পুরাতন সাহিত্যের ইহা একটি অদ্ভুত গুণ।—কোন গুণের কথা বলা হয়েছে এবং সেই গুণ রূপকথার মধ্যে কতটা প্রকাশিত? রূপকথা আমাদের মনে কতটা স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করতে পারে, সে সম্পর্কে লেখকের দেওয়া অভিমত বিচার করো।

রূপকথায় রচয়িতার কোনও নামকরণ হয় না। সমগ্র লৌকিক সাহিত্যের মতো এখানেও লেখক একটি সমগ্র জাতির পিছনে আত্মগোপন করে আছে। রূপকথা কোনও ব্যক্তি বিরোধের কথা না, সমগ্র জাতির প্রাণের কথা, অন্তরের আশা-আকাঙ্ক্ষা এতে ধ্বনিত হয়ে উঠেছে। পুরাতন সাহিত্যের এই গুণের কথাই এখানে বলা হয়েছে।


রূপকথার মধ্যে পুরাতন সাহিত্যের গুণ : প্রাবন্ধিক ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় রূপকথাকে নামহীন কবির রচনা ও জাতীয় জীবনের আত্মার স্পন্দন বলে মনে করেছেন। আধুনিক কালের সাহিত্য থেকে রূপকথা আলাদা। কারণ এটি একলা কবির একক মনের মাধুরী প্রকাশ নয় বা একক ব্যক্তির নিভৃত আবেগ কল্পনার প্রকাশ নয়। তাই রূপকথায় পৃথকভাবে রচয়িতার নাম নেই। আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেছেন—'লোক সাহিত্যের প্রধান ধর্মই এই যে, ইহা সজীব বহুযুগের বহুমনের মধ্য দিয়া ইহা প্রবাহিত হয় বলিয়া নতুন নতুন মনের স্পর্শে ইহার জীবনীশক্তি রক্ষা পায়।' রূপকথা ও লোকসাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত।


রূপকথার রচয়িতা নামহীন জনকবি। মহাকাব্যের বিশাল দেহে যেমন অসংখ্য নামহীন জনকবি নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব মিশিয়ে দিয়ে জাতীয় জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষাকেই প্রতিষ্ঠিত করেছেন। রূপকথাও সেই পুরাতন সাহিত্য ধারার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।


Like all traditional literature, were originally the possession of everyone, Adults and children alike. একটি উদার বিশাল অনাসক্ত ভাবলক্ষণ রূপকথায় স্পষ্ট। এখানে মহাকাব্যের মতো সমগ্র জাতি জাতীয় জীবনের কথাই ধ্বনিত হচ্ছে।


‘রামায়ণ' প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, মহাকাব্য জাতীয় সাহিত্য, তা ব্যক্তি প্রতিভার সৃষ্টি নয়। যুগে যুগে কালে কালে নানা কবি তাদের সাহিত্য প্রতিভাকে এক মহাকাব্যের মধ্যে সঞ্চিত করে রেখেছে। রামায়ণের মতো রূপকথাও তেমনি যুগ যুগ ধরে এই সমগ্র কল্পনারাজ্যের মধ্যে প্রয়াত হয়েছে। রূপকথার আবেদন শিশুকল্পনার জগতে। ঠাকুমার স্নেহসিক্ত হৃদয়ে, ত্রাস-কৌতূহল কল্পিত জীবনে রূপকথার আস্বাদ পাওয়া যায়। এই রস্বাস্বাদ চিরন্তন। কালে কালে শিশুহৃদয় এই রসাস্বাদ লাভ করে বেঙ্গমা-বেঙ্গমীর কাহিনিতে, শ্বেতবসন্তের কাহিনিতে। তেপান্তরের মাঠে রাজপুত্রের ছুটে চলে যাওয়া, রুদ্ধগৃহ স্বল্পদীপালোকে বন্দিনী রাজকন্যার অন্তহীন ক্রন্দন সবই মানুষের হারিয়ে যাওয়া শৈশবকে জাগিয়ে তোলে। রূপকথার ধারা আজও অব্যাহত। মানুষের চিরন্তন আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের প্রতীক রূপকথা। এর আদিস্রষ্টা কে এবং কীভাবে সৃষ্টি করল তা আজ ইতিহাসের অন্ধকার গর্ভে লীন। তবু রূপকথা প্রেম, বীরত্ব, নির্যাতিত কাহিনি নিয়ে ছড়িয়ে পড়ল দেশ দেশান্তরে। এই গতির প্রাবল্যে এর আদি স্রষ্টা হারিয়ে গেলেও মানুষের আত্মবিস্তারের ইতিহাস এখানে ধরা পড়েছে। এভাবে পুরাতন সাহিত্যের গুণ রূপকথায় প্রকাশিত।


আমাদের মনে রূপকথার স্থায়ী প্রভাব : আমাদের প্রত্যেকের জীবনে গোচরে অগোচরে সংস্কাররূপে রূপকথার স্থায়ী প্রভাব আছে। মানবজীবন তথা মানবমনে এর প্রভাব অসমান্য। এর আকর্ষণ কেবল শিশুমনেই বিস্তৃত নয়, বয়স্ক মানুষও রূপকথার প্রতি তাদের কৌতূহল প্রকাশ করেন। এর কারণ হিসাবে প্রাবন্ধিক বলেছেন, কল্পনার প্রতি মানুষের আকর্ষণ তীব্র ও শাশ্বত। মানুষের সভ্যতা, সংস্কৃতি, শিল্প সবই কল্পনার সৃষ্টি। প্রাত্যহিক জীবনের নীরস কর্মেকাণ্ডে, যান্ত্রিক কাজের একঘেয়েমি জীবনে মানুষ যখন ক্লান্ত হয়ে যায়, তখন সে কল্পলোকের আশ্রয় নেয়। কল্পনার দিব্যদৃষ্টিতে জীবনে বৈচিত্র্য আছে। রূপকথা এই কল্পনার আকার। এইজন্য রূপকথার রসাস্বাদে মানুষ কল্পনার ডানা মেলে তেপান্তরের মাঠে ছুটে চলেন। তার কল্পলোকে মনিমানিক্যের ঘনঘটা। রূপকথা আমাদের জীবনের স্থায়ী প্রভাব ফেলেছে।


প্রথমত, অনেক কবিই তাঁর কবি প্রতিভার প্রথম কল্পনার উন্মেষ ঘটান অতি শৈশবে রূপকথার মায়াময় জগতে। প্রত্যেক শিশুমনই রূপকথার সাহসী বীরপুরুষ রূপে কল্পনার অশ্বে পাড়ি জমায় সাতসমুদ্র তেরো নদীর পারে। ইংরেজি সাহিত্যে ওয়ার্ডসওয়ার্থ তাঁর কল্পনাশক্তিকে জাগ্রত করার জন্য রূপকথার আশ্রয় নিয়েছিলেন। প্রাবন্ধিক বলেছেন— ‘আমাদের মধ্যে যাহারা কবি প্রতিভার অধিকারী তাঁহারা অনেক সময় এই রূপকথার নিকট তাঁহাদের কল্পনার উন্মেষ সম্বন্ধে প্রথম সাহায্য লাভ করেন।


দ্বিতীয়ত, প্রাত্যহিক জীবনের সংকীর্ণ সীমা ছাড়িয়ে অচেনাকে চেনবার, অজানাকে জানবার আগ্রহ রূপকথার রাজ্য থেকেই গড়ে ওঠে।


তৃতীয়ত, মনোজ্ঞ বিশ্লেষণের দ্বারা জানা যায় মানুষের অন্তরের স্থায়ী কল্পনালোক রচনা করতে রূপকথার প্রভাব অসামান্য মানুষের জীবনের ট্র্যাজেডি তার অপ্রাপ্যনীয়ের দিকে যাত্রা। যা কিছু দুষ্প্রাপ্য, যা কিছু দুর্বোধ্য ও রহস্যময় তার প্রতি আমাদের মন ধাবিত হয়। মনের এই যাত্রারা শক্তি যোগায় রূপকথা।


চতুর্থত, রূপকথা সমগ্র তর্ক, যুক্তি, বাস্তবতার প্রভাব অতিক্রম করে আমাদের মনে একটা ছায়াস্নিগ্ধ সুরম্য কল্পলোক তৈরি করে। কেননা, মানুষের সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান সত্ত্বেও তাদের অন্তরে একটা কুহেলিয়াময় জগত আছে যেখানে রূপকথার আবেদন যথেষ্ট।


পঞ্চমত, অকবি, সাধারণ মনেও রূপকথার প্রভাব অবিরত কাজ করে চলেছে। প্রাত্যহিক দিনযাপনের গ্লানির মধ্যেও রূপকথার কল্পলোক, গতিশীল প্রাণের প্রবাহকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।


প্রাবন্ধিক বলেছেন—“সেই বর্ষারাত্রির রূপকথার নিবিড় মোহময় স্মৃতি আমাদের অন্তরে শুকতারার ন্যায় সমুজ্জ্বল হইয়া উঠে ও আমাদের বৈচিত্র্যহীন পৌরজীবনের ওপরও তাহার মায়াময় ইন্দ্রজাল সংক্রামিত করে।”


শিশুর মতো বড়োদেরও শিশুমন থাকা বাঞ্ছনীয়। যা তাকে বাস্তবজীবনে বাঁচার প্রেরণা যোগাবে। এদিক থেকে আমাদের মনে রূপকথার স্থায়ী প্রভাব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।