“আমি বিশুদ্ধবাদী নই”— বক্তব্যটির প্রসঙ্গ এবং তাৎপর্য বুঝিয়ে দাও। বিশুদ্ধবাদী হওয়ার কারণে প্রাবন্ধিক কী ধরনের অভিমত প্রকাশ করেছেন, তা বিশদভাবে নির্দেশ করো।

প্রাবন্ধিক সত্যেন্দ্রনাথ যে ধরনের আধুনিক ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন দেখেছেন, তা পরিচালনার মূল নীতিগুলি কী হওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন? প্রাবন্ধিকের ধারণা কতটা বাস্তবসম্মত, সে বিষয়ে তোমার অভিমত দাও।


প্রাবন্ধিক সত্যেন্দ্রনাথ বসু ‘শিক্ষা ও বিজ্ঞান’ প্রবন্ধে শিক্ষা ক্ষেত্রে মাতৃ ভাষার ব্যবহারের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তের প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি মনে করেন, ভারতবর্ষে এমন একটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা উচিত যার বিশেষ ঝোঁক থাকবে বিজ্ঞান ও সমাজতত্ত্ব বিষয়ক চর্চার ক্ষেত্রে। এই বিদ্যাচর্চার আধুনিক সমাজ জীবনের পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অগ্রগতি আজ বিস্ময়কর রূপে বিকাশিত হয়েছে। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে গেলে এদেশে বিজ্ঞান শিক্ষার উৎকর্ষ সাধিত হওয়া উচিত। এই উৎকর্ষের জন্য প্রয়োজন মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা। মাতৃভাষার মাধ্যম ছাড়া শিক্ষা সম্পূর্ণতা পায় না। ব্রিটিশ আমল থেকেই এদেশে দেখল—প্রবর্তিত শিক্ষার মেরুদণ্ড ইংরেজি ভাষা। কিন্তু পরাধীন ভারতবাসী ইংরেজি ভাষায় মোহাচ্ছন্ন হয়ে নিজেদের মাতৃভাষাকে অবহেলা করেছে। তার ফলে ইংরেজি ভাষার বিজ্ঞান ও সমাজতত্ত্ব শিক্ষার অসম্পূর্ণতাও তাদের মধ্যে ধরা পড়েছে। বছর বছর এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবশক্তি ও যুবশক্তির শোচনীয় অপচয় ঘটেছে, তা পরীক্ষার ফলাফলে ব্যর্থতার সংখ্যা দেখে প্রমাণিত হয়। কিন্তু পদার্থবিদ্যার আলোচনা চক্রে যোগদান করতে গিয়ে লেখক দেখেছেন কীভাবে সেখানে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাকে প্রবলভাবে প্রচলিত করা হয়েছে। জাপানি বিশ্ববিদ্যালয়ে জাপানি ভাষায় আলোচনা ও গবেষণা হচ্ছে। লেখক এইসব সমৃদ্ধ বিজ্ঞানীদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। সেখানে আলোচনা চক্রে গিয়ে লেখক দেখেছেন কীভাবে দোভাষীর মাধ্যমে বিজ্ঞানের বিমূর্ত ও জটিল বিষয় বিদেশি বৈজ্ঞানিকের মনের জগতে পৌঁছে দেওয়া যায় কেবলমাত্র জাপানি ভাষার মাধ্যমে। মাতৃভাষাকে অবহেলা না করে তার দ্বারা বিজ্ঞান শিক্ষাকে সম্পূর্ণ করার প্রয়াস দেখে লেখক ভারতবর্ষের বিজ্ঞান শিক্ষার পক্ষে পদ্ধতি বদলের গুরুত্বের কথা চিন্তা করেছেন। ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে যে বিজ্ঞান শিক্ষা এখানে চালু আছে, তা ত্রুটিপূর্ণ ও অসম্পূর্ণ। ফলে ছাত্রদের ক্ষতি হচ্ছে। দেশের ক্ষতি হচ্ছে। দেশের জ্ঞানচর্চার প্রগতির পক্ষে তা বিঘ্নকারক। এই কারণে লেখক এখানে প্রস্তাব করেছেন এমন এক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেখানে বিজ্ঞান ও সমাজতত্ত্ব গঠিত হবে, এবং তা পড়ানো হবে কোনো ভারতীয় ভাষার মাধ্যমে। এই সিদ্ধান্ত যুক্তিসঙ্গত, বাস্তবসম্মত ও দেশের প্রতি হিতকারী। জাতীয় পতাকার অগ্রগতিতে দেশের মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। বিজ্ঞান এ যুগের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। দেশে বিদেশে মানুষের বিজ্ঞান শিক্ষায় সমৃদ্ধ হয়ে নব নব আবিষ্কারে বিস্মৃত করে তুলেছে। এই বিস্ময়কর প্রগতি দেখে ভারতবাসীর পক্ষে ও বিজ্ঞানচর্চার গুরুত্ব লেখক অনুভব করেছেন। কিন্তু এরজন্য বিদ্যালয় চাই, যে বিশ্ববিদ্যালয়ে চর্চা ও আলোচনা, শিক্ষাগত পঠন-পাঠন, উচ্চতর গবেষণা ও অধ্যাপনার মাধ্যমে বিজ্ঞান বিদ্যা ছাত্রদের কাছে পরিবেশিত হবে। আর এই বিজ্ঞান শিক্ষার সঙ্গে সমাজ তত্ত্বের জ্ঞান চাই। তা না থাকলে বিজ্ঞান জ্ঞান সম্পূর্ণ হবে না। তবে নানা প্রদেশের নানা অধিবাসী সেইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে। এইসব শিক্ষার্থীর শিক্ষার মাধ্যম হবে তাদের মাতৃভাষায়। কারণ মাতৃভাষা শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না। কারণ বিদেশি ভাষার বিষয়কে সহজে আয়ত্ত করা যায় না ও শিক্ষণীয় বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করা যায় না। এই কারণে তিনি একটি সর্ব ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে চেয়েছেন যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠবে যজ্ঞক্ষেত্র। এখানে শিক্ষাই হয়ে উঠবে যজ্ঞের বিষয়। আর শিক্ষক হয়ে উঠবে ঋষি, ছাত্রগণ হবে ঋত্বিক। এই যজ্ঞের উদ্দেশ্য হবে মানুষের সার্বিক অগ্রগতি।


কিন্তু দুঃখের বিষয়—বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে জ্ঞানচর্চার নামে যে শিক্ষা দেওয়া হয় তা একরকম ভস্মে ঘি ঢালার মতন। পাঠক্রম ও শিক্ষণ পদ্ধতির মধ্যে কোনো আত্মিক সেতু বন্ধন তো নেই-ই, এমনকি যে শিক্ষা বিতরণ করা হচ্ছে তা একরকম কেতাবী শিক্ষা, ব্যবহারিক জীবনে যা মানুষের কাছে কোনোও যোগসূত্র রচিত করে না—যাতে সমাজ সত্যতার প্রেক্ষিতে জাতি ক্রমশ উন্নততর আধুনিক ভারতবর্ষ গঠনে দ্রুত অগ্রসর হতে পারে অন্যান্য বিজ্ঞান মনস্ক দেশের সঙ্গে সমান তালে পাল্লা দিয়ে। মাতৃভাষার বিজ্ঞানচর্চার পরিধির বিস্তার যেমন আজও ঘটেনি, তেমনি সুযোগ্য শিক্ষার অভাব ও ব্যবস্থাপনার ত্রুটির জন্য আমাদের দেশের অনেক মেধাবী ছাত্রছাত্রী বাইরের দেশে গিয়ে বাধ্য হয়ে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এরজন্য আমাদের দেশ ও জাতি ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। সেসব মেধাবী উন্নত ছাত্র ছাত্রীদেরকে দেশের ভেতরে ধরে রেখে উপযুক্তভাবে ব্যবহার করার কোনো প্রচেষ্টা নেই। সর্বত্রই যেন ‘গয়ং গচ্ছ’ ভাব। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির যেন একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে চিরাচরিতভাবে ডিগ্রি প্রদান করা। এমনকি, মানুষের যে নৈতিক চরিত্র গঠন চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু তাও এখন লক্ষ্যে পৌঁছয়নি, পুরনো ধ্যান-ধারণা বর্জন করে যেমন ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষ প্রকৃতি সংস্কার মুক্ত হতে পারেনি, তেমনি পারেনি প্রকৃত জ্ঞানলাভ করে স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক সর্বস্বতার জাত-পাত, হিংসা বিদ্বেষ থেকে নিজেদেরকে সম্পূর্ণভাবে সরিয়ে দিয়ে কর্মমুখর হয়ে উন্নত আধুনিক ভারত গঠনে তৎপর হয়ে উন্নতির সোপানে আরোহণ করতে।