“সব সত্ত্বেও একথা সত্য যে রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা ভাষায় তিনি প্রথম মৌলিক কবি” যাঁর সম্পর্কে কথাগুলি বলা হয়েছে, তাঁর মৌলিকতার লক্ষণগুলি নির্দেশ করো। তুমি কি এ বিষয়ে প্রাবন্ধিকের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত?

কবি ও সমালোচনা সত্তার অনবদ্য মেলবন্ধন ঘটেছে বুদ্ধদেব বসুতে। তিনি কবি ছিলেন বলে বাংলা কাব্যের মন মেজাজকে সহজে বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি সমালোচক ছিলেন বলে বাংলা কবিতার বিবর্তন সহজে বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি সমালোচক ছিলেন বলে বাংলা কবির ক্ষমতা ও ক্ষমতাহীনতা, দোষ ও গুণ উভয় বৈশিষ্ট্যকেই সহজে হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিলেন। সেই সঙ্গে মিশেছিল বুদ্ধদেবের সহৃদয় হৃদয়সংবাদী স্বাতন্ত্র্য অনুভূতি ক্ষমতা। আর এ সমস্ত কিছুর মিশ্রণে তাঁর সমালোচনা সাহিত্য বিশিষ্ট হতে পেরেছে। 'রবীন্দ্রনাথ ও উত্তর সাধক' প্রবন্ধে তিনি রবীন্দ্র কেন্দ্রিক বাংলা সাহিত্য, বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রপ্রভাব, বাংলা কবিদের রবীন্দ্র অনুবর্তন, অনুকরণ এবং রবীন্দ্র প্রভাব কাটিয়ে নব কাব্যধারার প্রবর্তনা সম্পর্কে একটি মৌলিক চিন্তাধারার প্রকাশ ঘটিয়েছেন।


‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তর সাধক' কবিদের পর্যালোচনায় তিনি নজরুল ইসলামকে রবীন্দ্রপ্রভাব মুক্ত কবি বলেছেন। তাঁর মতে, “নজরুল ইসলামকে মনে হয় রবীন্দ্রনাথের পরে অন্য একজন কবি ক্ষুদ্র নিশ্চয় কিন্তু নতুন।” এমন মন্তব্য থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে রবীন্দ্রনাথের উত্তর সাধক কবিদের মৌলিক ও নতুন কবি বলার পিছনের প্রেক্ষিতটি হল—রবি চুম্বকের প্রবল টানকে অস্বীকার করে নজরুলের বেরিয়ে আসা। যার ফলে বাংলা কাব্য কবিতা নতুন পথের সন্ধান পেল। নজরুল কর্তৃক রবীন্দ্র বন্ধন ছিন্ন করার কারণগুলিকে প্রথম দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা—

  • বাহ্যিক কারণ : নজরুলের জীবন ও জীবন দৃষ্টির পরিবেশ ও পটভূমিকার প্রেক্ষিতটি এক্ষেত্রে বিচার্য।

  • অভ্যন্তর কারণ : কাব্য ভাবনার জীবন বোধ ও জীবন বিশ্বাসে নজরুলের দৃষ্টিভঙ্গির স্বাতন্ত্র্যই এখানে বিচার্য।


অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ প্রভাব মুক্তির এই যে দ্বিবিধ হল, তার সূক্ষ্ম ও গভীরতর বিশ্লেষণের মাধ্যমে কবি হিসাবে নজরুলের মৌলিকতার ও নতুনত্বের স্বরূপটিকে স্পষ্ট করা দরকার।


নজরুল কর্তৃক রবীন্দ্র বলয় মুক্তির বাহ্য কারণ:

(১) নজরুল ছিলেন জন্ম সূত্রে মুসলমান। ফলে মুসলমান সমাজের ও মুসলমান ব্যক্তি জীবনের রূপটি তিনি এই সূত্রে পেয়েছিলেন। সেই সাথে নিজ উদারতার প্রচেষ্টায় তিনি হিন্দুমানসকেও আপন করে নিয়েছিলেন। এই দ্বিবিধ মানসিকতার মিশ্রণে নজরুল বিশিষ্ট হতে পেরেছিলেন। যা তাকে রবীন্দ্র ভাবনা জগতের বাইরে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।


(২) রবীন্দ্রপ্রভাব কাটিয়ে নজরুলের স্বাতন্ত্র্য অর্জনের পিছনে রয়েছে নজরুলের গ্রামীণ পরিবেশে বেড়ে ওঠার চালচিত্রটি। নজরুলের বাল্য, কৈশোর কেটেছে শহরে নয়, মফঃসলে, স্কুল কলেজে পড়ে ভদ্রলোক হবার চেষ্টা নয়, যাত্রা গানের ও লোটো গানের আসরে, রুটির দোকানে, কখনও যুদ্ধের সৈনিক বেশে দেখা যায়। জীবনধারণের সামাজিক ভিন্নতা রবীন্দ্রনাথের থেকে নজরুলকে পৃথক করে দিয়েছে।


(৩) গ্রাম্য জীবনধারণে যে একটু ধরনের গতিবেগ থাকে, সেই গতিবেগকে আশ্রয় করে রবীন্দ্র কাব্য ভাবনার বলয়কে তিনি সহজেই ছিন্ন করে নতুন জগৎ গড়ে নিতে পেরেছিলেন।


(৪) ব্যক্তি জীবনে দারিদ্র্য ও তার প্রভাব জীবন ভাবনার দিক দিয়ে নজরুলকে নতুন করে তুলেছিল। এই নতুনত্বের আকাঙ্ক্ষা যখন সাহিত্যে প্রযুক্ত হল তখন বাংলা কাব্য জগতে মৌলিক চিন্তা ভাবনার দ্বারটি উন্মুক্ত করল।


রবীন্দ্র বলয় মুক্ত হয়ে নজরুলের মৌলিক কবি হওয়ার যে কারণগুলি এখানে উল্লেখিত হল সেগুলিকে বুদ্ধদেব বসু আকস্মিক বলেছেন—“এই যে নজরুল রবি তাপের চরম সময়ে রাবীন্দ্রিক বন্ধন ছেড়ে বেরুলেন, বলতে গেলে অসাধ্য সাধন করলেন, এটাও খুব সহজে ঘটেছিল। এর পিছনে সাধনার কোনো ইতিহাস নেই, কতকগুলি আকস্মিক কারণেই সম্ভব হয়েছিল এটা।” রবীন্দ্র বলয় ছিন্ন করার পিছনে কোনো সাধনা নেই প্রাবন্ধিকের এমন মত যথার্থ নয়। আমরা বলি নজরুলের মৌলিক কবি হওয়ার পিছনে রয়েছে তাঁর জীবন ভাবনার সচেতন প্রয়াস। এই সচেতন প্রয়াসকেই আমরা অভ্যন্তর কারণ বলছি। তাই দেখি জীবন ধারণের বাহ্য পটভূমিই নজরুলকে শুধুমাত্র মৌলিক কবি করে তুলতে সাহায্য করেনি। এর পিছনে রয়েছে কতকগুলো আভ্যন্তর কারণ। যথা—


(১) নজরুল ছিলেন স্বভাব বিদ্রোহী। সমাজের অত্যাচার, অনাচার, নিপীড়ন, লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে তাঁর মননটি সতত প্রতিবাদে মুখরিত ছিল। তিনি তাঁর প্রতিবাদ প্রকাশ করেছেন উজ্জ্বল শিখার মতো লেখনী দ্বারা। যথা—

“ক্ষুধাতুর শিশু চায়না স্বরাজ, চায় দুমুঠো ভাত একটু নুন। 

বেলা বয়ে যায়, খায়নি ক’ বাছা কচি পেটে তার জ্বলে আগুন।”

অথবা

“যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটির মুখের গ্রাস।

যেন লেখা হয় আমার রক্তে তাদের সর্বনাশ।

অথবা

কারার ওই লৌহ কপাট ভেঙে ফেল কর রে লোপাট

রক্ত জমাট শিকল পূজার পাষাণ বেদী।”

এই প্রতিবাদ চেতনাই নজরুলকে রবীন্দ্র পরবর্তীকালের কবিদের মধ্যে মৌলিক হতে সাহায্য করেছে।


(২) রবীন্দ্র কাব্যের যে বড়ো বৈশিষ্ট্য আস্তিক্য দর্শন, তার বিরোধিতা করে নজরুল বাংলা কাব্যে নাস্তিক্য দর্শনের প্রবর্তনা ঘটিয়েছেন। যথা— 

“আমি বিদ্রোহী ভৃগু/ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন।”

অথবা

“জগদীশ্বর ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য

আমি আঁতিয়া তাঁতিয়া মাতিয়া ফিরি স্বর্গ পাতাল মর্ত্য।” 

এই পথে পা রেখে তিনি রবীন্দ্রনাথকে ছাড়িয়ে গেলেন।


(৩) রবীন্দ্র প্রভাব ছিন্ন করে নজরুলের মৌলিক কবি হয়ে ওঠার আর একটি অন্যতম কারণ হল রবীন্দ্র কবিধর্ম, মঙ্গল ধর্মিতা ও কল্যাণ ধর্মিতার বিরোধিতা করা। যথা—

“দেখিনু সেদিন রেলে

কুলি বলে এক বাবুসাব তারে ঠেলে দিল নীচে ফেলে—

চোখ ফেটে এল জল,

এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল।" 


অন্ত্যজ, অর্থ লাঞ্ছিত কুলিকে এক বাবু সাহেব ঠেলে মৃত্যু মুখে ফেলে দেওয়ার মধ্যে মঙ্গল ধর্মিতা বা কল্যাণ ধর্মিতার বিরোধী ভাব প্রকাশ করতে চেয়েছেন নজরুল।


(৪) রবি চুম্বক হতে বেরিয়ে নজরুলের মৌলিক কবি হওয়ার পিছনে প্রতিবাদী চেতনার যে আর একটি সোপান ছিল তা হল যৌন সংপৃক্ততা। রবীন্দ্র কাব্য ভাবনা ছিল দেহহীন। দেহ রবীন্দ্র কাব্যে তেমন স্থান পায়নি। রবীন্দ্র কাব্য ছিল ধরা থেকে অধরা, রূপ থেকে অরূপ, সীমা থেকে অসীমের পূজায়। তার প্রেম কাম গন্ধহীন, এই দেহবাদ হীন প্রেম ভাবনার বিরুদ্ধে গেলেন নজরুল। তিনি জানালেন প্রেম দেহ হীন নয়। প্রেমের আলোকে মানুষ আলোকিত হয় এবং তাতে মনের সাথে দেহের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক থাকে। যথা—

“সে যে চাতকই জানে তার মেঘ এত কী,

যাব ঘনঘন বরিসন কেন কেতকী, 

চাঁদে চকোরই চেনে আর চেনে কুমুদী

জানে প্রাণ কেন প্রিয়ে প্রিয়তম চুমু দি।”


(৫) রবীন্দ্র বলয়ের মধ্যে থেকেও নজরুলের মৌলিক ও নতুনভাব হয়ে ওঠার অন্যতম কারণ হল প্রকৃতি চিত্রণে নজরুলের স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি। প্রকৃতি যেখানে রবীন্দ্রনাথে শান্তি ও ঐশ্বী শক্তির প্রতীক হয়ে দেখা দিয়েছে, সেখানে নজরুলের কাছে প্রকৃতি হয়ে উঠেছে মানবী প্রিয়ার সঙ্গে অন্বিত চেতন প্রাণের সত্তায় জীবন্ত ও মুখর। যথা—

“সিঁথির বীথির খসে পড়া কপোল ছাওয়া পেল অল্প। 

পলক হারা, সে মুখ চেয়ে নাচ ভুলেছে নাকের নোলক। 

পাংশু তাহার চূর্ণ কেশে 

মুখ মুছে যায় সন্ধে এসে 

বিধুর অধর সীধু যেন নিঙড়ে কাঁচা আঙুর চোঁয়ায়।”


অর্থাৎ নজরুল কর্তৃক রবীন্দ্র প্রভাব মুক্তির বাহ্যিক ও আভ্যন্তর কারণগুলো বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে আমরা উপনীত হতে পারি যে, রবীন্দ্র বিরোধীতাই নজরুলকে মৌলিক কবি করে তুলেছিল। নজরুল ছিলেন স্বভাব কবি, তাঁর কাব্যে কবিত্বের পরিচয় স্বতন্ত্র ভাব ও মেজাজের সঙ্গে ফুটেছে। বলা যেতে পারে বাহ্যিক ও আভ্যন্তর দুই প্রকার আবহের সঙ্গে স্বীয় প্রতিভা ধর্মেই নজরুল রবি চুম্বকের টানকে অঙ্গীকার করে বাংলা কাব্যে নতুনরস সঞ্চার করলেন। বাংলা কাব্যে নতুন পথের দিশা জন্মোচিত হল তাঁর নিপুণ ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে। এই প্রেক্ষিতে সমালোচক বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে এই সিদ্ধান্ত করতেই পারি নজরুল রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা ভাষার প্রথম মৌলিক কবি।