'আর বাঙালি কবির পক্ষে, বিশ শতকের তৃতীয় এবং চতুর্থ দশকে প্রধানতম সমস্যা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ’—‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক' প্রবন্ধে বুদ্ধদেব বসুর এ জাতীয় মন্তব্যের কারণ নির্দেশ করো।

বাংলা কাব্য সাহিত্যের অত্যুজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক রবীন্দ্রনাথ। স্বমহিমায় মহিমান্বিত তিনি। রবি কিরণে তখন সমগ্র বাংলা সাহিত্যাকাশ আলোকিত। এই সময়কালে আবির্ভূত অধিকাংশ কবিশিল্পী রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে তাঁর আলো নিয়ে আলোকিত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ আসলে তখন বাংলা সাহিত্যের মধ্যে যে ভাব, ধ্যান-ধারণা, স্বপ্নদর্শন গড়ে তুলেছিলেন তার বাইরে যাওয়ার সাধ্য কারও ছিল না বলেই সকলেই তখন রবীন্দ্রবৃত্তে পরিভ্রমণরত। এই পরিবেশ পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালি কবিদের পক্ষে রবীন্দ্রনাথই প্রধানতম সমস্যা রূপে দেখা দেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে বুদ্ধদেব বসু ‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক' প্রবন্ধের মধ্যে লিখেছেন 'বাঙালি কবির পক্ষে, বিশ শতকের তৃতীয় এবং চতুর্থ দশকে প্রধানতম সমস্যা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ।


বিস্ময়কর ব্যাপক বিস্তৃত প্রতিভা নিয়ে বিশ্বকবির বাংলা কাব্য সাহিত্য আবির্ভাব। তিনি আসলে একটা সময় এককভাবে একচ্ছত্র অধিকারে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রখর প্রোজ্জ্বলতায় অন্য কবিশিল্পীরা নিতান্তরূপে ম্রিয়মান। তাঁদের সমস্যার কেন্দ্রবিন্দুতে রবীন্দ্রনাথ। তাঁরা না পেরেছেন রবীন্দ্রনাথকে পুরোপুরি অস্বীকার করতে আবার রবীন্দ্রনাথকে অন্তর থেকে পুরোপুরি গ্রহণ করতেও ছিল তাঁদের কিন্তুবোধ। বাংলা সাহিত্যের এই সময়কালে আবির্ভূত কবি শিল্পীদের সামনে তাই জ্বলন্ত সমস্যা হিস রবীন্দ্রনাথই হাজির হলেন। দৃষ্টি এড়ায়নি এ ব্যাপারে বুদ্ধদেব বসুর সচেতনতা। তিনি বিশ শতকের তিন ও চারের দশকের যথার্থ সমীক্ষায় অন্যান্য কবিদের কাছে রবীন্দ্রনাথের অবস্থান প্রসঙ্গ ব্যাখ্যায় তাই বলে ওঠেন—“বলা বাহুল্য সাহিত্যের ক্ষেত্রে এইরকম পরিবর্তন কালপ্রবাহেই ঘটে থাকে, কিন্তু তার ব্যবহারগত সমস্যার সমধানে বিভিন্ন কবির ব্যক্তি বৈশিষ্ট্যেরই প্রয়োজন হয়। আর বাঙালি কবির পক্ষে, বিশ শতকের তৃতীয় এবং চতুর্থ দশকে প্রধানতম সমস্যা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ।...এঁদের লেখায় যেরকমেরই যাকিছু পাওয়া যায়, রবীন্দ্রনাথের ঠিক সে জিনিসটি পাই না। কেমন করে রবীন্দ্রনাথকে এড়াতে পারব—অবচেতন কখনো বা চেতন মনেই এই চিন্তা কাজ করে গেছে এঁদের মনে।”


এই সময়কালে যে সমস্ত আধুনিক কবিদের আবির্ভাব ঘটেছিল তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক বৈসাদৃশ্য ছিল পর্যাপ্ত। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে তাঁরা একে অপরের বিপরীত মেরুতে অবস্থানরত। তা সত্ত্বেও এইসব কবি রবীন্দ্রনাথকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে তাঁদের নিজস্ব বলয় গড়ে তোলার প্রয়াস নিলেন। কেউ কেউ অবশ্য রবীন্দ্রনাথকে আশ্বস্ত করে মুখোমুখি দাঁড়াবার শক্তি অর্জন করেছেন। অনেকে রাবীন্দ্রিক বাক্য বিন্যাস তাঁদের মধ্যে প্রকাশ্যে হাজির করেছেন। অনেকের ক্ষেত্রে আবার দেখা যায় রবীন্দ্রনাথের জগতের অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও বিস্ময়কর প্রকরণে বৈচিত্র্যের সমাবেশ ঘটিয়েছেন। যে-কোনো ভাবেই হোক না কেন রবীন্দ্রনাথই যে তাঁদের চিন্তা-চেতনার, সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু–একথা এইসব শিল্পী হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। এঁদের বিষয়ে বুদ্ধদেব বসু তাঁর বিদগ্ধ মননশীল ভাবনাসূত্র থেকে তাই লিখেছেন—“আমাদের আধুনিক কবিদের মধ্যে পারস্পরিক বৈসাদৃশ্য প্রচুর—কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুস্তর ; দৃশ্যগন্ধস্পর্শময় জীবনানন্দ আর মনন প্রথা অবক্ষয়চেতন সুধীন্দ্রনাথ দুই বিপরীত প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন, আবার এ দুজনের কারো সঙ্গেই অমিয় চক্রবর্তীর একটুও মিল নেই। ... কেমন করে রবীন্দ্রনাথকে এড়াতে পারব অবচেতন কখনো বা চেতন মনের এই চিন্তা কাজ করে গেছে এঁদের মনে; কোনো কবি, জীবনানন্দের মতো রবীন্দ্রনাথকে পাশ কাটিয়ে ঘুরে গেলেন, আবার কেউ কেউ তাঁকে আত্মস্থ করেই শক্তি পেলেন তার মুখোমুখি দাঁড়াবার .....এঁদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্বন্ধ সূত্র অনুধাবন করলে ঔৎসুক্যকর ফল পাওয়া যাবে; দেখা যাবে, বিষ্ণু দে ব্যঙ্গানুকৃতির তীর্যক উপায়ে সহ্য করে নিলেন, দেখা যাবে সুধীন্দ্রনাথ, তাঁর জীবন-ভুক্ পিশাচ-প্রমথর বর্ণনায়, রাবীন্দ্রিক বাক্যবিন্যাস প্রকাশ্যভাবে চালিয়ে দিলেন; আবার অমিয় চক্রবর্তী, রবীন্দ্রনাথেরই জগতের অধিবাসী হলেও তার মধ্যে বিস্ময় আনলেন প্রকারণগত বৈচিত্র্যে, আর কাব্যের মধ্যে নানারকম গদ্য বিষয়ের আমদানি করে। অর্থাৎ এঁরা রবীন্দ্রনাথের মোহনরূপে ভুলে থাকলেন না, তাকে কাজে লাগাতে শিখলেন।


বাংলা কাব্য কবিতার জগতে রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব বাস্তবিকপক্ষে যুগান্তকারী এক ঘটনা। রবীন্দ্রনাথ বিশ শতকের তিন ও চারের দশকে আবির্ভূত কবিশিল্পীদের রীতিমতো সমস্যায় ফেলে দিয়েছিলেন সর্বতোভাবে। প্রতিষ্ঠার প্রোজ্জ্বলতায় তিনি বাংলা সাহিত্যের সমগ্র আকাশকে এমনভাবে আচ্ছাদিত করে দিয়েছিলেন যে অন্য কবিরা তখন রবীন্দ্রবৃত্তেই আত্মহারা। তাঁদের অভিপ্রায় ও অভিলাষ যদিও রবীন্দ্র-মুক্তিপ্রয়াস তথাপি সে কাজটি তাঁদের পক্ষে সহজসাধ্য হয়নি। সমালোচক বুদ্ধদেব বসু এমতাবস্থায় বাঙালি কবিদের পক্ষে প্রধানতম সমস্যা হিসাবে রবীন্দ্রনাথকে দেখিয়ে যথার্থ সত্যেরই স্বীকৃতি দিয়েছেন। বাস্তবিকপক্ষে আমরাও সমালোচকের কণ্ঠে কণ্ঠে মিলিয়ে বলতে পারি 'বাঙালি কবির পক্ষে, বিশ শতকের তৃতীয় ও চতুর্থ দশকে, ‘প্রধানতম সমস্যা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ।