'নজরুল ইসলাম থেকে সুভাষ মুখোপাধ্যায় দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী অবকাশ— এই কুড়ি বছরে বাংলা কবিতার রবীন্দ্রাশ্রিত নাবালক দশার অবসান হল'—‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক' প্রবন্ধের আলোকে রবীন্দ্রাশ্রিত নাবালক দশার অবসান ঘটার দিকটি ব্যাখ্যা করো।

বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব অবিস্মরণীয়। দীর্ঘদিন রবীন্দ্রনাথের অনুসরণে বাংলা সাহিত্য সরস্বতীর সাধনা আরাধনায় নিয়োজিত থাকতে দেখি কবি শিল্পীদের। রবীন্দ্রচেতনার সুর বাংলা সাহিত্যের আকাশ বাতাসকে দারুণভাবে আপ্লুত করে রেখেছিল। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত কিছুটা বৈচিত্র্য আনতে চেয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু এ ব্যাপারে তিনি কার্যকরী সাফল্য পাননি। রবীন্দ্রনাথের পরে নজরুল ইসলামই বাংলা সাহিত্যে প্রথম মৌলিক কবিরূপে নিজেকে মেলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। নজরুল পরবর্তী সময়কালে বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্র প্রভাব মুক্তির প্রয়াস প্রোজ্জ্বল রূপ ধারণ করে। আসলে নজরুল থেকে সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দুই মহাসময়ের মধ্যবর্তী অবকাশে বাংলা কাব্য-কবিতার জগতে রবীন্দ্রাশ্রিত পটভূমিকার পরিবর্তন সংঘটিত হয়। সেই কারণে বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন—'নজরুল ইসলাম থেকে সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী অবকাশ—এই কুড়ি বছরে বাংলা কবিতার রবীন্দ্রাশ্রিত নাবালক দশার অবসান হল।'


রবীন্দ্রপ্রভাব বাংলা সাহিত্যকে একমুখী করে তুলেছিল। ফলে সকলেই রবীন্দ্রসুরে তাঁদের সাহিত্য-বীণা ঝঙ্কৃত করতে চাইলেন। আধুনিককালের কবিরা রবীন্দ্র-প্রভাব মুক্ত হয়ে নিজেদের মেলে ধরতে প্রাণপণ প্রয়াস নিলেন। এ পথের প্রথম সার্থক পথিক বিদ্রোহী‌ কবি নজরুল ইসলামকে মনে হয় রবীন্দ্রনাথের পরে অন্য একজন কবি– ক্ষুদ্রতর নিশ্চয়ই কিন্তু নতুন। এই যে নজরুল ইসলাম তাঁর সম্পর্কে তাই প্রাবন্ধিক বলিষ্ঠভাবেই বলেছেন— “নজরুল রবিতাপের চরম সময়ে রাবীন্দ্রিক বন্ধন ছিঁড়ে বোরোলেন, বলতে গেলে অসাধ্যসাধন করলেন....।" এর থেকে আমরা একথা অবশ্যই বুঝতে পারি নজরুল‌ রবীন্দ্রনাথের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। কোনোরকম সাহিত্য প্রস্তুতি না নিয়ে তিনি রবীন্দ্রবৃত্তের বাইরে নিজেকে হাজির করেন এবং রবীন্দ্রানুসারী কবিদের তুলনায় তাঁর স্বাতন্ত্র্যের ক্ষেত্রকে স্পষ্টচিহ্নিত করেন।


রবীন্দ্রবৃত্তের বাইরে বেরিয়ে এসে যাঁরা সাহিত্য সরস্বতীর সাধনা করেছিলেন তাঁদের মধ্যে নজরুলের পাশাপাশি মোহিতলাল এবং যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের কথা স্মরণ করতে পারি। মোহিতলাল মজুমদারকে বলা হয় আধুনিক কবিদের পুরোধাপুরুষ। রবীন্দ্রিক বৃত্তের বাইরে এসে এসব কবি অসাধ্যসাধন করেছেন। হঠাৎ করে বাংলা সাহিত্যে পালা বদলের ঘণ্টাধ্বনি বেজে ওঠেনি। এরজন্য ক্রমবিকাশের স্তর উত্তরণ করে আসতে হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের মুঠো থেকে বেরিয়ে এসে নজরুল প্রথম মৌলিক কবির দাবির প্রতিষ্ঠা দেন। ক্রমে ক্রমে মোহিতলাল, যতীন্দ্রনাথ, কল্লোলগোষ্ঠীর শিল্পীরা মোড় ফেরার ঘণ্টা বাজিয়েছেন। এ বিষয়ে প্রবন্ধকারের ভাষ্য “এই যে নজরুল রবিতাপের চরম সময়ে রাবীন্দ্রিক বন্ধন ছিঁড়ে বেরোলেন, বলতে গেলে অসাধ্যসাধন করলেন, এটাও খুব সহজেই ঘটেছিল। এর পিছনে সাধনার কোনো ইতিহাস নেই, কতকগুলো আকস্মিক কারণেই সম্ভব হয়েছিল এটা ..... যেহেতু তাঁর পরিবেশ ছিল ভিন্ন, এবং একটু অন্য ধরনের, আর যেহেতু সেই পরিবেশ তাঁকে পীড়িত না করে, উলটো আরও সবল করেছিল তাঁর সহজাত বৃত্তিগুলোকে, সেইজন্য, কোনোরকম সাহিত্যের প্রস্তুতি না নিয়েও শুধু আপন স্বভাবের জোরেই রবীন্দ্রনাথের মুঠো থেকে পালাতে পারলেন তিনি, বাংলা কবিতায় নতুন রক্ত আনতে পারলেন। তাঁর কবিতায় যে-পরিমাণ উত্তেজনা ছিল, সে পরিমাণে পুষ্টি যদিও ছিল না, তবু অন্তত নতুনের আকাঙ্ক্ষা তিনি জাগিয়েছিলেন ; তাঁর প্রত্যক্ষ প্রভাব যদিও বেশি স্থায়ী হল না, কিংবা তেমন কাজেও লাগল না, তবু অন্তত এটুকু তিনি দেখিয়ে দিলেন যে রবীন্দ্রনাথের পথ ছাড়াও অন্য পথ বাংলা কবিতায় সম্ভব। যে আকাঙ্ক্ষা তিনি জাগালেন, তার তৃপ্তির জন্য চাঞ্চল্য জেগে উঠল নানা দিকে, এলেন ‘স্বপন-পসারীর’ সত্যেন্দ্র দত্তীয় মৌতাত কাটিয়ে, পেশিগত শক্তি নিয়ে মোহিতলাল, এল যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের অগভীর কিন্তু তখনকার মতো ব্যবহারযোগ্য বিধর্মিতা, আর এইসব পরীক্ষার পরেই দেখা দিল “কল্লোল গোষ্ঠীর নতুনতর প্রচেষ্টা ; বাংলা সাহিত্যের মোড় ফেরার ঘণ্টা বাজলো।"


নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যে নতুন যুগ এনেছিলেন। মূলত বিদ্রোহের পথ বেয়েই এসেছিল সেই নতুন যুগ। এইসময় বিশেষভাবে প্রয়োজন ছিল এই বিদ্রোহের এই বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে বাংলা কবিতার মুক্তিচেতনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একদিকে বাংলা কবিতার মুক্তির জন্য প্রয়োজন ছিল এই বিদ্রোহের এবং অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথকেও সত্য করে পাবার জন্য এই বিদ্রোহের অনস্বীকার্যতা সমর্থিত। কল্লোল গোষ্ঠীর কবিরা রবীন্দ্রনাথকে দূরে সরিয়ে রাখলেন। আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য নূতন পথ অনুসন্ধানে ব্রতী হলেন। তাঁরা অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন রবীন্দ্রাশ্রিত নাবালক দশার অবসান না ঘটাতে পারলে সুনাম সুখ্যাতির সঙ্গে বাংলা কাব্যসরস্বতীর আঙিনায় তাঁদের ঠাঁই হবে না। উদাহরণ দিয়ে বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রবন্ধকার রসিকতার ছলে বলেছেন—“ফজলি আম ফুরলে ফজলিতর আর চাইব না, আতা ফলের ফরমাস দেবো.... অর্থাৎ রবীন্দ্রতর হতে গেলে যে রবীন্দ্রনাথের ভগ্নাংশ মাত্র হতে হয় এই কথাটা ধরা পড়লো এতদিনে; কল্লোল গোষ্ঠীর লক্ষ্য হয়ে উঠল রবীন্দ্রতর হওয়া।"


সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ‘পরিচয়' এবং 'কবিতা' পত্রিকাতে নবীন কবিদের নব চেতনার সাক্ষ্য নিয়ে এলেন। এলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র তার হার্দ্য গুণ নিয়ে। এভাবে যাঁরা এই সময়কালে এসে হাজির হলেন তাঁরা প্রত্যেকেই রবীন্দ্রনাথকে সমস্যারূপে গ্রহণ করে রবীন্দ্রচেতনা থেকে মুক্তি প্রসারী ভাবনায় ভাবিত হলেন। জীবনানন্দ দাশও রবীন্দ্রচেতনা থেকে বেরিয়ে এসে নূতন পথে, নূতন কলাকৌশলে নিজেকে মেলে ধরতে চাইলেন। আসলে বিবর্তন ঘটল বাংলা সাহিত্যে। রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রাশ্রিত কবিগোষ্ঠীর যে অধ্যায়টা গড়ে উঠেছিল দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী অবকাশে তার অবসান ঘটল। একদিকে নজরুল অন্যদিকে সুভাষ মুখোপাধ্যায়—দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী এই কুড়ি বছরের অবকাশে বাংলা কাব্য-কবিতা রাবীন্দ্রিক নাবালকত্ব কাটিয়ে বিবর্তনের স্বাভাবিক ধারায় পরবর্তী স্তরে উন্নীত হল।


বুদ্ধদেব বসু নিজে আধুনিক কবি। সমকালে তিনি সমলোচক-শ্রেষ্ঠ রূপেও স্বীকৃতি লাভ করেন। বাংলা কাব্যের ক্রমবিবর্তন ধারা তাঁর নখদর্পণে। বিশেষ করে রবীন্দ্রসমকাল এবং রবীন্দ্র পরবর্তী সময়কালে বাংলা কাব্য-কবিতার গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর ধ্যান-ধারণা স্পষ্টোজ্জ্বল। রবীন্দ্রনাথ বাংলা কাব্য ধারাতে তাঁর ব্যাপক প্রভাব রেখে রবীন্দ্রানুরাগী একটি গোষ্ঠী গড়ে তোলেন। নজরুল থেকে সুভাষ মুখোপাধ্যায় পর্যন্ত কবিশিল্পীরা অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন যে রবীন্দ্র প্রভাবমুক্তি ব্যতীত কাব্যকবিতার জগতে বিবর্তনের পরবর্তী ধাপ গড়ে তোলা অসম্ভব। কল্লোল গোষ্ঠীর কবিশিল্পীরা এই অসাধ্যসাধন করলেন। নজরুল, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, মোহিতলাল মজুমদার, জীবনানন্দ দাশ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের দল এই সত্য উপলব্ধি করেছিলেন যে, বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রাশ্রিত নাবালক দশার নিশ্চিত অবসান ঘটাতে হবে। তাঁদের এই উপলব্ধি কার্যকর হয়। 'রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক' প্রবন্ধে তাই প্রাবন্ধিক যথার্থ সত্যের স্বীকৃতি দিয়ে লিখেছেন—“নজরুল ইসলাম থেকে সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী অবকাশ—এই কুড়ি বছরে বাংলা কবিতার রবীন্দ্রাশ্রিত নাবালক দশার অবসান হল। এরপর যাঁরা এসেছেন এবং আরও পরে যাঁরা আসবেন, রবীন্দ্রনাথ থেকে আর কোনো ভয় থাকলো না তাদের, সে ফাঁড়া পূর্বোক্ত কবিরা কাটিয়ে দিয়েছেন।”