'কমলাকান্তের দপ্তর'-এ কমলাকান্ত চরিত্রটির পরিকল্পনায় বঙ্কিমচন্দ্রের মানসিকতা ও সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গির যে পরিচয় ফুটে উঠেছে তা উদাহরণ সহযোগে আলোচনা করো।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যে সাহিত্য সম্রাট উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন মূলত তাঁর উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে। এই উপন্যাসে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের মধ্যে বিশেষ করে চরিত্র পরিকল্পনায় তাঁর অনন্যতা প্রকাশ পেয়েছে। যে-কোনো সাহিত্যে চরিত্র সৃষ্টি জাতীয় সাহিত্য কর্মের একটা অঙ্গ বলে বিবেচিত। গল্প, উপন্যাস, নাটক, আখ্যান কাব্যে সর্বত্রই হয়তো কাহিনি একটা গুরুতর ভূমিকা গ্রহণ করেছে তথাপি চরিত্রই হল তাঁর একটা অচ্ছেদ্য অঙ্গ। চরিত্রের দ্বারা কাহিনি নিয়ন্ত্রিত হয়, একে অপরের সঙ্গে মানবিক সম্পর্ক আদান-প্রদানের মধ্যে দিয়ে চরিত্রের কার্যকারিতা ফুটে ওঠে। সেদিক থেকে বিচার করলে, ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এ কমলাকান্ত চরিত্রটিকে কোনো সংজ্ঞা বা কোনো বৈশিষ্ট্যে বিভূষিত করা যায় না। এককথায় কাহিনি নিরপেক্ষ চরিত্র রচনা সাহিত্যের জগতে এক অসম্ভব ঘটনা। কমলাকান্ত সেই অসম্ভব ঘটনাকে বাস্তবায়িত করতে সমর্থ হয়েছে। হয়তো কমলাকান্তের চরিত্রের সঙ্গে একটা সরলার কাহিনি রেখা বিধৃত আছে, তবুও সেটা বাহ্য আবরণ মাত্র। দপ্তরের পরিচয় মেলে এককথায়, এ রচনাগুলি আত্মমুখী, নিজের ভাব আবেগ অনুভূতি, বিদ্বেষ একপ্রকার আত্মকেন্দ্রিক অনুভূতির পাত্র ছাপিয়ে জনসমক্ষে যে আলোড়ন তুলেছিল তার জন্যেই কমলাকান্তের চরিত্রটি গভীরভাবে বিশ্লেষণের দাবি রাখে।


আচার ব্যবহারের দিক থেকে কমলাকান্ত স্বাভাবিক ও সংযত নয়। গ্রন্থের প্রথম থেকেই লক্ষ্য করি, যে পাগলাকে আত্মভোলা, অগোছাল জীবন-যাপনে অভ্যস্থ সর্বোপরি, সংসার বন্ধন মুক্ত। তবে সে বিদ্বান এবং বুদ্ধিমান ছিলেন। কেমন ? খাশনবীশের ভাষায় প্রকাশ পেয়েছে—'কমলাকান্তের মতো বিদ্বান যাহারা কেবল কতকগুলো বই পড়িয়াছে, তাহারা আমার মতে গণ্ড মূর্খ।” কারণ বিদ্বান হওয়া সত্ত্বেও প্রতিপত্তিশীলের মধ্য দিয়ে জীবনে সে দাঁড়াতে পারেনি। সরকারি চাকরিকে সে রসিকতা বলে মানে। সময় ক্ষেত্র শেকসপিয়রের কবিতা বা আদালত চত্বরকে তীব্র ব্যঙ্গের দ্বারা তাদের অসারত্ব প্রমাণ করতে থাকে। এককথায়, আমাদের এই নিয়মনিষ্ঠ সমাজে কমলাকান্তের বোধ বুদ্ধি বিবেচনা বাতুলতা বা প্রলাপের নামান্তর মাত্র। যে ধারাবাহিক বা গণ্ডিবদ্ধ জীবনের মধ্যে অবরুদ্ধ হয়ে আমরা এতদিন বাস করছিলাম কমলাকান্তের তাজা মনে এবং তাঁর ব্যবহারে তা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। মুক্ত বিহঙ্গের মতো পাখা মেলতে কমলাকান্ত সবাইকে পরোক্ষে সে ইঙ্গিত দেন। তাই কমলাকান্তকে বাতুল বা গণ্ডমূর্খ বলেও তাঁরই নির্দেশে আমরা সামাজিক কুসংস্কারের হাত থেকে মুক্ত হতে চাই।


কমলাকান্তের বেহিসেবি জীবন যাপনকে সাধারণ মানুষ হয়তো সশ্রদ্ধ চিত্তে মেনে নেবেন না, কিন্তু তার মধ্যে যে মহত্ব বা প্রতিভা ছিল তাকে তো অস্বীকার বা অবহেলা করার উপায় নেই। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয়—“প্রতিভা খেপামি বইকি, তাহা নিয়মের ব্যতিক্রম, তাহা উলট পালট করিতে আসে তাহা আজিকার এই খাপছাড়া সৃষ্টিছাড়া দিনের মতো হঠাৎ আসিয়া যত কাজের লোকের কাজ নষ্ট করিয়া দিয়া যায়; কেহ তাহাকে গালি পাড়িতে থাকে কেহবা তাহাকেই লইয়া নাচিয়া কুঁদিয়া অস্থির হইয়া ওঠে।”


এ অমৃতবাক্য কমলাকান্তের জীবনে চরম সত্য। গভীর কৌশলে বঙ্কিমচন্দ্র কমলাকান্তকে আফিং ধরিয়েছিল। তাঁর সমস্ত ভাবনা-কল্পনা খেপামি আফিং খোরের দিবা স্বপ্নের মতো। কমলাকান্ত যদি পাগলাটে আর নেশাখোর না হত, সমাজের মুখের ওপর তার অসঙ্গতিকে যে বিদ্রুপবাসে জর্জরিত করেছে, তা তার পক্ষে সম্ভব হত কিনা সন্দেহ। মানব স্বভাবের দুর্বলতা- গুলিকে তিনি একে একে হাসিমুখে সবার সামনে তুলে ধরেছেন এমনভাবে তিনি বাতুল এবং নেশাগ্রস্থ বলেই সম্ভব হয়েছে। তাঁর কৌতুকপূর্ণ ব্যবহারে প্রাণখুলে হাসতে হাসতে আমরা আত্ম-জিজ্ঞাসায় মগ্ন হয়েছি এবং বিবেকের দংশনে চরিত্র শুদ্ধিতে ছটফট করে মরছি।


এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার কমলাকান্তের খেপাটে পাগলা নেশাখোর স্বভাবের মধ্যে সব সময় তাৎপর্য খোঁজা অবাস্তব, প্রাবন্ধিক তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার, উদ্দেশ্যহীন রসিকতা, গভীর জীবন সমালোচনা, অদ্ভুত মানুষের অদ্ভুত আচরণ এই নেশাখোর ভাবনার মধ্যে মিশ্রণ ঘটিয়েছেন, এর ফলে কমলাকান্ত কেবলমাত্র প্রবন্ধের পর্যায়ে এসে থেমে থাকেনি, একটা জীবন্ত মানুষে রূপান্তর লাভ করেছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়—কমলাকান্ত মন হারিয়ে রান্না ঘরে প্রবেশ করলে ভোজন রসে মন আপ্লুত হয়ে উঠেছে অতঃপর সুন্দরীর নারীর পিছু ধাওয়া করেছে নিজেকে নেপোলিয়ান দুধচোর বেড়ালকে ওয়েলিংটন বলে আখ্যাত করেছেন। এ সবের মধ্যে সামাজিক তাৎপর্য খোঁজা অবাস্তব মাত্র। তবে প্রবন্ধ রচনার নিরিখে কয়েকটি চরিত্রের সম্মুখীন আমরা হই, যেমন অনেক স্থলে নসীবাবুর পরিচয় মেলে। পত্রিকা সম্পাদক ভীষ্মদেব খাশনবীশ এবং তার পুত্রের পরিচয় মেলে গোয়ালিনী সবচেয়ে বেশি। যে চরিত্রের পরিচয় আমরা পাই তিনি হলেন প্রসন্ন গোয়ালিনী। প্রসন্নকে আমরা সাতটি প্রবন্ধে পাই এবং ‘আমার মন' শীর্ষক রচনায় তাঁর প্রথম আবির্ভাব। কমলাকান্ত খুব গভীর ভাবে জানিয়েছেন—প্রসন্নের রূপে তিনি মুগ্ধ এবং তাঁর সঙ্গে একপ্রকার হৃদয়ের যোগ আছে। যাকে বলে আত্মীক টান। কমলাকান্তকে বড়াই করে বারে বারে প্রসন্নের রূপের কথা ব্যক্ত করেছেন, তা মূলত কমলাকান্তের দৃষ্টিতে প্রতিভাত, বাস্তবিকই প্রসন্ন গোয়ালিনী রূপের অধিকারী ছিলেন না, তবে এই প্রসন্নকে কেন্দ্র করে তিনি সমাজের কোনো প্রসঙ্গকে ব্যঙ্গের দ্বারা চিহ্নিত করেননি। কেবলমাত্র, মনকে প্রসন্ন রাখার জন্যেই বোধহয় প্রসন্নের অবতারণা।


প্রসন্ন কমলাকান্তের রূপক ভাবনা মাত্র। সমাজ ব্যঙ্গ, আত্মমগ্ন লিরিক। গভীর উপলব্ধির দ্বারা তার চারপাশে একটা পরিমণ্ডল রচনা করেছে। প্রসন্ন এবং তাঁর মঙ্গলা গোরুর দুধ দই ছানার বন্ধনই প্রকৃত জগতের সঙ্গে কমলাকান্তের প্রকৃত বন্ধন। প্রসন্নের সঙ্গে সঙ্গে কমলাকান্তের প্রেম কাব্যরসে এবং গব্যরসের দ্বারা আবৃত। এর কিছু আভাস তাঁর লেখনীতে মেলে—“যখন লিখিতে বসিয়াছি, তখন স্পষ্ট কথা বলা ভালো আমি প্রসন্নের একটু অনুরাগী বটে। তাহার অনেক কারণ আছে—প্রথমত প্রসন্ন যে দুগ্ধ দেয়, তাহা নির্মল এবং দামে সস্তা। সে কখনও ক্ষীর, সর, ননী আমাকে বিনামূল্যে দিয়া যায়,....প্রসন্নের গুণের কথা আর কী বলিব—সে আমার অনুরোধে আফিং ধরিয়াছিল।” এই প্রসন্নই বার বার আফিং-এর দ্বারা আচ্ছন্ন শূন্যে বিচরণকারী কমলাকান্তের মনকে বারে বারে বাস্তবের মাটিতে ফিরিয়ে এনেছেন। তাই প্রসন্নকে বাদ দিয়ে কোনোমতেই কমলাকান্তের অস্তিত্ব টিকে থাকা সম্ভব নয়। কমলাকান্তের পাগলামি, বাতুলতা, নেশাগ্রস্ত জীবনের সঙ্গে সাজুয্য রেখে প্রসন্ন গোয়ালিনী বেশ সমান্তরাল রেখায় আপন অস্তিত্বকে অধিষ্ঠিত করেছে।


কৌতুক এবং বেদনা কমলাকান্তের চরিত্রের দুটি মৌল উপাদান, বঙ্কিমের বিস্ময়কর প্রতিভা আপাত বিরোধী মনোভাবের সমন্বয় সাধনাই হল কমলাকান্তের চরিত্র পরিকল্পনা, বাঙালি জাতীকে জীবনের সঠিক মর্মকে বুঝাতে গিয়ে বাঙালির দুর্দশায় তিনি ব্যথিত, মর্মাহত। সেই ব্যথা এবং দুঃখ প্রকাশের মাধ্যম হিসাবে ব্যঙ্গ ও কৌতুকের আশ্রয় নিয়েছেন। আপন প্রলাপের উৎস সন্ধান দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন—“তোমার এ বঙ্গভূমে জন্মগ্রহণ করিয়া ঘ্যান ঘ্যান করিব না তো কী করিব? বাঙালি হইয়া কে ঘ্যান ঘ্যানানি ছাড়া (বাঙালির মনুষ্যত্ব) এর মধ্যেই আভাসিত ছাঁপোষা বাঙালির স্বভাব বৈশিষ্ট্য।"


আর এক জায়গায় বাঙালির মনুষ্যত্ব হীনতার কথায় গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন—“আমার এক দুঃখ, এক খণ্ডাপ, এক ভরসা আছে, ১২০৩ সাল হইতে দিবস গণি। যেদিন বঙ্গে হিন্দুলোপ পাইয়াছে, সেইদিন হইতে দিন গণি।... কই অনেক দিবসে মনের মানসে বিধি? মিলাইল কই? যাহা চাই তাহা মিলাইল কই? ঐক্য কই? বিদ্যা কই? গৌরব কই? শ্রীহর্ষ কই? ভট্ট নারায়ণ কই? লক্ষ্মণ সেন কই? আর মিলিবে না হায়? সবার ইঙ্গিত মিলে; কমলাকান্তের মিলিবে না?"


কমলাকান্তের এই বেদনা, দুঃখ, খেদ কেবলমাত্র সামাজিক ও ঐতিহাসিক চেতনার দ্বারা আভাসিত নয়, এর অনেকখানি তাঁর একান্ত আত্মগত। এটা হয়তো একেবারেই অকারণ অবাস্তব তবুও যে, তা বন্দানোত্তীর্ণ মানব হৃদয়ের শাশ্বত জিজ্ঞাসার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে সে কথা মানতেই হয়। এ জিজ্ঞাসা কমলাকান্তের, তাই দুখের অধিকার একমাত্র কমলাকান্তের। যদি বাসনার অচরিতার্থতায় এর জন্ম না হয়ে থাকে, তাহলে বাসনাময়ী মনুষ্যত্বের আত্ম-অনুসন্ধানে এর সার্থকতা। কমলাকান্ত অবশ্য মানবপ্রীতি ভেলায় চড়ে এই দুঃখ সাগর অতিক্রম করতে চায়, কিন্তু সে শুধুই সান্ত্বনার ছলে আত্মপ্রতারণা মাত্র। এ রাজ্যের ভেলা কমলাকান্তের প্রত্যাশা অনুগামী সে রাজ্যে কোনোদিন ভিড় বেশি আশা। যেহেতু মানুষের নিত্য সঙ্গী, সেই আশা নিয়ে কমলাকান্তের প্রীতি মন্ত্রে সমাজ সংসারকে দীক্ষিত করতে চেয়েছে যেখানে উন্নততর মনুষ্য সমাজ গঠনের সূত্র লুকিয়ে।


কমলাকান্তের দুঃখ বা বেদনার শেষ নেই, কারণ এসবের যদি শেষ বা সীমানার সন্ধান পাওয়া যেত তাহলে জগতের সৃষ্টিশীল প্রবাহ একেবারেই থেমে যেত। এর মধ্যে কমলাকান্তের যে দর্শন তত্ত্ব প্রকাশ পেয়েছে তা বঙ্কিমের দ্বিতীয় সত্তা উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র অপূর্ব সব চরিত্রের সমাবেশ ঘটানোও সেখানে বঙ্কিমের ব্যক্তিত্ব একেবারেই অনুপস্থিত। কারণ সার্থক সাহিত্য সৃষ্টিতে তিনি নিজেকে একেবারে অন্তরীণে রেখেছিলেন। নিজেকে এই আড়ালে রাখা একপ্রকার আত্মপ্রবঞ্চনার নামান্তর। এর থেকে উত্তীর্ণ হবার জন্য বোধ হয় প্রবন্ধ রচনায় কমলাকান্ত রূপী এক মানুষ পুরুষকে বেছে নিয়েছেন। যার মুখ দিয়ে সর্বদা নিজের কথাকে ব্যক্ত করেছেন, কমলাকান্তের নির্জন একাধিতে প্রগাঢ় সৌন্দর্য কামনায়। জন্মমৃত্যুডোরে বদ্ধ যৌবন-বার্ধক্য বিদ্ধ চিরঅতৃপ্তিতে বঙ্কিমের আসল স্বরূপ উদ্ভাসিত হয়েছে। এখানে বঙ্কিম সমর্থক।