তাদের প্রবন্ধে অনিবার্য ছিল রবীন্দ্রনাথের অনুকরণ এবং অসম্ভব ছিল রবীন্দ্রনাথের অনুসরণ।— কাদের সম্বন্ধে উক্তিটি করা হয়েছে এবং অনুকরণ অনিবার্য এবং অসম্ভব ছিল কেন বুঝিয়ে দাও।

বুদ্ধদেব বসুর অনুসরণে রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক প্রবন্ধের সামগ্রিক অথচ সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
রবীন্দ্র কাব্যের বৈশিষ্ট্য এবং রবীন্দ্র যুগের প্রথম পর্বের উত্তর সাধকদের ওপর রবীন্দ্রনাথের প্রভাবের পরিণাম সম্পর্কে আলোচনা করো।

কল্লোল গোষ্ঠীর অন্যতম কবি ও প্রখ্যাত সমালোচক বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক' প্রবন্ধে বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের অনতিক্রমনীয় প্রভাব সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন। রবীন্দ্রোত্তর কবিকুল কেন প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও বাংলা সাহিত্যে আপন স্বাতন্ত্র্যের স্বাক্ষর রেখে যেতে পারলেন না, বুদ্ধদেব তার এক যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা উপস্থাপিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের তীব্র আকর্ষণে তরুণ কবিরা অদম্য বেগে রবি চুম্বকে সংলগ্ন হয়েছেন। কিন্তু বুদ্ধদেব মনে করেন রবীন্দ্রনাথ তেমন কবি নন যাকে নিরুপদ্রবে উপভোগ ও অনুসরণ করা যায়। সমালোচকের ভাষায় বাংলাদেশের পক্ষে বড্ড বেশি বড়ো তিনি, আমাদের মনের মাপজোকের মধ্যে কুলোয় না তাকে। আমাদের সহাশক্তির সীমা তিনি ছাড়িয়ে যান। সমালোচকের ধারণা অপরিসর ক্ষীণপ্রাণ বাংলা সাহিত্যে তাঁর আবির্ভাব এত বৈপ্লবিক যে তাঁর আবির্ভাবে বিস্মিত, ক্ষুদ্ধ, বিচলিত, বিব্রত ও ক্রুদ্ধ হওয়া হয়তো সম্ভব ছিল কিন্তু সহজ ছিল না তাঁকে সহ্য করা। সমালোচক মহলে অবিশ্রাম নিন্দা বর্ষণে ও উত্তর পুরুষের প্রতিরোধহীন আত্মবিলোপে এর প্রমাণ পাওয়া যায়।


রবীন্দ্রানুসারী কবি সমাজের এই প্রতিরোধহীন আত্মবিলোপের কারণ অনুসন্ধানে ব্রতী হয়ে বুদ্ধদের লক্ষ্য করেছেন, এইসব কবিদের শক্তির দীনতা নয়, এক ঐতিহাসিক কারণেই তাদের কবিতা কালের বালুকাবেলায় কোনো পদচিহ্ন রেখে যেতে পারল না। এই ঐতিহাসিক কারণটি সমালোচকের ভাষায়—তারা সকলেই এক অনতিক্রম্য অসহ্য দেশের অধিবাসী কিংবা পরবাসী। অর্থাৎ তাদের পক্ষে অনিবার্য ছিল রবীন্দ্রনাথের অনুকরণ, কিন্তু অসম্ভব ছিল রবীন্দ্রনাথের অনুসরণ। রবীন্দ্র কাব্যের ললিত রাগিণীতে তাঁর সম্মোহনী শক্তিতে তাঁদের এমনই মতিভ্রম হল যে তারা ভাবলেন রিনিঝিনি শব্দ বাজালেই রাবিন্দ্রিক স্পন্দন জাগে, আর জলের মতো তরল হলেই স্রোতস্বিনীর গতি পাওয়া যায়। রবীন্দ্র কাব্যের প্রকৃত স্বরূপ তাদের কাছে অনাবিষ্কৃত থেকে গেল। রবীন্দ্র কাব্যের সরলতা যে শুধু ওপর স্তরেই বিরাজমান, গভীরে তার কাব্য যে অনিশ্চিত, তা যে স্রোতের আবর্তে নিত্যমথিত তা তাঁদের কাছে অপরিচিতই থেকে গেল। এই ভুল বোঝার জন্য তাদের কাব্যে দেখা দিল অসংযত ফেনিল উচ্ছ্বাস। তন্দ্রালুতাকে তারা ভুল করলেন তন্ময়তা বলে, স্বভাব কবিত্বের লক্ষণ তাঁদের কাব্যে মারাত্মক ত্রুটি হিসাবে দেখা গেল।


বুদ্ধদেব মনে করেন রবীন্দ্রনাথকে পরম ভাগ্যে আমরা পেয়েছি কিন্তু এই পাওয়ার মূল্য আমাদের দিতে হয়েছে। পরবর্তীকালে সত্যেন্দ্রনাথ ও তার সম্প্রদায় যে বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথকে অনুসরণ করতে গিয়ে সাহিত্যের চোরাবালিতে ডুবে গেলেন, তার কারণ, রবীন্দ্রনাথের অপরূপ দ্যুতিময় কাব্য সৃষ্টির পর বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী কীর্তি রেখে যেতে হলে যে সতর্কতা প্রয়োজন তা এই কবিগোষ্ঠীর ছিল না। রবীন্দ্রনাথের পর কবিতা লেখা ব্যাপারটা তাঁদের কাছে সীমাহীনভাবে সহজ হয়ে গেল, রবীন্দ্রনাথ ছন্দ, মিল, ভাষা, উপমা ও বিচিত্র স্তবক বিন্যাস আপন কবিতার প্রয়োজন ও আপন প্রতিভা বিকাশের জন্য সৃজন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের আপাত সরল কাব্যরীতি পরবর্তী কবিদের প্রতারিত করল। কারণ রবীন্দ্রনাথের কাব্যে গ্যেটে, দান্তে বা শেকসপিয়রের মতো কবিদের স্বর্গ মর্ত্য পাতাল ব্যাপী কোনো মহৎ ভাব কল্পনা না থাকায়, তারা রবীন্দ্র কাব্যের অতিসহজে অনুকরণযোগ্য একটা ব্যাপার বলে মনে করলেন। এইসব কবিদের মধ্যে একটা ধারণা সৃষ্টি হল যে রবীন্দ্রনাথের মতো কাব্য রচনা করতে হলে কোনো প্রস্তুতি বা পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন নেই। তারই ফলশ্রুতি হিসাবে রবীন্দ্র সমসাময়িক যুগে রবীন্দ্রানুরাগী কবিদের হাতে যা সৃষ্টি হল তা রবীন্দ্রনাথেরই অক্ষম অনুকরণতার সুরেরই ক্লান্তিহীন একঘেঁয়েমি। রবীন্দ্র প্রতিভার যাদুস্পর্শে যা অপরূপ দ্যুতিময়, তাঁর অনুকারীদের হাতে সেই কাব্য দ্যুতি হারিয়ে ম্লান ও বিবর্ণ রূপ ধারণ করল, লেখকের ভাষায়—রবীন্দ্রনাথের মতো হতে গিয়ে রবীন্দ্র নামেই হারিয়ে গেলেন। চতুর্দিকের এই প্রত্যক্ষ পৃথিবী রবীন্দ্রদৃষ্টিতে যেরূপে ধরা দিয়েছে তাকেই তিনি রূপে রসের অনির্বচনীয় মহত্ব দান করেছেন। প্রতিদিনের পৃথিবী তার নিত্য সুখ-দুঃখ ও অপরূপ মাধুরী নিয়ে তার কবিতা ও গানে প্রকাশিত। এইরকম কবিতা জীবনের সম্পদ, কিন্তু আদর্শ হিসাবে বিপজ্জনক। রবীন্দ্র কবিতা অনুকরণ করা যে কতখানি বিপজ্জনক তার প্রমাণ রবীন্দ্রানুসারী কবিদের কাব্য। এই কবিদের অনেকের মধ্যে ক্ষমতার অভাব ছিল না কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে অনুসরণ করতে গিয়ে তাদের সলিল সমাধি ঘটল।


রবীন্দ্রনাথ ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত : রবীন্দ্রনাথ তথা রবীন্দ্র কাব্যের ভাব ও প্রকাশভঙ্গির সাফল্য কীভাবে অন্যান্য কবিদের প্রভাবিত করেছে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ সত্যেন্দ্রনাথের কবিতা। সব মানুষই অনুভূতি প্রবণ ও ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের অধিকারী। যখন দেখা যায় এইসব ব্যক্তিগত অনুভূতি কবির প্রকাশ কৌশলে আশ্চর্যভাবে কবিতা হয়ে উঠেছে আর তার প্রকাশটাও আপাতদৃষ্টিতে আয়োজনহীন ও সরল তখন অন্যান্য কবিদের কাছে কবিতা রচনা ব্যাপারটা খুবই সহজ হয়ে যায়। এরকম একটা ব্যাপার ঘটেছিল রবীন্দ্র পরবর্তী কবিদের ক্ষেত্রে। তাঁরা ভাবলেন রবীন্দ্রনাথের মতো যে-কোনো অনুভূতিকেই কাব্যে রূপ দেওয়া সম্ভব। এই প্রলোভন কবিদের কাছে মারাত্মক হয়ে উঠল। কারণ এই কবিরা প্রকৃত অনুভূতির অভাবে কৃত্রিম অনুভূতির কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। বাংলা সাহিত্যে সত্যেন্দ্রনাথ এই রকমই একজন কবি। সত্যেন্দ্রনাথ বড়ো কবি কিংবা ছোটো কবি—এ প্রশ্নের চেয়ে বড়ো প্রশ্ন তিনি খাঁটি কবি কিনা? বুদ্ধদেবের মতে—'সত্যেন্দ্রনাথ-এই খাঁটিত্বই পাওয়া যায় না। তিনি রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত সাজ-সরঞ্জাম কাব্যে প্রয়োগ করেছেন। সেই ঋতুরঙ্গ, পল্লিচিত্র, দেশপ্রেম এবং তার পাশাপাশি পাখি, চাঁদ, ফুল, মেঘ, শিশির প্রভৃতি। কিন্তু রোমান্টিক কবিদের কাব্যে যে স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণময়তা প্রকাশিত হয় সত্যেন্দ্রনাথের কাব্যে তার অভাব ঘটেছে। তাই তার কাব্য কৃত্রিম হয়ে উঠেছে। সত্যেন্দ্রনাথের কাব্যপাঠে আমাদের সন্দেহ হয় তার অনুভূতিটা অকৃত্রিম ছিল কিনা। রবীন্দ্র কাব্যে গভীর ধ্যান ও ভাবুকতা সত্যেন্দ্রনাথের কাব্যে পরিণত হল ভাবালুতায়। সেইসঙ্গে রবীন্দ্র ছন্দের মধুরতা ও মদিরতা সত্যেন্দ্রনাথের হাতে পরিবর্তিত হল মিহি সুর ও ঠুনকো আওয়াজে। লেখক এই কাব্যকে ভেজাল মিশ্রিত কাব্য বলে অভিহিত করেছেন। এই উদ্দেশ্যহীন কসরৎ ও প্রকরণগত ছেলেমানুষি বাংলা সাহিত্যে এক সময় ব্যাপকভাবে দেখা দেয় এবং সেযুগের পাঠক সাধারণকে সাময়িকভাবে মুগ্ধ করেছিল। তবে আশার কথা—এই জাতীয় সাহিত্য প্রচেষ্টা বাংলা কাব্যে কোনো স্থায়ী প্রভাব রেখে যেতে পারেনি।


রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল : রবীন্দ্রনাথের সম্মোহনী শক্তিতে অভিভূত কবিকুল যখন রবীন্দ্রপ্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার পথ খুঁজে পাচ্ছিলেন না, তখন রবীন্দ্রনাথের সর্বনাশা মোহ থেকে মুক্তির পথ নির্দেশ করলেন নজরুল ইসলাম। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা সেই মুক্তির নিশানা। লেখক বুদ্ধদেব বসু নজরুলের কাব্যে কোনো মহৎ কবির দর্শন পাননি। নজরুলও প্রকরণের দিক থেকে অনিবার্যভাবে রবীন্দ্রানুসারী। তাঁর কবিতায় বুদ্ধদেব হৃদয়বৃত্তির প্রগলভতা ও অসংযম লক্ষ্য করেছেন। লেখকের মতে—নজরুলের নিজের মধ্যে কোনো বদল ঘটেনি। তার কুড়ি ও চল্লিশ বছরের লেখার মধ্যে কোনো প্রভেদ ঘটেনি।


নজরুলের কবি স্বভাব ও কবিকর্মে অপরিণতির চিহ্ন লক্ষ্য করলেও যে প্রধান ও প্রবল গুণটি তার কাব্যের সমস্ত ত্রুটি ও দুর্বলতাকে অতিক্রম করে বাংলা কাব্যে তাঁর অনন্যতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে সেটা তাঁর ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য। এই ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যই তাঁর কাব্যকে মৌলিকতা দান করেছে। সত্যেন্দ্রনাথ ও নজরুল ক্ষমতার দিক থেকে সমকক্ষ হলেও সত্যেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রবৃত্তেই আবর্তিত, কিন্তু নজরুল আপন স্বাতন্ত্র্যে দীপ্যমান। লেখকের ভাষায় নজরুল— “রবীন্দ্রনাথের পর অন্য একজন কবি—ক্ষুদ্রতর নিশ্চয়ই কিন্তু নূতন।”


নজরুলের কবি ধর্মের এই মৌলিকতা লেখকের মতে খুব সহজেই ঘটেছিল। এর পেছনে কোনো সাধনার ইতিহাস ছিল না। অন্য কবিদের তুলনায় নজরুলের জীবনের পটভূমি ছিল ভিন্ন ধরনের। এই পটভূমির ভিন্নতাই নজরুলের কাব্যকে স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত করেছে বলে লেখকের বিশ্বাস। নজরুলের মধ্যে একই সঙ্গে মুসলিম ও হিন্দু মানস সমন্বিত হয়েছিল। তাঁর বাল্য ও কৈশোর অতিক্রান্ত হয়েছে লেটো গানের আসরে। তারপর তিনি সৈন্য বাহিনীতে যোগ দিলেন। ভিন্ন পরিবেশে পরিবর্ধিত হওয়ার জন্য তাঁর কাব্যের সুর ও মেজাজ গেল পালটে। কাব্যে এল উদ্দীপনা, এল প্রমত্ত আবেগ। লেখক মনে করেন, ভিন্ন পরিবেশে তাঁর সহজাত প্রবৃত্তিগুলি এত সবলতা প্রাপ্ত হয়েছিল যে—কোনোরকম সাহিত্যিক প্রস্তুতি না নিয়ে শুধু আপন স্বভাবের জোরে রবীন্দ্রনাথের মুঠো থেকে তিনি পালাতে সক্ষম হলেন। লেখকের মতে বাংলাকাব্যে নজরুল কোনো স্থায়ী প্রভাব রেখে যেতে পারেননি। তাঁর কৃতিত্ব এই যে তিনি দেখিয়ে দিলেন যে রবীন্দ্রনাথের পথ ছাড়াও অন্যপথ বাংলা কবিতায় সম্ভব। বাংলা কাব্যে পালাবদল হল।


নজরুল ও পরবর্তীকাল (কল্লোলগোষ্ঠী) : লেখক মনে করেন নজরুল আপন অজান্তেই বাংলা সাহিত্যে নৃতনযুগ সৃষ্টি করেছেন। নজরুলের কাব্য ভাবনায় বুদ্ধদেব রাজনৈতিক ও সামাজিক বিদ্রোহ লক্ষ্য করলেও সাহিত্যের বিদ্রোহ অর্থাৎ ভাব ও রীতির ক্ষেত্রে অভিনবত্বের সাক্ষাৎ পাননি। শিল্পী হিসাবে তিনি ছিলেন আত্মতৃপ্ত, কোনো মহান অসন্তোষ বা দিব্যদাহ তার শিল্পী চিত্তকে ক্ষুব্ধ করে তোলেনি। তবে তিনি পরবর্তী শিল্পীদের চিত্তে অতৃপ্তি ও অসন্তোষকে সংক্রামিত করে দিতে সক্ষম হলেন। নজরুলের রবীন্দ্রদ্রোহিতা দিয়ে নজরুলের পরবর্তী যুগের কবিদের যাত্রা শুরু হল। রবীন্দ্রনাথ যে স্বয়ং সম্পূর্ণ নন তাঁর কাব্যেও যে সীমাবদ্ধতা আছে তা কল্লোল গোষ্ঠীর কবিকুল অনুভব করলেন। এই প্রথম মনে হল–‘তাঁর কাব্যে বাস্তবের ঘনিষ্ঠতা নেই সংরাগের তীব্রতা নেই। নেই জীবনের জ্বালা যন্ত্রণার চিহ্ন। মনে হল তাঁর জীবনদর্শনে মানুষের অনস্বীকার্য শরীরটাকে তিনি অন্যায়ভাবে উপেক্ষা করেছেন। কল্লোল গোষ্ঠীর বিদ্রোহের মধ্যে আতিশয্য ছিল, আবিলতা ছিল। তৎসত্ত্বেও লেখক মনে করেন রবীন্দ্রনাথকে সত্যরূপে পাওয়ার জন্য ও বাংলা কাব্যের মুক্তির জন্য এই বিদ্রাহের প্রয়োজন ছিল। এরা অনেকেই রবীন্দ্রকাব্য পাঠে আপ্লুত হলেও বিশ্বাস করতেন বাংলা কাব্যে নূতন কিছু করতে হলে রবীন্দ্রনাথ থেকে দূরে থাকা অবশ্য কর্তব্য। প্রথম দিকে রবীন্দ্র বিরোধিতার আতিশয্যে কিছু জঞ্জাল সৃষ্টি হয়েছিল, কিন্তু একটা স্থিতিলাভের পর সুধীন্দ্রনাথ সম্পাদিত ‘কবিতা’ ও ‘পরিচয়’ পত্রিকায় নবীন কবিরা নিজেদের প্রতিভার স্বাক্ষর মুদ্রিত করে দিলেন।


এই নবীন কবিগোষ্ঠীর কবিতায় দেখা দিল সংহতি ও বুদ্ধিদীপ্ত মননশীলতা। এই নবীন কবিরা ভাষা ও রীতির ক্ষেত্রে আনলেন নবীনত্ব। সাধারণ জীবন ও ঘরোয়া পরিবেশ থেকে ভাষা সংগৃহীত হল। পদ্য ও গদ্য তার পরিচিত রাজপথ ছেড়ে জনতার পরিচিত পথে পরিক্রমণ শুরু করল। গদ্য ও পদ্যের মিলনে সৃষ্টি হল গদ্য কবিতা, অবশ্য রবীন্দ্রনাথ এক্ষেত্রেও বাংলা সাহিত্যের প্রথম পুরুষ, বাংলা সাহিত্যে বিষয় বৈচিত্র্য দেখা গেল। আর সেইসঙ্গে সৃষ্টি হল অভিনব রূপ ও রীতি।


অবশ্য আধুনিক কবিদের কবিকর্ম একপথে চলেনি, তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক ব্যবধান ছিল দুস্তর। দৃশ্য, গন্ধ, স্পর্শময় জীবনানন্দ ও অবক্ষয়ী জীবনের রূপকার সুধীন্দ্রনাথ দত্তের, মনন নির্ভর কাব্যের মধ্যে স্বরূপতার বিপুল প্রভেদ, আবার অমিয় চক্রবর্তীর আধুনিক কাব্যজগৎ ওই সম্পূর্ণ নতুন পথের দিশারি। এঁরা বাংলা কাব্যের সম্পদকে নানাভাবে পরিবর্ধিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথকে এড়িয়ে গিয়ে নূতন ধরনের কাব্য সৃষ্টিই এঁদের মূল উদ্দেশ্য। রবীন্দ্র সাহিত্যের মোহময় প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে তাঁরা যে স্বাধীন চিত্ততার পরিচয় ছিলেন তাঁর মূল রসদ তাঁরা সংগ্রহ করেন পাশ্চাত্য সাহিত্য-ভাণ্ডার থেকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পাশ্চাত্য কাব্য সাহিত্যে যে ক্লান্তি সংশয় ও হতাশার সুর শ্রুত হল সাগর পারের কবিদের কাব্যে, আধুনিক বাঙালি কবিরাও তার শিকার হলেন এবং বাংলা কাব্যে অনিবার্যভাবে সংক্রমিত হল সেই হতাশা, সংশয় ও ক্লান্তি। এরফলে দেবতার সুর ও মেজাজ গেল পালটে। সুন্দরের উপাসনা নয়, রোমান্টিসিজমের মোহাঞ্জন নয়, এক অপরিচিত পৃথিবীর হতাশা জর্জর আবহাওয়া বাংলা কাব্যে নবীনত্বের স্বাদ বহন করে আনল। অবশ্য এই নবীন ভাবনার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথও প্রকাশ্যে অথবা অপ্রকাশ্যে এদের কাব্যের অস্তিত্বের মধ্যে বিজড়িত হয়ে রইলেন। সুধীন্দ্রনাথ বর্ণনাময় রাবিন্দ্রিক বাক্যবিন্যাস প্রকাশ্যভাবেই চালিয়ে দিলেন। আর অমিয় চক্রবর্তী রবীন্দ্র-জগৎ-এর অধিবাসী হয়ে, রবীন্দ্র দর্শনে আস্থাশীল হয়ে প্রকরণগত বৈচিত্র্য আনলেন বাংলাকাব্যে। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের বিপুলচিত্তকে সাহিত্যের বৈচিত্র্য সৃষ্টির কাজে লাগালেন। রবীন্দ্রনাথের ঋণকে অস্বীকার না করেও এরা প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বাংলা কাব্যের দিগন্তকে প্রসারিত করে দিলেন। লেখকের মতে— “এঁরা ইতিহাসে শ্রদ্ধেয় হবেন অন্তত এই কারণে যে বাংলা কবিতার একটি সংকটের সময় এরা উপলব্ধি করেছিলেন যে, তৈরি অবস্থায় কোনো কাব্যকে পাওয়া যায় না তাকে জীবন দিয়ে সন্ধান করতে হয়।” তাই লেখকের সিদ্ধান্ত, ‘কোনোকিছুকে জীবন দিয়ে সন্ধান করতে হয় তা লেখকের শ্রমে উপার্জনীয়।