কমলাকান্তের ‘আমার মন' রচনাটিতে কমলাকান্তের আত্ম-উপলব্ধির যে পরিচয় পরিস্ফুট তা আলোচনা করো | ‘আমার মন' প্রবন্ধ বিশ্লেষণ করে বঙ্কিমচন্দ্রের দার্শনিক উপলব্ধির স্বরূপ বিশ্লেষণ করো।

বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের দপ্তর' তাঁর জীবন দর্শন কিংবা বলা যেতে পারে আত্মকথন। সামাজিক জীবনে ও ভক্তি জীবনে একান্তভাবে বঙ্কিমচন্দ্র নিজের মধ্যে কোথায় যেন এক গভীর শূন্যতা এবং নিঃসঙ্গতার বেদনা মাধুরীতে আত্মলীন হয়ে পড়েছেন। তাঁর মধ্যে একটি আবেগ ও ভাব প্রবণতা স্বতঃস্ফূর্ত প্রবাহ সৃষ্টি করেছে। কমলাকান্তের অনেক গুণের মধ্যে একটি হল মানুষকে তিনি কত রূপেই না দেখতে পান। সেই কারণে তিনি রূপকের আশ্রয় নিয়েছেন। যে কথা সরাসরি বলতে গেলে বঙ্কিমচন্দ্রেরই শিল্পরীতি একটি ঋজু ভঙ্গি প্রকাশ হয়ে পড়তো সেই কথাটাই তিনি সংসার অনাসক্ত, অন্তরে সন্ন্যাসীর মতো এক আফিমখোর গরিব ব্রাক্ষ্মণ কমলাকান্তের মুখ দিয়ে বেমালুম অন্তরের কথা প্রকাশ করেছেন। এই রূপকের আশ্রয় গ্রহণ করার মধ্যে বক্তা নিজের এক নিরপেক্ষ কার্যকারণ সূত্র বিধৃত গভীর আত্ম-প্রত্যয়ে মগ্ন হবার সুযোগ পান। সত্যের খাতিরে সত্যকে হালকা বা গভীর আন্তরিকতার সঙ্গে প্রকাশ করে ব্যক্তিত্বের একটি সুস্পষ্ট পদচিহ্ন এঁকেছেন। তার মধ্যে খণ্ডকাল-অখণ্ড সত্তায় প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। সাময়িকতা শাশ্বতকালকে দীর্ঘ করে বিশেষ প্রেরণা নির্বিশেষ অনুপ্রেরণায় অভিব্যক্ত হয়। সমকালের পাঠক চিরকালের পাঠকে দীক্ষা লাভ করে। কমলাকান্ত সেই অগ্নি পরীক্ষিত মানব জীবন সত্যের চিরন্তন জিজ্ঞাসার ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।


‘আমার মন’ রচনাটিতে সূত্রপাতে একটি ঘরোয়া পরিবেশ তৈরি হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র এখানে যেন একেবারে মজলিসে মানুষ হয়ে উঠেছেন। হাসি ঠাট্টার রসিকতা একটি প্রসন্ন কৌতুক-রসোজ্জ্বল ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে। মনে হয়েছিল এই সর্বজনীন হাসির পার্লামেন্টে সমস্ত পাঠকের নির্বিশেষে যোগদান করবার ন্যায়সঙ্গত গণতান্ত্রিক অধিকার আছে। সেই অধিকার আমাদের অতি সাবধানে বক্তার সহযোগী হয়ে পলকে পলকে অর্জন করে দিতে হয়। রামকৃষ্ণদেব বলেছিলেন—“মানুষের মন কুকুরের ল্যাজ।" অর্থাৎ মন বড়ো বিচিত্র ও অস্থির। মনের চরিত্র এক প্রকার সৈরিনী। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন—“মন বলে যে একপ্রকার জিনিস আছে, কেই-ই বা তারে জানে? কেই বা তারে নিচ্ছে, কেই বা তারে দিচ্ছে ?” মনকে নিয়ন্ত্রণ যারা করেন তাদের নাকি বলে মুনি। ম'ন যাদের আছে তাকে বলে মানুষ। এ দুয়ের তফাৎ আছে। তবুও মানুষ মন দিয়ে বেসাতি করতে ভালোবাসে। বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্ত মনের সন্ধানে তার মন চোরাকে খুঁজতে বেরিয়েছেন, কিন্তু চোর যে কে তা তিনি ধরতে পারেননি। পৃথিবীতে মানুষ যেমন বিচিত্র রূপের তার মনও তেমনি রহস্যময় হয়ে ওঠে তার কারণ মনটাই বিচিত্র ও রহস্যময় বলেই মানুষের মধ্যে দুটি উপাদান আছে, একটি তার পশুত্ব, অপরটি তার মনুষ্যত্ব। পশুত্বকে বাদ দিয়ে যেমন মানুষ হয় না, তেমনি পশুত্বকে অতিক্রম করতে না পারলেও সে মানুষ হবে না।


মন যখন পৃথুলতার, স্থূলতার দিকে একটু বেশি ঝুঁকে পড়ে তখন সে একটু বেশি অসামাজিক হয়ে পড়ে। তখন তার ষড়রিপু তাঁর মনের দখলদার হয়ে যায়। সেই কারণে কমলাকান্ত শুরুতেই মনকে খুঁজতে বেরিয়েছেন, ষড়রিপুর একটির মধ্যে পাকশালের সুগন্ধি ভোজ্য বস্তুর, প্রসন্নর গোয়ালিনীর আগড়ের পাশে কখনও বা কলসকক্ষে গতিশীল যুবতীর পশ্চাতে কিন্তু এ মন তো কমলাকান্তের কাম্য নয়। এমন নিতান্ত স্থল সাধারণ মানুষের। এর মধ্যে ক্রান্ত দার্শনিকতার বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই। এ মন মানুষকে কেবলই ভোগের মধ্যে আবদ্ধ করে। মনুষ্যত্বের উদ্বোধন ঘটাতে সাহায্য করে না। কমলাকান্ত এই গণতান্ত্রিক চেতনার প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হয়েও অসাধারণ মনের। সে ব্যক্তিত্ব হারিয়ে ব্যক্তিকে খুঁজতে বেরোয় না। সেই কারণে এই রচনাটির মধ্যে একটা নাটকীয় গতি আছে। গভীর একটি অজানা কৌতুহলের তীব্র আকর্ষণ আছে, সঙ্গে সঙ্গে আছে এক অসাধারণ দর্শনমুখী কাব্যিক ব্যঞ্জনা। সহজেই বুঝতে পারি মন নামক পদার্থটি কোনো সংকীর্ণ সূত্রে বাঁধা পড়তে চায় না। সংসার মন চায়, মনের মালিক মানুষেরও চায়, কিন্তু মন সংসারকে কতখানি গ্রহণ করবে এবং কেমনভাবে গ্রহণ করবে তার উপরেই নির্ধারিত হয় মনুষ্যত্বের মাপকাঠি।


সাধারণের বিশ্বাস অর্থ সম্পদ স্ত্রী-পুত্র নিয়েই বোধ হয় মনের সুখ। সেই কারণে সুখের পশ্চাতে মানুষের ধারণা আজও শেষ হয়নি। সুখটা রিলেটিভ। শাস্ত্রে বলেছে, “অল্পে সুখম অস্তি, ভূমের সুমন।” অল্পে সুখ নেই ভূমাতেই সুখ। সে সুখ আধ্যাত্মিক, ইংরেজ আমাদের আধ্যাত্মিকতার দেশ ভারতবর্ষে বাহ্য সম্পদের জয়গানে তুফান তুলেছিল। ভারতবর্ষে তারাই প্রথম বাহ্য সম্পদকে ঈশ্বরের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। ইংরেজ শুধু আমাদের দেশকে পরাধীন করেনি, আমাদের মনকেও পরাধীন করেছিল। আমরা হঠাৎ ইংরেজমুখী হয়ে উঠলাম, ভুলে গেলাম বেদ উপনিষদের ত্যাগ ধর্মের কথা। গৌতম বুদ্ধের অসাধারণ সম্পদ অনাশক্তির কথা, আমাদের কাছে টাকাই ধৰ্ম, টাকাই মন, টাকাই ভক্তি, টাকাই মুক্তি, টাকাই গতি ইত্যাদি।


কমলাকান্ত ভারতবর্ষের এই অধঃপতনে আর্তনাদ করে উঠেছে। চিৎকার করে সে বাহ্য সম্পদকে আবাহন করেছে। এ আবাহনই বিসর্জনেরই সাড়ম্বর রূপ। আমরা বুঝতে পারি কী অসহ্য যন্ত্রণায় আত্মীক মরণের এই সময়টিকে তিনি উন্মাদের মতো চিৎকার করে বিশ্ববাসীকে শুনিয়ে দিয়ে নিজেকেই যেন একরকম অসহায় ভাবে হালকা করবার চেষ্টা করেছেন—“টাকার ঝঝনানিতে ভারতবর্ষ পুরিয়া যাউক। মন ! মন আবার কী ? টাকা ছাড়া মন কী ? টাকা ছাড়া আমাদের মন নাই: ট্যাঁকশালে আমাদের মন ভাঙে গড়ে। টাকাই বাহ্যিক সম্পদ।" এই রকম ব্যক্রোক্তি একমাত্র বঙ্কিমচন্দ্র ঘোষের। এ কমলাকান্তের মুখেই শোভা পায়। যে কমলাকান্ত সংসার পাতেনি, ঘর বাধেনি, চাকরির নামে কারোর দাসত্ব করেনি। টাকা পয়সা সে ফকিরদের বিলিয়ে দেয়। তাঁর আত্মশক্তি, এই দুর্জয় প্রবণতা ঘোষণা করবার বিধিসঙ্গত অধিকার অবশ্যই আছে। কমলাকান্তের কান্না, কমলাকান্তের বেদনার্ত জিজ্ঞাসা পৃথিবীর তাবৎ অর্থলোভী মানুষের কাছে। এই বাহ্য সম্পদে কজন অভদ্র ভদ্র হয়েছে, অশিষ্ট শিষ্ট হয়েছে, অধার্মিক ধার্মিক হয়েছে, অপবিত্র হয়ে পবিত্র ? কমলাকান্তের মনে হয়েছে একজন মানুষও এই বাহা সম্পদে মনুষ্যত্বকে অর্জন করতে পারেননি, বরং জমানো মনুষ্যত্ব কিছু পরিমাণে খুইয়ে বসেছে।


সেই দেউলিয়া মনুষ্যত্বের প্রশস্ত অঙ্গনে দাঁড়িয়ে কমলাকান্ত তাই অস্বাভাবিক কণ্ঠে এত জোরের সঙ্গে চিৎকার করতে পেরেছেন। বাহ্য সম্পদ উদর পূর্তি করতে পারে, কিন্তু মনের অসীম আকাশকে ছুঁতে পারে না, মনকে জানতে গেলে মনের পর্যায়ে মনকে উন্নীত করতে হয়, তবে মনের মান থাকে। মনকে নামিয়ে ছোটো করে মনের নাগাল না পেয়ে মনুষ্যত্বকে স্পর্শ করবার স্পর্ধা দেখানোটা এক ধরনের বিকৃত মস্তিষ্কের লক্ষণ। বঙ্কিমচন্দ্র ঊনিশ শতকের NEO HUMANISM-এর একজন শ্রেষ্ঠ প্রবক্তা দার্শনিক Cornt-এর Positivism এবং বেথামের Utilitirianism (হিতবাদ) এ সাক্ষাৎ শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন তিনি। ফলে কোনো ইন্দ্রিয় পরিতৃপ্তিকর সুখ ব্যষণ বৈভব বঙ্কিমের মনে বিন্দুমাত্র অনুশীলিত রূপ নিতে পারেনি। একটি দেশ একটি জাতি যখন এমনি করে জড়পদার্থের পশ্চাতে ধাবিত হয়, তখন সে মৃত্যুরূপী মরীচিকারই শিকার হয়। তাই পরের জন্য আত্মবিসর্জন ব্যতীত পৃথিবীতে স্থায়ী সুখ নেই। মনের স্থায়ী সুখ নির্ভর করে মনুষ্যজাতীর প্রতিকারে সম্যক উদারতার প্রদর্শনের ওপর। আত্ম সুখ বৃদ্ধির জন্য মনুষ্যত্ব বৃদ্ধি পায় না, অপরের কল্যাণ অপরের শুভবুদ্ধি জাগ্রত করার জন্য নিজের শুভবুদ্ধি ও কল্পনাবোধকে অনুপ্রাণীত করতে হয়—প্রাচীন ভারতবর্ষ এই শিক্ষাই দিয়েছে। কমলাকান্ত ইউরোপীয় বিদ্যায় বিশরদ হলেও ভারতীয় মর্মবাণীর সে চিরন্তন সন্তান। ‘শাক্য সিংহ বুদ্ধ’ রাজার দুলাল হয়েও মানুষের কল্যাণে ছিন্ন কথা নিয়ে একদিন মানুষের মাঝে ভিক্ষু সন্ন্যাসী হয়ে রইলেন।


আমার মন হচ্ছে কমলাকান্তের মন, হয়তো বঙ্কিমচন্দ্রের মন। সেই কারণে আর পাঁচজন মানুষের মনের সঙ্গে তাঁর মনের জাগ্রত স্বপ্ন এক বিন্দুতে নিশ্চয়ই মিলিত হবে না, কিন্তু কমলাকান্ত আমাদের যেন বোঝাতে চেয়েছেন, তার মনটাই আসল মন। এ মনের স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষা এবং চাহিদার উচ্চমানের। ফলে কমলাকান্ত চায় সকলেই এমন মনের অধিকারী হয়ে উঠুক। ভালোবাসার শিউলি গন্ধে পৃথিবী মন ভরে উঠুক। মনুষ্যত্বের সুরভিতের প্রত্যেকের মন হয়ে উঠুক সাধক। বিবাহ বন্ধন শুধু সংসারের হাল ধরা কিংবা পুত্রমুখ নিরীক্ষণের মন নয়, মানুষের মাঝখানে একটি বিশ্বজননী প্রীতি, দক্ষিণা মলয় বাতাস রয়ে যায় তবে তা সমগ্র পৃথিবীর মঙ্গল।


তাই কমলাকান্ত বড়ো করুণ সুরে যে কথাগুলো বলেছে বোঝা যায় এর প্রতিটি শব্দগুলি তার অশ্রুজলের বিন্দু। বাইরে কেবল রসিকতার হিমেল ছোঁয়া—"তোমরা এত কল করিতেছ মনুষ্যে মনুষ্যে প্রণয় বৃদ্ধির জন্য একটা কিছু কল, হয়না?" পৃথিবী ব্যাপী শিল্প বিপ্লবের মহাজয় বণিক বৃদ্ধির কারসাজিতে বাহ্য সম্পদ বৃদ্ধির কলকারখানা তৈরি হয়েছে। কিন্তু আত্মিক সম্পদ বৃদ্ধির জন্য কোনো শিল্পবিপ্লব হয়নি, হবেও না। কমলাকান্ত আগামী দিনে এক অন্ধকার ভবিষ্যৎ এবং ক্ষীণ আশার নক্ষত্র আলোক একই সঙ্গে দর্শন করেছেন। আসলে দেহের তৃপ্তির জন্যই ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তির জন্য বিজ্ঞান অনেক সুখের আয়োজন করবে কিন্তু কমলাকান্তের তথা মানুষের মনের সুখের জন্য কোনো বিজ্ঞানী আজ সচেষ্ট হয়নি, আগামী দিনে হবে কিনা তারও নিশ্চয়তা নেই। এরই জন্য কমলাকান্ত বড়ো মর্মাহত হয়ে ‘আমার মন'-এর অবতারণা করেছেন।