বহু ভাষার দেশ ভারতবর্ষ সম্পর্কে অন্নদাশংকর রায়ের বক্তব্য পরিস্ফুট করে হিন্দি ‘জাতীয় ভাষা’ রূপে গ্রহণ করা চলে কিনা সে বিষয়ে আলোচনা করো।

যে দেশে বহু ধর্ম বহু ভাষা' প্রবন্ধে বহু ভাষা ও সম্প্রদায়ের বিভক্ত ভারতের ভাষা সমস্যা সমাধান ও সংহতি বিধানে প্রাবন্ধিক যে পথ নির্দেশ করেছেন তার সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো।


প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক ও বিশিষ্ট মনীষী অন্নদাশংকর রায় ১৯৬২ সালে রচনা করেন ‘যে দেশে বহু ধর্ম বহু ভাষা' নামক প্রবন্ধটি। প্রশাসনিক কাজে ব্যপৃত থেকে ভারতবর্ষের নানান স্থানে ঘুরে বেড়ানোর সুবাদে তিনি নানারকম রাষ্ট্রনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ভাষা ধন, জাতিগত সমস্যার বা প্রভেদের সম্মুখীন হয়েছিলেন। দ্রষ্টার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে অল্পকালের মধ্যেই তিনি যে আত্মোপলব্ধির সোপানে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন— যে দেশে বহু ধর্ম বহু ভাষা' তার উৎকৃষ্ট ফসল। এই সংক্ষিপ্ত রচনায় প্রকাশ পেয়েছে সমকালীন ভারতবর্ষের একটি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা ও সমাধানের উপায়। পরাধীন ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ সূত্রে তিনি স্বচক্ষে দেখেছিলেন দেশভাগ ও স্বাধীনতা লাভ। উপলব্ধি করেছিলেন ধর্ম ও ভাষা নিয়ে ভারতবর্ষের সার্বভৌম পরিকাঠামো কোন পরিণতিতে পৌঁছাতে পারে। নিজের মুখেই একদা স্বীকার করেছিলেন : “যদিও আমার প্রধান কাজ সৃষ্টি, একটির পর একটি সৃষ্ট করি আর একটুর পর একটু মুক্ত হই, তবু আমাকে কখনো কখনো সৃষ্টির কাজ সরিয়ে রেখে দেশের ও কালের ভাবনার ভাগ নিতে ও দিতে হয়। নইলে আমি হব পলায়নবাদী।” কলমকে তরবারি করে সাহিত্যের অঙ্গনে বীর যোদ্ধার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন বলেই এমন একটি সমাজতত্ত্ব বিষয়ক প্রবন্ধ আমরা উপহার পেয়েছিলাম।


স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর বহু ভাষা-ভাষীর দেশ ভারতবর্ষে সর্বাগ্রে যে বিষয়টি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল–জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় ভাষা কী হওয়া উচিত। প্রবন্ধের শুরুতেই লেখক জানিয়েছেন “যে দেশে বহু ধর্ম সে দেশের মূল নীতি কী হওয়া উচিত ?” সত্যই তো যে দেশে বহু ধর্ম এবং বিভিন্ন ভাষার সমাহার সেখানে নির্দিষ্ট কোনো ভাষাকে সরকারি বা জাতীয় ভাষা রূপে আখ্যাত করতে গেলে নানান সমস্যার সম্মুখীন হতেই হবে। বিশেষ করে ১৯৪৯ খ্রিঃ সংবিধান সভা দেবনাগরী হরফে লেখা হিন্দিভাষাকে সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দেওয়ায় অল্পদিনের মধ্যে সারাদেশ জুড়ে যে ধর্মীয় সমস্যা উদ্ভূত হয়েছিল, বোধ করি সে দিকে লক্ষ্য রেখে প্রাবন্ধিক এমন মূল্যবান রচনায় সমর্থ হয়েছিলেন। প্রবন্ধটির মূল বক্তব্য ছিল : ১। বহুধর্মাবলম্বী ও বহু ভাষা-ভাষী দেশের মূল নীতি। ২। ধর্ম নিরপেক্ষ ভারতবর্ষের ভাষাগত সমস্যা। ৩। ভারতবর্ষে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে হিন্দিকে মর্যাদা দানের ক্ষেত্রে সুবিধা ও অসুবিধা। ৪। ইংরেজি ভাষার মর্যাদা ও ব্যবহার যোগ্যতা বিষয়ে প্রাবন্ধিকের সিদ্ধান্ত।


স্বাধীন দেশের সংবিধান রচনার ঊষালগ্নে ভারতবর্ষকে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র রূপে চিহ্নিত করা হয়েছিল তারই নিরিখে কোনো নির্দিষ্ট ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অভিষিক্ত করা অসমীচীন। এই প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক কয়েকটি উদাহরণ জড়ো করেছেন পাকিস্তান ও বার্মা সংখ্যা গরিষ্ঠদের ইচ্ছানুক্রমে ইসলাম ও বৌদ্ধ রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হওয়ার ফলে সংখ্যালঘিষ্ঠরা তা অবহেলিত হয়ে পড়েছিল। ফলত অল্পদিনের মধ্যেই সেখানে একনায়কতন্ত্র কায়েম হয়েছে, তৈরি হয়েছে বিভিন্ন সংকট। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্ররূপে আখ্যাত হলেও সবার সমান অধিকার সেখানে পর্যুদস্ত। লেখকের ভাষায় : “সেকুলার স্টেট যতই দৃঢ় হবে গণতন্ত্রও ততই দৃঢ় হবে। অনেকেই এটা হৃদয়ঙ্গম করেছেন, কিন্তু সকলে এখনো করেননি। পাকিস্তানকে মুসলিম রাষ্ট্র করার সপক্ষে যুক্তি রেখে বলেছেন—যদি ভারতবর্ষ হিন্দু রাষ্ট্র হয় পাকিস্তান ও বার্মার মতো ভারতবর্ষেও গণতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে পড়বে। কারণ অপরের প্রতি মর্যাদা বা সক্ষম অধিকার না মানতে পারলে মানুষ আত্মকর্তৃত্বের ক্ষমতা হারায়। বার্মাতে সামরিক শাসকের কড়া চাবুক বিজয়ী নেত্রী সুফিকে গৃহবন্দি করেছেন, বর্তমান পাকিস্তানেও অনুরূপ অবস্থা, এর একটাই উৎস—একটি রাষ্ট্রে একটি বিশেষ কোনো ধর্মকে প্রাধান্য দেওয়া।


এর পরেই প্রাবন্ধিক দেখালেন, যে দেশে বহু ভাষা তার মূল নীতি কী হওয়া আবশ্যক। এই ভাষাগত সমস্যা নিয়ে উদাহরণ টানলেন—বেলজিয়াম ও সুইটজারল্যান্ডের। বেলজিয়ামের প্রতিষ্ঠা হয় ১৮৩০ সালে। রাষ্ট্রভাষা রূপে স্বীকৃতি পায় ফরাসি। কিন্তু দশ বছরের মধ্যেই ফ্লেমিশদের হস্তক্ষেপে ও দীর্ঘ আন্দোলনে ফরাসির সঙ্গে ফ্লেমিশ ভাষা ও বেলজিয়ামে সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়। অনুরূপ, সুইটজারল্যান্ডে, ফ্রান্সে ১৮৭৪ সালের শাসনতন্ত্র মেনেই জার্মানি, ফরাসি ও ইটালিয়ান তিনটি ভাষাই জাতীয় ভাষা রূপে আখ্যাত পায়। কিন্তু এই ছোট্ট দুটি দেশের তুলনায় বহুগুণ বৃহৎ যে দেশ, স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর সেই ভারতবর্ষে ১৪টি থেকে ১৫টি প্রাদেশিক ভাষা মুখ্য হয়ে ওঠে, অথচ এদেশ যখন পরাধীন ছিল একটি মাত্র বিদেশি ভাষা ইংরাজির দ্বারা সমস্ত কাজ চলত। তারই নিরিখে বহুভাষার দেশ ভারতবর্ষের একটি মাত্র রাষ্ট্রীয় ভাষা থাকবে ‘ইংরাজি’ এমন একটা ধারণা সবার মধ্যে বলবৎ হয়ে উঠেছে। কারণ কোনও ভারতীয় ভাষাকে এই মর্যাদায় ভূষিত করলে তা হবে অন্যান্য ভাষাকে অবমাননা। বেলজিয়াম ও সুইটজারল্যান্ডের মতো শুরু হবে দিকে দিকে ভাষা আন্দোলন। ২১ ফেব্রুয়ারি তাই স্মরণীয় দিন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান দ্বিখণ্ডিত হয়েছে এই ভাষার জেরেই।


ইংরেজিকে বিদেশি ভাষা রূপে অবজ্ঞা প্রদর্শন করে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিক থেকে‌ হিন্দিভাষাকে জাতীয় ভাষা হিসাবে স্বীকৃত করার পিছনে সুবিধা ও অসুবিধা দুটিই বিদ্যমান। হিন্দি অধিকাংশের ভাষা ও ভারতবর্ষের ভাষা হলেও এর বিপক্ষে কতগুলো যুক্তি থেকেই‌ যায়—যেহেতু এই ব্যবস্থা হিন্দি বনাম ইংরেজি নয় সেহেতু অহিন্দিভাষীরা বিশেষত-তামিল নাগা কাশ্মিরী বাঙালিরা স্বতঃস্ফূর্ত হিন্দিকে মেনে নিতে পারবে না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সবার অধিকার সমান কাজেই অন্যান্য ভাষাকে পিছনে সরিয়ে রেখে কেবলমাত্র হিন্দিকেই গুরুত্বদান বিশৃঙ্খলার নামান্তর। এছাড়া মাতৃভাষা যাদের হিন্দি তাঁরা অন্যদের তুলনায় বাড়তি সুবিধা পাবে তাতে অসহিষ্ণুতা ক্রমশ বাড়তেই থাকবে। সেই কারণে অন্নদাশংকর রায়ের অভিমত : “ইংরেজিকে যারা বিদায় করবে তারা কি ইংরেজির একমাত্র উত্তরাধিকারীকেও একদিন ঘাড় থেকে ও নামাতে চাইবে না?”


ইংরেজির উত্তরাধিকারী সত্যই যদি হিন্দি ভাষা হয়, সেক্ষেত্রে প্রাবন্ধিক তাঁর সুচিন্তিত মত প্রদর্শন করেছেন। ভাগ না করে যেমন ভোগ করা যায় না তেমন হিন্দির পাশাপাশি এমন কোনো ভাষাকে রাখতে হবে যা সর্বজন গ্রাহ্য। বিদেশি বলে ইংরাজিকে সরাতেই হলে হিন্দির সঙ্গে অপর ভাষাটিই হবে অহিন্দিভাষীদের উপযুক্ত। কারণ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ক্ষেত্রে ইংরেজির গুরুত্ব সর্বাধিক, হিন্দির ক্ষেত্রে ততটা নয়। ইংল্যান্ডের অনুকরণেই ভারতীয়রা অভ্যস্থ হয়ে পড়েছে। শাসন ব্যবস্থা, আইন-আদালত, পার্লামেন্ট, স্কুল-কলেজ, অফিস ইত্যাদিতে ইংরেজির ব্যাপক ব্যবহারে। সেখানে হিন্দিকে প্রাধান্য দিলে অহিন্দি ভাষা সহজেই পিছিয়ে পড়বে। প্রাবন্ধিক আরও বলেছেন : পরাধীনতার জিগির তুলে ইংরেজিকে এমনভাবে হঠাতে নেই, কারণ এখন ইংরেজ নেই, ভবিষ্যতেও থাকবে না। তাই পরীক্ষা ওপ্রতিযোগিতার মাধ্যম রূপে ইংরেজিকেই মেনে নেওয়াই শ্রেয়। এমনটা হল হিন্দির মতো আশা করি এমনটি বলা যাবে না : “ইংরেজি মাধ্যমরূপে ব্যবহৃত হলে তামিলরা বাঙালিরা জিতে যাবে হিন্দিভাষীরা তাদের সঙ্গে পেরে উঠবে না।"


বহুধর্মের দেশ ভারতবর্ষে কেবলমাত্র বহুজনের ভাষা বলেই হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা রূপে বিবেচিত করলে যে কঠোর সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে তা ব্যক্ত করার পর লেখক সহজ সমাধানের লক্ষ্যে ইংরেজিকে সরকারি ভাষা রূপে সমর্থন জানান এবং এই ইংরেজির প্রতি সওয়াল করে চলেছেন : গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সব মানুষের সমান অধিকার থাকে তাহলে সমানভাবে সুযোগ ভোগ করার জন্যে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে ইংরেজিকে রাখাই শ্রেয়, যদি হিন্দিতে অন্য মাধ্যম করা হয় পাশাপাশি বাংলা, তামিল, তেলেগু, মালায়াম প্রভৃতি চোেদ্দ পনেরোটি ভাষাকে ও মাধ্যমরূপে রাখতে হবে। এছাড়া পরাধীন ভারতে যদি ইংরেজির দ্বারা কাজ হয়ে থাকে স্বাধীন ভারতে না চলার কারণ কী থাকতে পারে। তাকে যদি বিদেশি বলেই আপত্তি জাগে তাহলে তার উত্তরাধিকার ভাষা রূপে একমাত্র হিন্দিকে বেছে নেওয়া উচিত হবে না। হয়তো হিন্দি সহজেই শেখা যায়, তবে শেখার বিষয় কম, সে তুলনায় ইংরেজিতে শেখার বিষয় বেশি। এমন মূল্যবান বিষয়কে হঠানোর বিপক্ষে প্রাবন্ধিক একরকম কটূক্তি করে বলেছেন : “যেখানে কারোর কোনো ক্ষতি নেই সেখানে হিন্দি আরাম করে বলার অধিকার নেই। জাতীয়তার জন্যে তাকেও ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।”


পরিশেষে, ভাষাগত দিক দিয়ে উদ্ভুত সমস্যার হাত থেকে সহজভাবে উত্তরণের আশায় লেখকের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে হয় স্বাধীনতা লাভের পর সংবিধান রচনার সময় ইংরাজির পাশাপাশি হিন্দিকে সরকারি ভাষা করার জন্যে ‘কনষ্টিটুয়েন্ট অ্যাসেমব্লি’ সদস্যদের অধিকাংশ যেহেতু সমর্থন জানিয়েছিলেন সেহেতু হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে জানা যেতে পারে, তবে : “ইংরেজির কাজ হবে ষ্ট্যান্ডার্ড ঠিক করে দেওয়া বা ঠিক করতে সাহায্য করা। সে কাজ হিন্দির দ্বারা হতে পারে না। “তাছাড়া প্রশাসনিক দিক থেকে ইংরেজির গুরুত্ব অপরিসীম। আজ দিকে দিকে যেখানে মাধ্যম হিসাবে ইংরেজি উঠে যাচ্ছে, সেখানে বিষয় হিসাবে ইংরেজি থেকে যাচ্ছে কারণ জনগণের ইচ্ছা। এ থেকে সহজেই অনুমেয় কেবল মাত্র অন্ধ জাতীয়তা বোধ টেনে ইংরেজির মতো বিশ্বের সেরা ভাষাকে অবহেলা করে পরিহার করা, অবজ্ঞা করা আর যাইহোক সহজ ও সুস্থ মনের পরিচয় নয়। প্রাবন্ধিকের ভাষায় বলতে হয় ঃ “ইংরেজির দীপশিখা নিভে গেলেই যে হিন্দির দীপশিখার, বাংলার দীপশিখার, অন্যান্য ভারতীয় ভাষাগুলির দীপশিক্ষার দেওয়ালী হবে এটা একপ্রকার নঞর্থক চিন্তা। বরঞ্চ ইংরেজির দীপ যতক্ষণ জ্বলছে জ্বলতে দাও, তার সাহায্যে নিজেদের দীপ জ্বালিয়ে নাও। যা দিয়ে তাকে অকালে নিবিয়ে দিলে পরে হয়তো দেখবে নিজেদের দীপও নিবু নিবু।"