“দেশের যে ঐতিহ্য ব্রিটিশপূর্ব শিল্প সাহিত্যের উৎস"—তার পরিচয় দাও। এই ঐতিহ্য রক্ষায় ঈশ্বর গুপ্তের ভূমিকা নির্দেশ করো। এ কালের কবিকুলকে দেশজ সংস্কৃতির সঙ্গে সেতু বন্ধনের কথা ভাবতে হচ্ছে কেন, প্রাবন্ধিকের অনুসরণে তা সংক্ষেপে লেখো।

ইংরেজ আবিষ্কারের পূর্বে যে বাংলা সাহিত্য তা অনার্য সংস্কৃতির বিষয়বস্তুতে পূর্ণ। ব্রতকথা, মঙ্গলকাব্য, ছড়া থেকে প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের এই লোকায়ত ধারার পরিধি বিশাল। এই লোকায়ত ধারা শিল্প সাহিত্যেও অনুপ্রবেশ করে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যকে এক বিশিষ্ট মর্যাদা দিয়েছে। বহির্জগতের বস্তু সম্বন্ধে কৌতুহলও আগ্রহ সাহিত্যকে বহির্মুখী ও বস্তুনিষ্ঠ করে তুলেছে। দেশজ সাহিত্যের এই ধারায় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কতখানি প্রভাব বিস্তার করেছে তার প্রমাণ মধ্য যুগের সাহিত্যের নানা ক্ষেত্রে দেখা যায়। এসব কিছু মিলেই প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্য। ঈশ্বর গুপ্ত দেশজ ঐতিহ্য রক্ষার প্রতি আগ্রহী ছিলেন। এই ঐতিহ্য বোধকে তিনি সযত্নে রক্ষা করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। সংবাদ প্রভাকরের সম্পাদক ঈশ্বর গুপ্ত যে কবি গোষ্ঠী নির্মাণ করেছিলেন তার মন ছিল পুরাতন সুরে বাধা কিন্তু ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত শিষ্ট সমাজ যে সমাজ ও সংস্কৃতি চর্চা করত। খাঁটি বাংলার কবি ঈশ্বর গুপ্তর দেশজ রীতি তার ওপর আঁচড় কেটেছিল। ঈশ্বর গুপ্ত ছিলেন কবির লড়াইয়ের কবি। কবিওয়ালা সম্প্রদায়ের উত্তরাধিকারী ঈশ্বর গুপ্ত তাঁর কবিতার রচনারীতিতে ছিলেন পুরাতনপন্থী। তিনি প্রথাসিদ্ধ খাদ্য বর্ণনার কবি ‘আনারস’, ‘ছাগল’, ‘পৌষ-পার্বণ’ প্রভৃতি কবিতায় বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টি ফুটে উঠেছে।


ঊনিশ শতকের বাংলার সংস্কৃতি ছিল কণ্টকিত। অর্থাৎ বাংলায় একটানা ভাবে সব যুগের রেনেসাঁসের স্থান লাভ করা যায়নি। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রেরণায় যে যুক্তিবাদ ও মানবিকতাবাদ এদেশে এসে পৌঁছেছে, তা দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পূর্ণ একাত্ম হতে পারে। না। তাই রেনেসাঁস উনিশ শতকে অর্ধ সমাপ্ত। তার কিছুটা দেশি, কিছুটা বিদেশি, দেশজ সংস্কৃতি সম্পূর্ণ আত্মস্থ করে বিদেশি সংস্কৃতিকে অখণ্ড ও সহজ রূপ দেবার যে প্রেরণা প্রত্যাশিত ছিল তা উনিশ শতকে লক্ষ করা যায় না। তাই লোককথা ও শিল্পে যে দেশজ পরিচয় আছে, তা পাশ্চাত্য শিল্পের প্রবেশের পরেও স্বকীয় ধর্মকে বজায় রেখেছে। সাহিত্যে ও এই স্বধর্ম বৈশিষ্ট্য বর্তমান। পাশ্চাত্য রেনেসাঁসের প্রভাবে উনিশ শতকে কবি ঊনবিংশ শতাব্দীর যে রামায়ণ রচনা করেছেন, তা নানা কারণে ঐতিহাসিক। উনিশ শতকের প্রথমার্ধের মধ্যে যে দুই ধারার সংঘাত ছিল, তাঁকে রক্ষা করার জন্য ঈশ্বর গুপ্ত ছিলেন অতন্দ্র। তার শিষ্য সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেকেই যখন নব যুগের চিন্তার দীপ্তিতে দীপ্তিমান হয়ে উঠলেন, তখন ঈশ্বর গুপ্ত সব সময় মধ্য যুগের বাণীকে দুহাত দিয়ে বরণ করতে পারেন নি। এই দোটানার জন্য যে সংগ্রাম ও সহিঞ্চুতার প্রয়োজন, ত্যাগ ও বলিষ্ঠতার প্রয়োজন তা ঈশ্বর গুপ্তের ছিল। এই কারণে ঈশ্বর গুপ্তের জীবনকে রূপক বলা চলে। উনিশ শতকের ভাব মানসে যে দ্বিমুখী স্রোত ছিল, তার প্রতীক যেন ঈশ্বর গুপ্তের জীবন ও কর্ম ও কবিতাবলি। যে মানুষ পাশ্চাত্য স্ত্রী শিক্ষার বিরোধী ছিলেন, তিনিই আবার ভিক্টোরিয়ার কাছে প্রার্থনা করেন যেন ‘রাঙা ছেলের চোখ না রাঙায়'। পাশ্চাত্য অনুকরণকারী মেয়েদের উদ্দেশ্যে তাঁর ব্যঙ্গবাণী—

“বিবিজ্ঞান চ'লে যান লবে জান করে। 

শাড়ি পড়া এলোচুল আমাদের মেম 

বেলাক নেটিভ লেডি শেষ, শেষ, শেম্ 

সিন্দুরের বিন্দুসহ কপালেতে উল্কি।। 

নসী, মসী, ক্ষেমী, রামী, যামী, শামী, গুল্কি।"


অথবা—

“আগে মেয়েগুলো ছিল ভালো

ব্রত ধর্ম করত সরে

একা বেথুন এসে শেষ করেছে

আরকি তাদের তেমন পাবে?”


ঈশ্বর গুপ্তের প্রাচীন পন্থীর পরিচয় এইসব ভাবনায়, এই সব বাক্যে। পাশ্চাত্য শিক্ষার দূষণ তাঁকে ক্লিষ্ট করেছে—

“কালে গুণে এই দেশে বিপরীত সব। 

দেখে শুনে মুখে আর নাহি সরে রব। 

একদিকে কোশাকুশী আয়োজন নানা। 

আর দিকে টেবিলে ডেবিল খায় খানা। 

পিতা দেয় গলে সূত্র, পুত্র দেয় কেটে। 

বাপ পূজে ভগবতী, বেটা দেয় পেটে। 

বৃদ্ধ ধরে পশুভাব, জন্তুভাব শিশু।

বুড়া বলে রাধা কৃষ্ণ, ছেলে বলে জিশু।”


পিতাপুত্রের দুই প্রজন্মের সংস্কৃতির পার্থক্য ও পরিবর্তন পরিহাসের সঙ্গে বর্ণনা করলেও কবি দুই কৃষ্টির মধ্যে ছিলেন বাঁধা। এইজন্য তাঁর জীবন ছিল প্রাচীনও নবীনের সন্ধিক্ষণের রূপক। তাই ঐতিহ্য রক্ষায় তাঁর অবদান অসীম।


কেবলমাত্র খাঁটি বাঙালি কবি হিসেবে কিংবা নতুন ও পুরাতন যুগের সন্ধিক্ষণের কবি হিসেবে ঈশ্বর গুপ্তের যে পরিচয় নির্দিষ্ট ছিল বিষ্ণু দে তাকে স্বীকার করে নিয়েও নতুনমাত্রায় তাঁর প্রতিভাকে নির্দিষ্ট করার প্রয়াস করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের কাব্যে দেশজ সংস্কৃতির আভাস পাওয়া যায়। বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন “মধুসূদন, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শিক্ষিত বাঙালির কবি, ঈশ্বর গুপ্ত বাংলার কবি।” তাই তিনি যে দেশজ সংস্কৃতির কথা তুলে ধরেছেন তা এই ঐতিহ্য লোকশিল্পে ও সাহিত্যে খুঁজে পাওয়া যায়। বঙ্কিমচন্দ্র একে বলেছেন ‘রিয়ালিজম'। কী পাহাড় পুরের শিল্প নিদর্শন, কী গ্রাম শিল্পের লুপ্তপ্রায় নমুনা সবেই আছে বহিরঙ্গ বস্তু সম্বন্ধে সুস্থ মনোযোগের প্রমাণ। চন্ডীকাব্য, মঙ্গলকাব্য এমনকি বৈশ্বব পদাবলিতে এই স্বাস্থ্য আমাদের বিস্মৃত করে, এই মনোবৃত্তির ফলে দেবদেবীর প্রতি মানুষের মূল্য আরোপিত হয়। তারপরে ধনপতি সওদাগরের নাকাল হবার কাহিনি লেখা হয়, প্রেমের মধ্যে নিঃসন্দেহে সম্পূর্ণতা পায় ইংরেজিতে একেই বলে মানবিকতা। তাই ঈশ্বর গুপ্তের লেখায় দেখা যায় বাংলার এইসব জনজীবনের সমন্বয়। সেইজন্য ঈশ্বর গুপ্ত গত শতাব্দীর সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একজন দিকপাল পুরুষ। তিনি শুধু উপভোগ্য লেখাই, লেখেন নি, তাঁর সাহিত্য জীবনে ও একটি রূপক। পুরাতন ঐতিহ্যে বাঁধা তাঁর লেখনী নতুন সমাজের পটে আঁচড় কেটেছিল। তিনি কবি লড়াইয়ের কবি। তাই একালের কবিকুল দেশজ সংস্কৃতির সঙ্গে সেতু বন্ধনের কথা ভাবা হচ্ছে। কারণ দেশজ সংস্কৃতি না থাকলে নতুনভাবে কিছু আবিষ্কার করা যাবে না। তাই নতুন কিছু করতে গেলে দেশজ সংস্কৃতির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা প্রয়োজন। এটা প্রাবন্ধিকও মনে করেন।