পটুয়া শিল্প' প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক যামিনী রায়ের মূল বক্তব্য পরিস্ফুট করো।

শিল্পী যামিনী রায় শুধু বাংলার বা ভারতের গৌরব নয়, ভারতের বাইরেও তাঁর শিল্পের সমান কদর, শিল্পী হিসাবে তাঁর স্বাতন্ত্র্য তাকে অমর করে রেখেছে। রেখায় ও রঙে, দৃষ্টিভঙ্গিতে ও সৃষ্টিতে যামিনী রায় অসাধারণ শিল্পী মূলত পটুয়া শিল্পী হিসাবেই তাঁর খ্যাতি। কবি বিষ্ণু দে তাঁর সম্পর্কে একদা মন্তব্য করেছেন–“তিনি খুঁজেছিলেন মৌলিক আকারের ও সমবর্তী রঙের উচ্ছল রূপায়ণ এবং তা তিনি স্বচক্ষে দেখলেন বাংলার পুতুলের চৈতন্যরূপে নিশ্চিত ঋজুতায় তাঁর ঘরের ও সর্বদেশের শিশুদের শুদ্ধ ভাবগঠনের দৃষ্টিতে, আদিম বর্ণপক্তির রঙিন শক্তিতে।” মন্তব্যটি যথার্থই। প্রাবন্ধিকের ‘পটুয়া শিল্প' প্রবন্ধটি পাঠ করলে তেমনই বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। আলোচ্য প্রবন্ধটি পাঠ করলে যে বিষয় ক-টি পরিস্ফুট হয় তা হল-বাংলাদেশে চিত্রকলার স্বরূপ, পটুয়া শিল্প সম্বন্ধে প্রচলিত কুসংস্কার, ইংরাজ আগমনের পূর্বে পটুয়া শিল্পের রূপ, পটুয়া শিল্পের ভিত্তি, পটুয়া শিল্পের ও ইউরোপের পুরাণ নির্ভরতা, পুটয়া শিল্পের আঙ্গিক, ইউরোপীয় শিল্পের ভগ্নদশা ও তার কারণ—ইত্যাদি বিষয় আলোচ্য প্রবন্ধে পরিলক্ষিত হয়।


বাংলার চলিত চিত্রকলার সাধারণ বর্ণনা দিয়ে প্রবন্ধটির শুরু। বাংলাদেশের চিত্রকলা দু’ভাবে চালু ছিল, এক হল ঘরোয়া বা আটপৌরে শিল্প-যা নিত্য নৈমিত্তিক জীবনের সাধারণ রূপ। অন্যদিকে আর এক শিল্প হল পালপার্বণের ছবি, দেবমূর্তি, প্রতিমা ইত্যাদি। বাংলাদেশের আটপৌরে শিল্প পটুয়া শিল্প সম্পর্কে প্রচলিত একটা কুসংস্কার আছে, কেননা অনেকে মনে করেন যে পটুয়া ছবি আর কালিঘাটের ছবি দুটি সমার্থক। এর কারণও আছে— যখন শহর কলকাতা গড়ে উঠেছিল তখন স্বাভাবিকভাবেই একদল লোক গ্রাম থেকে এসে তীর্থস্থান কালিঘাটের কাছে এসে বাসা বাঁধলো। তাদের মধ্যে কিছু মানুষ ছবি আঁকত ও প্রতিমা তৈরি করত। শহরে মানুষের চাহিদানুযায়ী এইসব শিল্পীরা ছবি এঁকে পাশাপাশি উৎসব অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে আয়োজিত মেলায় সেইসব ছবি বিক্রয় করত। গ্রামীণ শিল্পীরা শিল্পের মতো করে ছবি ও পুতুল তৈরি করতে করতে তাঁরা শহরের ‘শহরের মানুষের’ চাহিদার শিকার হয়ে পড়ল। ফলে তারা গ্রামীণ শিল্পে শহরের ছোঁয়া নিয়ে এল, তাই যামিনী রায়ের অভিমত—“এই ভাবে নগর জীবনের সংস্পর্শে আসার দরুণ, নগরজীবনকে অবলম্বন করে আঁকার দরুণ, সে জীবনের ছাপ এতে এসে পড়ল, এই ছবি তাই আসল পটুয়া ছবি নয়, এর ভাষা রয়ে গেল গ্রাম্য, এর বক্তব্য এল শহর।"


ইংরাজ আগমনের বহু পূর্বে, যখন শহর কলকাতা গড়ে ওঠেনি তখন গ্রামে যে আটপৌরে ছবি প্রচলিত ছিল তা হল পটুয়া শিল্প। সেই পটুয়া শিল্পের প্রাণ হরণ করল শহরের আভিজাত্য ও বিদেশিদের রুচি ও চাহিদা, অথচ এই পটুয়া শিল্পকে যেসব আদিম শিল্পীরা বাঁচিয়ে রেখেছিলেন তাদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হল। যুগের চাহিদার সব কিছুর পরিবর্তন হয় পটুয়া শিল্পেরও তাই হল, পরিবর্তিত ধারায় পটুয়া শিল্পের স্বাভাবিকতা নষ্ট হল। “তারপর অবশ্য দিন যত গেল, পটের ছবি বাংলা দেশে চলিত রইল পটুয়া মহলের নিছক অভ্যাস হিসাবে, এবং শিল্পীরা হয়ে রইল অজ্ঞানেরও অধম।” তবে পটুয়া শিল্পের ভিত্তি দানা বেঁধেছিল পুরাণের ওপর। এর ভিত্তি অন্য কোনো প্রাগৈতিহাসিক চিত্রে পাওয়া যায় না। এই পটুয়া শিল্প পুরোপুরি সংহত পুরাণের ওপর স্থাপিত হওয়ায় তার ভিত্তি ছিল সুদৃঢ়। তাই পটুয়া শিল্পে যে জটায়ু সে তো আর মরলোকের কোনো বিশেষ পাখি নয়, তবুও পাখির মূল কথাটা তার মধ্যে রয়েছে। যেখানে সে হনুমান সে তো আর কোনো ধামর নয়। তার জন্ম ইতিহাস, তার ক্রিয়াকলাপ কোনোটাই মর্ত্যলোকের নয়। অথচ না হয়েও তাকে ছবিতে বানর বলে চিনতে অসুবিধা হয় না। আর সেই জটায়ু, সেই বানর, সেই রাক্ষস সবের মধ্যে একটা আশ্চর্য সংহতি রয়েছে। এই যে মর্ত্যলোকের অবিকল জিনিস না হয়েও তা এক আশ্চর্য বিশ্বাসের জগৎ-তাই-ই হল পটুয়া শিল্পের বৈশিষ্ট্য।


পটুয়া শিল্পের এই যে পুরাণ নির্ভরতা তা-ই এই শিল্পের স্থায়িত্বের মূল ভিত্তি রচনা করেছিল। তাছাড়া শিল্পের পক্ষে এই জাতের একটা পৌরাণিক জগতে বিশ্বাস করবার অনিবার্য প্রয়োজনীয়তা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। যেমন—ইউরোপের প্রাগৈতিহাসিক শিল্পের সঙ্গে আমাদের দেশের পটুয়া শিল্পের স্থায়ীত্বের মূলে ছিল পুরাণ ভাবনা। যে পুরাণ ভাবনা ইউরোপে পরিবর্তিত হওয়ায় সেখানে প্রাগৈতিহাসিক শিল্পের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়েছে। অন্যদিকে পটুয়া শিল্পের ভিত্তি যে পুরাণ ভাবনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল তা পরিবর্তিত না হওয়ায় পটুয়া শিল্পে স্থায়িত্ব লক্ষ করা যায়। ইউরোপের সংস্কৃত শিল্প বহুদিন খ্রিস্টের পুরাণের বিশ্বাস অটুট রাখতে পেরেছিল। যতদিন এই বিশ্বাস অটুট ছিল ততদিন শিল্পও স্থায়ী হয়েছিল। কিন্তু সেই পুরাণ বিশ্বাস যখন একটা সময় ভেঙে গেল এবং সামাজিক বিশ্বাস নতুন রূপ নিল তখন শিল্প পুরাণ ভাবনাকে ত্যাগ করায় অশান্তি জুটল। এই সময় ইউরোপে গগাঁ, ভ্যানগগ গ্রামের সারল্য ও খ্রিস্টের পুরাণ ভাবনাকে আঁকড়ে ধরবার শেষ চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ফলে পশ্চিম ইউরোপের সাম্প্রতিক শিল্পের একটা অস্থিরতা দেখা দেয়, তার কারণ খ্রিস্টকে কেন্দ্র করে সে পুরাণ ভাবনা তা যখন ভেঙে গেল তখন নতুন কোনো জীবন নির্ভর পৌরাণিক বিশ্বাসের জন্য শিল্পীরা মরিয়া হয়ে সন্ধান করতে লাগল, কিন্তু আধুনিক মনে কোনো জীবন পুরাণকে শিল্পীরা খুঁজে পেলনা-যা স্থায়ীত্ব দিতে পারে বা আগের পুরাণ ভাবনার বিকল্প হতে পারে। ফলে শিল্পে দেখা গেল অস্থিরতা, যা অস্থিরতা পটুয়া শিল্পে ছিল না। এই শিল্পের বিবর্তন হলেও তা পুরাণ ভাবনা বিশ্বাস তাকে বাঁচিয়ে রাখল। তবে পটুয়া শিল্পের সাম্প্রতিক রূপের মধ্যে শিল্পীরা পুরাণ বিশ্বাসকে নিছক অভ্যাসে পরিণত করে ফেলে গতানুগতিক পটচিত্র এঁকে চলল।


পটুয়া শিল্পের আঙ্গিক নিয়েও আলোচনা করেছেন যামিনী রায়। সাহিত্যে যেমন বিষয়বস্তু ও আঙ্গিক বা কন্টেন্ট ও ফর্ম তেমনি শিল্পে প্রসঙ্গ বা ভাববস্তু এবং আঙ্গিক এই দুয়ের মেলাবন্ধনেই শিল্পের পূর্ণতা। পটুয়া শিল্পের প্রসঙ্গের আলোচনার পর এই শিল্পের আঙ্গিক নিয়ে আলোচিত হয়েছে। ভাবের সঙ্গে ভাষার যোগে যেমন গড়ে ওঠে সাহিত্য তেমনি শিল্পের ভাবনাও রূপ পায় আঙ্গিকের যথার্থতায়। বাংলার পটুয়ারা পৌরাণিক জগতের বিশ্বাসকে এমন ঘরোয়া রূপে ফুটিয়ে তুলেছিল যে এই শিল্প এর জন্যে এত প্রাণের সামগ্রী হয়ে উঠেছিল। বিশ্বাস যদি গভীর হয়, ভাষা যদি সহজ সরল হয় এবং স্বতঃস্ফূর্ত তাহলে শিল্প হয় স্বাভাবিক ও গতিময়। পটুয়া শিল্পের আঙ্গিকে তাই কোনো ঘোর প্যাঁচ নেই, সেই সুক্ষ্ম কারিগরি, এমনকি নেই কোনো বিলাসের চিহ্ন, অথচ এই আটপৌরে রূপের পাশেই ছিল পোশাকি শিল্প। তবুও এই সংস্কৃত, সাধুরূপী পোষাক শিল্প আটপৌরে শিল্পকে গ্রাস করেনি। পটুয়া শিল্প তাই ইউরোপের যে-কোনো প্রাগৈতিহাসিক শিল্পের থেকে স্থায়িত্ব পেল। তাই প্রাবন্ধিকের সশ্রদ্ধ মন্তব্য—“আর কোনও দেশের প্রাগৈতিহাসিক শিল্পী এ অবস্থা পায়নি-না ছিল তাদের পৌরাণিক জগতে স্থিতি, না জানতো তারা পৌরাণিক জগতের ভাষা। আর তাই শিল্পের সত্য অজ্ঞানে আবিষ্কার করেও তাকে ধরে রাখতে ওরা পারল না।"


সর্বোপরি এ কথাও জানাতে হয়, উক্ত দল আজ পৃথিবীর সর্বত্র। কারণ গ্রাম আর গ্রাম নেই, তাই তার ঘরোয়া আটপৌরে রূপও আশা করা বৃথা। যাকে ঘরোয়া, গ্রামীণ জীবন বলা হত সেখানে লেগেছে কৃত্রিমতার ছোঁয়া, পুরাতন পুরাণ বিশ্বাস হারিয়ে যাচ্ছে চর্চার অভাবে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও শিল্পের প্রভাব এমন সর্বগ্রাসী যে আমাদের আসল শিল্প ও সংস্কৃতি বিস্মৃতির অতল তলে তলিয়ে যাচ্ছে। চর্চার অভাব একদিকে, অন্যদিকে আড়ম্বর ও জৌলুষের প্রতি ঐকান্তিক আকর্ষণ এবং সেই সঙ্গে কৃত্রিমতা যখন মানুষকে বদলে দিচ্ছে, তখন তার শিল্প ও সংস্কৃতি সে আদিরূপ হারিয়ে ফেলবে তা বলা বাহুল্য। বিশেষ করে ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার চাপে আমাদের পুরাতন শিল্প সংস্কৃতি, ধ্যান-ধারণা সব বিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। এমনকি বর্তমানে যে স্বরূপ শিল্প সংস্কৃতিতে প্রতিভাত হচ্ছে তার মধ্যে না আছে পুরাতন ভাবধারা না আছে নতুন ভাবধারা। এই পাঁচমিশেলি সংস্কৃত এবং তা থেকে উত্থিত শিল্পভাবনা যে 'বকচ্ছপ’ ও ‘হাসজারু’ রূপ নিয়ে উপস্থিত হচ্ছে তাতে পটুয়া শিল্পের রূপ শুধু স্মৃতিতেই থাকবে বা কোনো গ্যালারিতে স্থান পাবে মাত্র।