“শিল্পের পক্ষে এই জাতের একটা পৌরাণিক জগতে বিশ্বাস করবার অনিবার্য প্রয়োজনীয়তা বারবার প্রমাণিত হয়েছে”—পৌরাণিক জগত বলতে কী বোঝানো হয়েছে? বাংলার পটুয়ারা কীভাবে এই ‘পৌরাণিক জগত’-কে গ্রহণ করেছেন? এ প্রসঙ্গে ইউরোপীয় শিল্পীদের বিষয়ে প্রাবন্ধিক কী মত পোষণ করেন। নিজের ভাষায় লেখো।

বাংলার চলিত চিত্রকলার অসামান্য প্রয়োজনীয়তাকে আশ্রয় করে লেখক যামিনী রায় এক বিস্ময়কর জগৎ সৃষ্টি করেছেন, সে জগৎ হল পৌরাণিক জগৎ। দেবদেবির মহিমা কীর্তনের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় পুরাণ। কোনো অলৌকিক বিষয়কে অবলম্বন করে জগজীবনে বিকাশ সাধনের মধ্যে এমন এক জাগয়া সৃষ্টি হয়েছে সেটা হল পৌরাণিক জগৎ। শিল্প সাধনার ক্ষেত্রে প্রাচীনতাকে আশ্রয় করে লৌকিকতার আড়ালে শিল্পী সম্প্রদায় যে বোধ জাগিয়ে তুলেছিল তা হল পুরাণের জগতে। জগতে নানা বিষয় উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে শিল্প সৌন্দর্য লাভ করে কিন্তু সে জগৎ সময় কেবল দেবতার গুণ কীর্তণ করে তখন তা হয়ে ওঠে পৌরাণিক জগৎ। সমাজ বাস্তবতার মুখাপেক্ষী হয়ে মানুষ প্রথম আশ্রয় করল পুরাণকে। অলৌকিক শক্তি আর সৌন্দর্যের বর্ণনা দিয়ে শুরু হল পুরাণ। তাই বলা যায় কোনও দেশের ধর্মজীবনের সঙ্গে জড়িত প্রাচীন অলৌকিক কাহিনি নিয়ে পৌরাণিক জগৎ রচিত হয়েছে। লেখকের ভাষায় পুরাণ হল দেবতা মহলের আদর্শায়িত রূপ।


প্রাগৈতিহাসিক যুগের শিল্পসাধনায় অঙ্গ হিসাবে প্রাণপাত ঘটতে থাকল শিল্পীর জগতের। পুরাণের ওপর কোনো অবলম্বন না করে তারা শিল্প সৃষ্টি করে গেছেন। তাদের ভাষায় ছিল বিপরীতধর্মী মনো, হাতের কাছে পাওয়া প্রাকৃতিক সম্পদকে আশ্রয় করে তারা সৃষ্টি করল শিল্পের। এই পৌরাণিক ঘটনায় আশ্রয়। পুরাণের অলৌকিক মহিমা প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে একের পর এক ছবির পট এঁকে চলল গ্রামীণ শিল্পীর দল। পটুয়া শিল্পটি প্রকৃতি সৃষ্টি হয়েছিল সহজ। সরল গ্রাম্যতার আদর্শে। গ্রাম্য আদর্শকে বাস্তবায়িত করতে একদল মানুষ কিছু সৃষ্টি মন্ত্র নিয়ে এগিয়ে এলো আর সৃষ্টি হল শিল্পের। পুরাণের ওপর ভিত্তিকরে পটুয়া শিল্প প্রাণলাভ করেছিল। পুরাণ কথাটা বলতে নৃতত্ত্ববিদরা ‘Myth’ শব্দটি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে পটুয়া শিল্পে এক স্বতন্ত্র ভাবাবহ সৃষ্টি করেছে।


পুরাণের ওপর ভিত্তি করে পটুয়া শিল্প যে গড়ে উঠেছে, তার ফলে সংহত জগৎ আর এলোমেলো মাপছাড়া ভাষা দৃষ্টিগোচর হয়েছে। তাই লেখকের বক্তব্যকে উদ্ধৃত করে বলা যায়—“বাংলার প্রাচীন পটুয়ারা কিন্তু এমন একটা জগতের সন্ধান পেয়েছেন যে জগৎ আগাগোড়া সামান্য লক্ষণের জগৎ এবং একটা পুরোপুরি সংহত পুরাণের ওপর যার স্থিতি।” পুরাণ বিষয়কে অঙ্গি করে লেখক শিল্প মধ্যে উপস্থাপন করেছেন পুরাণের জটায়ু পাখিকে। অন্ধ কোনও পাখির সঙ্গে এই পাখি দেখতে একই মনে হলেও এ পাখির মধ্যে একটা স্বতন্ত্র বিদ্যমান। আবার বানরের জন্ম ইতিহাস নিয়ে বিশ্লেষণ মধ্য দিয়ে তাকে ঘরলোকের জগৎ থেকে আলাদা করে রেখেছে। এই ভাবে বাংলার পটুয়া শিল্পের জগৎ দশা বেঁধে ছিল পুরাণের ভিত্তির ওপর।


পৌরাণিক জগতে বিশ্বাসের ফলে মূল পটুয়া শিল্পীর জগতে বৈচিত্র্য দেখা দিয়েছিল, এসেছিল শিল্পজগতে সংহতি। পুরাণের ওপর বিশ্বাস ছিল তাদের প্রাণ। পৌরাণিক জগতকে বিশ্বাস করবার অনিবার্য প্রয়োজনীয়তা ছিল তাদের মধ্যে। এমন বিশ্বাস ও দেখা গেল ইউরোপীয় শিল্প মহলে। সেখানে খ্রিস্টের পুরাণের বিশ্বাস যতদিন অটুট রাখতে পেরেছিল ততদিন শিল্পে কোনো অশান্তি আসেনি। শিল্পী রেখব্রান্টের দীর্ঘ কর্মজীবনের ইতিহাসের পর সামাজিক অবস্থার প্রভাবে পুরাণে বিশ্বাস আর অটুট রাখা গেল না। অনেক শিল্পীর দল খ্রিস্টীয় পুরাণ ও গ্রাম্য সরলতাকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করেছিল কিন্তু তারা তাতে বিশেষ স্বার্থকতা পায়নি। এর ফলে শিল্পে শান্তি ফিরিয়ে আনা আর সম্ভব হল না। কিন্তু পশ্চিম ইউরোপে শিল্প বিষয়ে পৌরাণিক বিশ্বাসের সন্ধান এখনও পর্যন্ত অটুট ছিল। আধুনিক যখন শীলতার জীবনে সেই বিশ্বাস আর বেশিদিন টিকে থাকতে পারলো না। লেখক বলেছেন— “মূল পটুয়া ছবির পুরাণ নির্ভরতা তাই লক্ষ্য করবার।"


পটুয়া শিল্পীদের পুরাণ মগ্নতা সম্পূর্ণভাবে মরেনি। কিন্তু পুরাণ সাহায্য ছাড়া প্রাগৈতিহাসিক ছবি লুপ্ত হতে শুরু করল কিন্তু ইউরোপীয় শিল্প সম্পূর্ণ ভাবে ভরে যায়নি। এই ভাবে শিল্প সাধনার দীর্ঘ ইতিহাসের পথ অতিক্রম করে ইউরোপীয় শিল্পীরা তাদের অক্ষমতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে হিসাব বুঝে নিতে শুরু করল। শিল্পী সাধনার জন্য দাবা খেলার যে চাল তারা এতোদিন দিয়ে এসেছে তা একেবারে ধ্বংস করে দিতে চায়। আবার ইউরোপীয় শিল্প বিশেষ করে শিল্প ও সংস্কৃতির শিল্পীরা ছবিকে পালিশ করার দিকে বেশি দৃষ্টি রেখেছে। ছবির মধ্যে মাপ ছাড়া ভাবের পরিবর্তে এল রকমারি ও চাকচিক্য। শিল্পের ভাববৈচিত্র্যকে সৃষ্টি করে মন্দীভূত শিল্প সৃষ্টিতে আঙ্গিক প্রধান হয়ে উঠেছে। তাই শিল্পীদের ভুলের ফলশ্রুতিতে বোঝানো হয়েছে—'গোড়া বেঁধে খেলার কথা। এই ভাবে ইউরোপীয় শিল্পতে ছবির অণুগুলি মূল বিশ্বাসের স্রোতে দৃঢ়তায় আত্মপ্রকাশ করল।