিষয়ে মন্তব্য করতে দ্বিধাহীন। এইসব অভিজ্ঞতাকে লেখক তত্ত্বগতভাবে দেখেননি, দেখেছেন অভিজ্ঞতা লম্বসত্য হিসাবে। তবে লেখক মনে করেন, আমাদের কৃষিসমস্যার মূলে কোথাও ফাঁকি আছে। গ্রামোন্নয়ন গঠন প্রণালীতে হয়তো কোনো অবহেলা প্রবেশ করেছে। এমন হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে, প্রাপ্ত সাহায্য বা অনুদান সব অর্ধপথে লক্ষভ্রষ্ট হচ্ছে। তৃতীয় যে শক্তির হাতে গিয়ে এসব অনুদান পড়ছে তারা হয়তো গ্রামের মহাজন বা উচ্চবৃত্ত শ্রেণি। সমাজ বা গ্রামে এখনও শ্রেণিবিন্যাস বহুবিধ, নানা সমস্যা দিয়ে ঘেরা এই সমাজ। শ্রেণিভেদে ও বর্ণভেদে চিহ্নিত এই সমাজে এখনও দুর্নীতি ও অনাচার যথেষ্ঠ পরিমাণে আছে। সমাজতন্ত্রের ধুয়ো যেমন উঠেছে, তেমনি বিত্তবানদের সমৃদ্ধ করার সুযোগ সমপরিমাণে বাড়ছে। এছাড়া সোনার কাঠি-রুপোর কাঠির এই কৃষি সম্পদ। কিন্তু এই সোনার কাঠি-রুপোর কাঠি ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তাই পরিকল্পনার ব্যর্থতাও বার বার ঘটছে আর এই জন্যই উদ্বেগ। উদ্বেগ থেকে আসে আত্মবিশ্বাসে বিশ্লেষণ। আত্ম বিশ্লেষণের পথে গেলেই তবে কৃষি সমস্যার মূল ব্যাপারটা প্রণিধান করা যাবে। অবশ্য এ কথা সত্য যে রাষ্ট্রের তরফ থেকে গত বারো-তেরো বছরে অন্তত তিনহাজার কোটি টাকা কৃষি সম্প্রসারণে বিনিয়োগ করা হয়েছে। এই বিনিয়োগ এসেছে অকৃষিদের কাছ থেকে কোনোরকম কর চাপানো হয়নি। ভূমি সংস্কার অল্প স্থাপন হয়েছে। কিন্তু তাতে বড়ো বড়ো রাজা মহারাজের হয়তো অসুবিধে হয়েছে, কিন্তু ভূ-স্বামীদের অসুবিধে হয়নি। রাষ্ট্র কিন্তু নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। যেমন সেচের জল বাড়ানো, উন্নত বীজ শস্য সংগ্রহ, উৎকৃষ্টসার পৌঁছনো এসব হরেক রকম ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবুও কৃষকদের মন ভরছে না।


এই মন ভরার সাথে সাথে পরিশ্রমের সঙ্গে তাদের মনে অতৃপ্তিও বাড়ছে। এই অতৃপ্তি ও অসন্তোষ নিয়ে কখনও উৎপাদন কর্মের মতো মহৎ যজ্ঞে অংশগ্রহণ করা যায় না, এর ফলে গ্রাম জীবনে হতাশা নেমে এসেছে। অধিকাংশ কৃষকের অভাব অসন্তোষের ভিত্তিতে নতুন পৃথিবী গড়া যাবে না। সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার মানুষের প্রগতি কৃষকের মুক্তির ওপর নির্ভরশীল, ভারতের পক্ষে অনুন্নত দেশের পক্ষেও এই একই শিক্ষা। “অধিকাংশ কৃষকের অভাব অসন্তোষের ভিত্তিতে নতুন পৃথিবী গড়া সম্ভব নয়। উৎপাদনে উদ্দাম বন্যার ঢল এ অবস্থায় নামবার নয়। গণতন্ত্রের ছায়ায় যে সমস্ত পরীক্ষা আমাদের দেশে চলছে তাকে সফল করতে হলে তাই ভিন্ন গতিতে কৃষি সমস্যার উৎসের সন্ধানে যেতে হবে। নিরপেক্ষ তুলাদণ্ড নিয়ে বিচার করে দেখতে হবে কোথায় স্খলন পতন ঘটেছে। কোথায় কোন ধরনের উন্নতি সম্ভব।" কৃষি সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে ভারত চিনের পথে যদি অগ্রসর হয়, তবেই হয়তো মুক্তি, এই বিশ্বাস লেখকের আন্তরিক।


লেখকের বক্তব্যে পাওয়া যায় যে সোভিয়েত রাশিয়ার থেকে চিন শিক্ষা নিয়ে কৃষিকার্যের ক্ষেত্রে যে মহৎ কার্য করেছে তার দান অপরিসীম, সোভিয়েত যদি আগে থেকে না ঠকতো তাহলে চিনের কৃষি ব্যবস্থা এত উন্নত হত না। আর চিনের কৃষি ব্যবস্থা উন্নত না হলে আমাদেরও কৃষি ব্যবস্থায় সমস্যা থেকে যেত কারণ চিনের সঙ্গে আমাদের কৃষি ব্যবস্থার মিল অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাই নিজ অভিমত হল লেখকের অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা অপরিসীম।