“কি বিপুল অপচয় আমাদের জাতীয় প্রয়াসের"—কোন্ প্রয়াসের কথা বলা হয়েছে এবং অপচয় এড়ানোর উপায় কী? প্রসঙ্গত “বিদ্যায়তনিক চলাচল” কথাটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো। — নালন্দা তক্ষশিলার শিক্ষা দর্শনকে লেখক যে অর্থে ক্ষতিকর ভেবেছেন, তুমি কি তা সমর্থনযোগ্য মনে করো।

প্রাবন্ধিক সত্যেন্দ্রনাথ বসুর ‘শিক্ষা ও বিজ্ঞান' এ এক অনন্য প্রবন্ধ। এখানে তিনি ভারতবর্ষ থেকে বিভিন্ন দেশে বা বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে, কারখানা বা শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলিতে বছর বছর ছাত্র পাঠানোর কথা ব্যক্ত করেছেন। এরা বিদেশে গিয়ে মেকানিক্যাল ও ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যার নানা শাখায় বিশেষ জ্ঞান লাভের জন্য যেত। আর সেখানে তাঁদের ব্যর্থতা লেখকের কাছে ‘বিপুল অপচয়’ বলে মনে হয়েছে। এদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগুলির ফলাফল বিশ্লেষণ করলে আনুপাতিক ব্যর্থতার কথা প্রসঙ্গে এই কথা প্রকাশ করা হয়েছে।


বিদেশে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক শিক্ষা অর্জন করতে গিয়ে যে সমস্যার মুখোমুখি হয়, তা হল প্রাথমিক প্রস্তুতির অভাব প্রাথমিক প্রস্তুতি বা বিধি-নিয়ম আয়ত্ত না থাকলে জ্ঞানের উচ্চস্তরে ওঠা যায় না। লেখক নিজে মনে করেন যে ছাত্র সমাজের মধ্যে মেধা বা উপকরণের অভাব নেই। আর উৎকর্ষের অভাব এই ব্যর্থতার জন্য দায়ী নয়। কিন্তু শিক্ষকদের পরিচালনার ক্ষেত্রে যদি আন্তরিকতা বা কৃতিত্ব না থাকে তাহলে ছাত্রদের মধ্যে এই উৎকর্ষের শ্রীবৃদ্ধি হয় না। এই মৌখিক ত্রুটির জন্য ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য ছাত্র পরীক্ষায় ইপ্সিত ফল লাভে ব্যর্থকাম হয় এবং মানব শক্তির অপচয় ঘটে। দেশের ছাত্র সমাজ দেশের প্রাণশক্তি। এই যুবশক্তি রূপ প্রাণশক্তি যদি জীবনের প্রথম পর্বেই মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, তবে জীবনী শক্তির অপচয় অনিবার্য। এই অপচয় নিবারণ করার জন্য চিন্তাশীল বৈজ্ঞানিক লেখক কয়েকটি প্রস্তাব নিবেদন করেছেন। তার মধ্যে প্রথম প্রস্তাব হল মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাগ্রহণ। এই পদ্ধতি প্রচলিত না হলে ছাত্ররা কখনও বিষয়ের প্রতি একাগ্রতা ও অধিকার লাভ করতে পারবে না। বিষয়কে সঠিক ভাবে না জানার ফলে ছাত্রদের শিক্ষা অপরিণত থেকে যায়। তার ফলে গোড়ায় গলদের জন্যই ছাত্ররা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়। বছর বছর এই অকৃতকার্যতার ঘটনা ঘটলে কোনো জাতি উন্নতির শীর্ষে আরোহণ করতে পারে না। এই কারণে লেখক একে ‘অপচয়' বলে বর্ণনা করেছেন। এই অপচয় সমগ্র জাতিকে পথভ্রষ্ট করে বলে লেখক একে জাতীয় প্রয়াসের অপচয় বলেছেন। লেখক তাই বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন “কী বিপুল অপচয় এই প্রয়াসের" এই উক্তির মধ্যে লেখকের শিক্ষা বিস্তার এক গূঢ় তাৎপর্যই ফুটে উঠেছে।


‘বিদ্যায়তনিক চলাচল’ অর্থাৎ বিরুদ্ধবাদীদের যুক্তি এই যে ইংরাজি ভাষা থাকার ফলে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দান প্রদান সহজ হয়ে উঠবে। অনেকেই মনে করেন যে পরাধীনতার দাসত্বশৃঙ্খল ঘুচে গেলেও ইংরাজি ভাষার স্বর্ণ-শৃঙ্খল এখনও হিতকারী বস্তু, কারণ সংহতির সূত্রটি এখানেই নিহীত। বিদ্যায়তনিক চলাচল, পরিকাঠামো যে পরিকাঠামোয় কিছু ভাষা আছে। এবার যদি ভারতের মধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভাষা চালু হয় তাহলে এই পরিকাঠামো অর্থাৎ 'বিদ্যায়তনিক চলাচল ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে ও আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হবে।


নালন্দা-তক্ষশিলার শিক্ষাদর্শনকে লেখক যে অর্থে ক্ষতিকর ভেবেছেন আমিও ওই মত সমর্থন করি। কারণ এই নালন্দা-তক্ষশিলার মতো শিক্ষাকেন্দ্রে পারলৌকিকতার আদর্শ পোষকতা করা হত। এই আদর্শ ছিল প্রাচীন সংস্কৃতির মেরুদণ্ড স্বরূপ। এর ফলে ব্যক্তি বিশেষের আত্মজ্ঞান লাভ ও পৃথিবীকে ‘দুদিনের পান্থশালা' বলে মনে করা হত। এই জীবন বৈরাগী দর্শন মানুষকে ইহবিমুখ করে তুলত এবং জগত ক্ষণিকের এই প্রকারে মানুষ পার্থিব ব্যাপারে উদাসীন হয়ে পড়ত। ভারতীয়রা এই ব্যাপারেই ক্রমশ জাগতিক ব্যাপারে আধিপত্য হারাল এবং অনতিবিলম্বে পরাস্ত ও পর্যুদস্ত হয়ে গেল বর্বরদের হাতে। ভারতীয়দের এই পরাস্ত কখনো সম্ভব হত না যদি তখনকার দিনে নালন্দা ও তক্ষশিলার মতো শিক্ষাকেন্দ্রের ব্যক্তিবর্গরা ভারতবাসীদের বোঝাতো। হয়তো তখন আমরা স্বাধীন নাগরিক হিসাবে গণ্য হয়ে যেতাম। কিন্তু তা হবার নয়। কারণ চাকা এগিয়ে চলে সামনের দিকে পিছনের দিকে যদি আমরা নিজে থেকে নিয়ে যাই তাহলে যে যাবে নচেৎ নয়। তাই শিক্ষা কেন্দ্রগুলির ব্যক্তিবর্গের ভাষণ তখনকার দিনে মানুষের একরকম হাতিয়ার হিসাবে গণ্য হত। তাই তারা সেসব ভাষণ মেনে চলতে বাধ্য থেকেছিল এবং তাদের পতন ডেকে এনেছিল।