কমলাকান্ত চক্রবর্তী কে? তিনি বিড়ালের নিকট হইতে সমাজতন্ত্রের মূলতত্ত্ব কীরূপে শিক্ষালাভ করেছিলেন ? বিড়ালের বক্তব্যের উত্তরে তিনি কী বলেছিলেন ? 'বিড়াল' প্রবন্ধ অবলম্বনে আলোচনা করো।

“বিড়ালকে বুঝান দায় হইল। যে বিচারক বা নৈয়ায়িক, কস্মিকালে কেহ তাহাকে কিছু বুঝাইতে পারে না। এ মার্জার সুবিচারক, এবং সুতার্কিকও বটে ; সুতরাং না বুঝিবার পক্ষে ইহার অধিকার আছে।”—কে এই উক্তি করেছেন? এবং কোন প্রসঙ্গে বলেছেন?— আলোচনা করো।


‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর নায়ক কমলাকান্ত চক্রবর্তী আফিমসেবী দরিদ্র ব্রাক্ষ্মণ। একমাত্র আফিম ছাড়া অন্য কোনো জিনিসের প্রতি তাঁর কোনো আকর্ষণ নেই। আফিমের প্রভাবে তিনি দিব্যদৃষ্টি ও দিব্যকর্ণের অধিকারী হন। সাধারণ লোক যা দেখতে পায় না ও কানে শুনতে পায় না, আফিম খেলে কমলাকান্তের পক্ষে তা দর্শন ও শ্রবণ সম্ভব হয়। শ্রীভীষ্মদেব খাশনবীশ কমলাকান্ত সম্পর্কে নিম্নরূপ বর্ণনা দিয়েছেন, “অনেকে কমলাকান্তকে পাগল বলিত। সে কখন কী বলিত, কী করিত, তাহার স্থিরতা ছিল না। লেখাপড়া না জানিত, এমত নহে। কিছু ইংরেজি, কিছু সংস্কৃত জানিত ! কিন্তু যে বিদ্যায় অর্থোপার্জন হইল না, সে বিদ্যা কি বিদ্যা ? আসল কথা এই সাহেবসুবোর কাছে যাওয়া আসা চাই। কত বড়ো বড়ো মূর্খ, কেবল নাম দস্তখত করিতে পারে—তাহারা তালুক মুলুক করিল–আমার মতে তাহারাই পণ্ডিত। আর কমলাকান্তের মতো বিদ্যান, যারা কেবল কতকগুলি বই পড়েছে, তারা আমার মতে গণ্ডমূর্খ।” ইহা কমলাকান্তের বহিরঙ্গ রূপ। কমলাকান্তের প্রকৃত পরিচয় অন রূপ। তিনি জীবন ও জগতের নিরপেক্ষ দর্শক। অর্ধোন্মাদের ছদ্মবেশে তিনি জগৎ ও জীবনের বিচিত্র লীলারহস্য পর্যবেক্ষণ করে এর মধ্যস্থিত ত্রুটি অসংগতির দিকটি লঘু কৌতুকের সুরে প্রকাশ করেছেন। আপাতদৃষ্টিতে তাঁর বক্তব্য খেয়ালি মনের কল্পনা-উচ্ছ্বাস মনে হলেও একটু চিন্তূ করলেই তাঁর আবেগের তীব্রতা ও অনুভূতির গভীরতা উপলব্ধি করা যায়।


আলোচ্য 'বিড়াল' প্রবন্ধের মাধ্যমে কমলাকান্ত লঘুসুরে ধনী-দরিদ্রের সামাজিক অসাম্যের বিষয়টি অবলম্বন করে বিড়ালের সহিত যে কাল্পনিক বিতর্ক-সংলাপ সৃষ্টি করেছেন, তার মধ্য দিয়ে পৃথিবীর একটি প্রধান সমস্যার মূল কারণে উপর আলোকপাত করা হয়েছে। সমাজতন্ত্রের মূলতত্ত্ব বুঝাবার জন্য কমলাকান্ত কোনোরূপ পাণ্ডিত্যপূর্ণ বিচার বিশ্লেষণের আশ্রয় গ্রহণ করেননি। সামান্য ছোটো একটি নিরীহ বিড়ালের মুখ দিয়ে সমাজতন্ত্রবাদের মূলতত্ত্ব বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কমলাকান্তকে ধনী সম্প্রদায় ও বিড়ালকে দরিদ্র সম্প্রদায় প্রতিনিধি করে পৃথিবীর চিরন্তন সমাজসমস্যার যে আলোচনা করা হয়েছে, তা বাস্তবিক চিত্তাকর্ষক। কমলাকান্তের জন্য রক্ষিত দুধ একটি ছোটো বিড়াল খেয়ে ফেললে কমলাকান্ত তাকে প্রহার করতে উদ্যত হয়েছিলেন। এর জবাবে বিড়াল যে সকল প্রশ্ন করেছে, তাতেই ধনী-দরিদ্রের সামাজিক বৈষম্যের বিষয়টি সুন্দরভাবে পরিস্ফুট।


আহার সামগ্রী প্রস্তুত হতে কিঞ্চিৎ বিলম্ব আছে। কমলাকান্ত চক্রবর্তী রাত্রে চারপায়ার উপর শুয়ে হুঁকাহস্তে অর্ধসুপ্ত অবস্থায় চিন্তা করছিলেন, তিনি যদি কমলাকান্ত না হয়ে নেপোলিয়ান হতেন, তবে ওয়াটার্লু যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারতেন কিনা। এমন সময় নিকটে শব্দ হল 'মেও'। কমলাকান্ত ভাবলেন যে ডিউক অব ওয়েলিংটন বোধহয় বিড়ালত্ব প্রাপ্ত হয়ে আফিম ভিক্ষা করতে এসেছে। আবার শব্দ হল 'মেও'। কমলাকান্ত এবার চক্ষু খুলে একটি ক্ষুদ্র বিড়ালকে দেখতে পেলেন। বিড়ালটি প্রসন্ন গোয়ালিনী প্রদত্ত দুধ পান করে পরম তৃপ্তিতে কমলাকান্তের প্রতি প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপে ডাকছে। পাছে বিড়াল কাপুরুষ ভাবে, এই ভয়ে কমলাকান্ত বহু খুঁজে একটি লাঠি সংগ্রহ করে বিড়ালের প্রতি ধাবিত হলেন। বিড়াল বিশেষ ভীত না হয়ে শুধু এক পাশে সরে বসল। কমলাকান্ত নিজ শয্যায় ফিরে এসে ‘আফিমের কল্যাণে বিড়ালের 'মেও' ডাকের তাৎপর্য স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারলেন।


বিড়ালটি তার ‘মেও' ডাকের মধ্য দিয়ে যেন একথাই বলতে চেয়েছে, দুধপান করবার মতো সামান্য একটি কার্যের জন্য এইরূপ হৈ চৈ মারামারি করে বিশেষ কোনো লাভ নেই। সংসারে ক্ষীর, সর, দুধ, দই প্রভৃতি ভালো ভালো জিনিসের উপর শুধু মানুষের অধিকার থাকবে না, বিড়ালের থাকবে, এটা অত্যন্ত অন্যায় বিচার। মানুষের যেমন ক্ষুধা পিপাসা আছে, বিড়ালেরও তেমনি ক্ষুধা আছে একথা মানুষ বুঝতে পারে না কেন ? মনুষ্যসমাজে বিদ্যালয়ে পঠন-পাঠনের ফল দিন দিন যেরূপ হচ্ছে তাতে তিনি নিশ্চয় এতদিনে বুঝতে পেরেছেন যে অধুনা চতুষ্পদ বিজ্ঞ জন্তুর নিকট উপদেশ গ্রহণ করা ছাড়া মানুষের অন্য কোনো উপায় নেই। সুতরাং কমলাকান্ত যেন তার নিকট হতে নিবিষ্টমনে এখন উপদেশ শোনেন। তার প্রথম উপদেশ, সে দুধ খেয়েছে বটে, কিন্তু এর মাধ্যমে কলাকান্তকেই পরোপকারে সাহায্য করেছে। পরোপকার মানুষের শ্রেষ্ঠ ধর্ম। এই ধর্মলাভে সে কমলাকান্তকে সাহায্য করেছে।


বিড়াল আরও বলল যে সে চুরি করে দুধ খেয়েছে সত্য, কিন্তু নিজের ইচ্ছায় এ কাজ করেনি। খেতে না পেয়ে সে চুরি করেছে। প্রচুর পরিমাণে খেতে পেলে সে কখনও দুধ চুরি করত না। এ সংসারে যাহারা বড়ো বড়ো সাধু বলে পরিচিত, তারা চোর অপেক্ষাও অধার্মিক। তারা ধনসম্পদ সঞ্চয় করে, কিন্তু তার সামান্য অংশও গরিব লোককে দেয় না। অভাবের তাড়নায় বাধ্য হয়েই গরিব লোক চুরি করে। সুতরাং চুরির মূল কারণ এইসব তথাকথিত সাধু। চুরির জন্য এদেরই দণ্ড দেওয়া উচিত। সামান্য একটু খাবারের সন্ধানে বিড়াল প্রাচীরে প্রাচীরে করুণ আর্তনাদ করে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু আর্তনাদই সার। তার প্রতি কেউ সামান্যতম দয়া প্রদর্শনও করে না। করবে কেন? যাদের পেট ভরা, গরিবের জন্য দয়া প্রদর্শন করাকে তারা লজ্জাকর মনে করে। বড়োলোকের জন্য তাদের সকল সহানুভূতি ঝরে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এই দুধ যদি সে না খেয়ে কোনো শিরোমণি বা ন্যায়ালংকার উপাধিধারী লোক খেতেন, তবে তাঁদের জন্য আরও দুধের ব্যবস্থা করা হত। বড়োলোক হলে তাদের ক্ষুধাতৃষ্ণা গরিবের চেয়ে বেশি হবে, এমন কোনো কথা নেই। আসলে তেলা মাথায় তেল দেওয়া মনুষ্যজাতির অভ্যাস। গরিবের জন্য তাদের অন্তরে সামান্যতম সহানুভূতি নেই।


অবশ্য বড়োলোকের পোষা সোহাগের বিড়ালের জন্য স্বতন্ত্র ব্যবস্থা। সোহাগী বিড়ালের প্রচুর আদর যত্ন করা হয়। রাস্তার বিড়ালের দুঃখ-দুর্দশার সীমা থাকে না। খেতে না পেয়ে তাদের উদর কৃশ হয়ে যায়, অস্থি আঙ্গুলে গোনা যায়, লেজ ঝুলে পড়ে, জিহ্বা বের হয়ে পড়ে। তার এরূপ শোচনীয় অবস্থা দেখে কারও দয়া হয় না। চোরের দণ্ড দেওয়ার ব্যবস্থা আছে, কিন্তু নির্দয়ের দণ্ডের ব্যবস্থা নেই। দরিদ্র যদি অভাবের তাড়নায় আহার সংগ্রহ করতে যায়, সেজন্য তাকে দণ্ড পেতে হয়, অথচ ধনী দিনের পর দিন ধনের পাহাড় জমাচ্ছে, সেজন্য সে কোনো দণ্ড পায় না। মানবসমাজে রীতিনীতি অতি বিচিত্র। সুতরাং এ অবস্থায় গরিবের পক্ষে চুরি করা ছাড়া অন্য উপায় নেই।


কমলাকান্ত ভাবিলেন যে বিড়ালের কথাগুলি সমাজতান্ত্রিক। এইসব কথা হতে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। ধনী যদি ইচ্ছানুসারে ধন সঞ্চয় না করতে পারে কিংবা ধন সঞ্জয় করে চোরের জন্য ভোগ না করতে পারে, তবে সমাজের ধনবৃদ্ধি হবে না। ধনবৃদ্ধি না হলে সমাজের মঙ্গল হবে না। বিড়াল বলল যে, সমাজের ধনবৃদ্ধির অন্য নাম ধনীর ধনবৃদ্ধি। এতে গরিবের কোনো মঙ্গল নেই। তখন কমলাকান্ত তাকে বুঝাতে চাইলেন যে ধনীর ধনবৃদ্ধি ছাড়া সমাজের কোনো উন্নতি বা মঙ্গল হবে না। বিড়াল তাঁর বক্তব্য বুঝতে পারল না। গরিবলোক যদি খেতে না পেল, তবে সমাজের উন্নতিতে তার কি লাভ ? কলমকান্ত বুঝতে পারলেন, বিড়ালটির তর্কশাস্ত্রে অধিকার আছে। সুতরাং তর্ক করে একে কিছু বুঝানো যাবে না। তিনি বললেন যে সমাজের উন্নতিতে গরিবের প্রয়োজন না থাকতে পারে, কিন্তু ধনীর আছে। সুতরাং এ অবস্থায় গরিব যদি চুরি করে, তবে তার দণ্ডবিধান করা কর্তব্য।


এর জবাবে বিড়াল বলল, চোরকে দণ্ড কেন, ফাঁসি দিলেও সে আপত্তি করবে না। তবে সেই সঙ্গে একটি নিয়ম করতে হবে যে যিনি বিচারক চোরকে ফাঁসি দিবেন, তাঁকে পূর্বে তিনদিন উপবাস করতে হবে। তাতেও যদি তাঁর চুরি করে খাবার ইচ্ছা না জন্মে, তবে তিনি অনায়াসে দণ্ড দিতে পারবেন।


বিড়ালের কথা শুনে কমলাকান্ত হতবুদ্ধি। তিনি ঠিক করলেন, তর্কে পরাজিত হবার পর গম্ভীরভাবে উপদেশ দেওয়া ভালো। তিনি গম্ভীরভাবে বিড়ালকে বললেন যে, তার এই সব কথা অত্যন্ত নীতিবিরুদ্ধ। এর আলোচনাও পাপ। বিড়াল এইসব কথা চিন্তা না করে ধর্মকর্মে মন দিলে তার আত্মিক উন্নতি হবে। প্রয়োজন হলে তাঁর নিকট হতে নিউম্যান ও পার্কের ধর্মবিষয়ক গ্রন্থ যেন সে নিয়ে যায়। সে এখন নিজের জায়গায় ফিরে যাক এবং কারও খাদ্যদ্রব্য পুনরায় যেন চুরি না করে। বিড়াল বলল যে সে ক্ষুধা অনুসারে কমলাকান্তের কথা বিবেচনা করবে।


বিড়াল চলে গেলে কমলাকান্তের মনে গভীর আনন্দ হল, কারণ তিনি একটি পতিত আত্মাকে অন্ধকার হতে আলোকে আনতে পেরেছেন।