সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বধূ কবিতায় শৈলীবিচার করো।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের পদাতিক কাব্যগ্রন্থের একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা ‘বধূ’। রবীন্দ্রনাথের ‘বধূ' কবিতার অনুসরণে এই কবিতাখানি লেখা। বালিকা বয়সে বিবাহ হলে গ্রাম থেকে ছিন্নমূল হয়ে শহরে আসে সরল এক মেয়ে। গ্রামজীবনের মধুর অভিজ্ঞতা তার স্বপ্নে বিরাজ করে। গ্রামের স্নিগ্ধ স্পর্শ তাকে রোমান্টিক করে তোলে। শহরের ইমারতের ফাঁকে সে স্বপ্ন দেখতে পারে না। শহরে জটিলতার সঙ্গে সে আপন করতে পারে না। নগর জীবনে অবক্ষয় ও মূল্যবোধের অবক্ষয় তাকে স্বপ্নভাবাতুর করে তোলে। জীবনের সমস্ত জটিলতাকে উপেক্ষা করেও সে চাঁদ দেখতে চায়, ছাদের আড়ালে চাঁদকে দেখার চেষ্টা‌ করলে পাওনাদার লাঠি উঁচিয়ে তাগাদা করে। পাওনাদারের ভয়ে স্বামীর পলায়ান তাঁকে তীব্র বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। বধূর তাই এই জীবন ত্যাগ করে মরাটাই ভালো। বীতশ্রদ্ধ হয়ে বধূর মনে হয় ‘আমরা যেন কোনো এককালে একত্র মানসলোকে ছিলাম, সেখান হইতে নির্বাসিত হইয়াছি।


রবীন্দ্রনাথের ‘বধূ’ গ্রাম্য জীবনের সঙ্গে একীভূত, সে সহজ সরল, কোনো জটিলতা তার অন্তরে প্রবেশ করেনি। সুভাষ মুখোপাধ্যায় এই কবিতায় ছিন্নমূল এক বধূর পরিচয় দিলেন যার জীবনে শহর এক মিথ্যাসর্বস্ব, রোমান্টিকতা বর্জিত এক অন্ধকূপে পরিণত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ কবিতাটি সুভাষের হাতে স্বল্প আকার নিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় রবীন্দ্রনাথের ভাষার স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি—


রবীন্দ্রনাথ:

  • ১। হায়রে রাজধানী পাষাণ কারা!

  • ২। হেথায় ওঠে চাঁদ ছাদের 'পরে

  • ৩। দিঘির সেই জল শীতল কালো

  • তাহারি কোলে গিয়ে মরণ ভালো,


সুভাষ: 

  • ১। পাষাণ কারা, হায়রে রাজধানী 

  • ২। ছাদের পারে হেথাও চাঁদ ওঠে

  • ৩। লোকের কোলে মরণ যেন ভালো


যতীন্দ্রমোহন বাগচীও ‘অনূ বধূ’ কবিতায় গ্রাম্যবধূর শহুরে জীবনের ট্র্যাজেডিতে ব্যথিত।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের এই কবিতায় একদিকে গ্রাম্যজীবনের রোমান্টিকতা অন্যদিকে শহুরে জীবনের যন্ত্রণাকে পাশাপাশি এনে বধূর জীবনে শহুরে যন্ত্রণার তীব্রতাকে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।


চারটি অষ্টক ও আটটি স্তবকে কবি যেভাবে তাঁর ভাবনা চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন তা ছকের আকারে দেওয়া যেতে পারে।


ছন্দের পাশাপাশি অলংকারও এ কবিতার প্রাণ। আলোচ্য কবিতায় বক্রোক্তির প্রয়োগ দেখি । যেমন— ‘পাষাণ কারা, হায়রে, রাজধানী' এছাড়াও গ্রাম ও শহর জীবনকে পাশাপাশি এনে বিরোধ সঞ্চারিত করা হয়েছে। গ্রামকেই শ্রেষ্ঠ বলে ‘বধূর’ দৃঢ় সিদ্ধান্ত কবিতাটিকে অন্যমাত্রা দিয়েছে।


অলংকারের পাশাপাশি চিত্রকল্প এ কবিতায় মূল ভিত্তি। গ্রামের চিত্র ও শহরের চিত্র যেন পাশাপাশি উপস্থাপিত করা হয়েছে।

শহরের চিত্র : 

গলির মোড়ে বেলা যে পড়ে এল 

পুরনো সুর ফেরিওয়ালার ডাকে, 

দূরে বেতার বিছায় কোন্ মায়া।

গ্যাসের আলো জ্বালা এ দিন শেষে।


গ্রামের চিত্র : 

সারা দুপুর দিঘির কালো জলে

গভীর বন দুধারে ফেলে ছায়া। 

ছিপে সে-ছায়া মাথায় করো যদি 

পেতেও পারে। কাৎলা মাছ প্রিয়।


এর পরেও আছে কবির অসাধারণ শব্দ যোজনা কৌশল : দিঘির কালো জল, গভীর বন যেমন গ্রাসের ব্যঞ্জনা আছে তেমনি পাষাণ পারা, পেশোয়ারি শহরের যান্ত্রিকতা বহন করে আনে। অর্থাৎ শব্দ যোজনাতেও এসেছে বৈপরীত্য, মোটকথা কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় শিল্পিত মনে যে ছবি এঁকেছেন তা রবীন্দ্রনাথের ‘বধূ’-র নবতম এক পর্যায়। ছন্দ অলংকার বাক্য বিন্যাসের সৌন্দর্যে কবিতাটি রসাত্রাহী হয়েছে।