“আধুনিক সাহিত্য” প্রবন্ধে লেখক আধুনিকতার স্বরূপ কীভাবে পরিস্ফুট করেছেন? একইকালে সব দেশে সমভাবে যে আধুনিকতার বাণী স্ফূর্তি লাভ করে না, সে কথা তিনি বিভিন্ন উদাহরণের সাহায্যে কীভাবে বুঝিয়েছেন, তা নিজের ভাষায় উপস্থিত করো।

‘আধুনিক সাহিত্য' কথাটিতে কালধর্মের কথাটি যেমন দ্যোতিত, তেমনি ভাবধর্মিতার বিষয়টিও উপেক্ষণীয় নয়। আধুনিক সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য মানববাদী চিন্তার প্রকাশ। মানুষের কথা বলতে গিয়ে আধুনিক যুগের শিল্পীগণ মানুষের দেশ কাল, সামাজিক পরিবেশ প্রতি বেদনাকে যথাযোগ্য ভূমিকায় স্থাপন করেছেন। আধুনিক যুগের সাহিত্য নবজাগরণের যুগের মানব চিন্তাকে ললাট তিলক রূপে গ্রহণ করে আত্মপ্রকাশ করেছে। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি মানস-প্রবণতা, ইউরোপীয় সাহিত্যের ব্যাপক প্রভাব, সংস্কার উদ্দীপ্ত যুক্তিভিত্তিক মনোভঙ্গি, আত্মপ্রকাশের দুর্দমীয় কামনা প্রভৃতি এ যুগের মানুষের মনকে প্রণোদিত করেছে, অপরদিকে তেমনি সাহিত্যের ভিত্তিভূমিটি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।


অনেকেই বলেন, স্ব-কালে সকলেই আধুনিকতার প্রেক্ষাপটে বিষয়টি বিচার করলে উক্তিটিকে যুক্তিযুক্ত বলে মনে করা যায় না। আধুনিকতা কোনো কালগত ব্যাপার নয়, এটি একটি মানস-ক্রিয়া, কালের দিক থেকে সেকালই হোক, কিংবা একালই হোক, দেশ-কাল পাত্র অনুযায়ী সেই বিশেষ মনোভঙ্গিটি যে সাহিত্যে প্রকাশ পায়, তাকেই আমরা আধুনিক সাহিত্য রূপে অভিহিত করতে পারি। তাই প্রাচীনকালেও যেমন আধুনিক সাহিত্য রচিত হওয়া সম্ভবপর ছিল, তেমনি আধুনিককালে রচিত কোনো সাহিত্যও অনাধুনিক হতে পারে।


এখন যে মানস-ক্রিয়ার কথাটি বলা হল, তা একান্তভাবে দেশ-কাল-নিরপেক্ষ নয়। নানা জাতীয় ঘটনার টানা-পোড়েনে বিভিন্ন সমাজের, বিভিন্ন শ্রেণির গঠনে পার্থক্য থাকতে পারে বলেই সমাজাধীন ব্যক্তির মানস-গঠনেও সেই পার্থক্য বর্তমান থাকা স্বাভাবিক। তাই সাহিত্য বিচারে কোনো সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড নেই। এই পার্থক্য যেমন ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে থাকতে পারে, তেমনি কালে কালে দেশে-দেশেও ঘটতে পারে। আমাদের দেশে একসময় 'রসের বিচার বা আর্টের বিচারেই সাহিত্যের মূল্যমান নির্ণীত হত। একালে আবার বাস্তবতাভিত্তিক ঐতিহাসিক বিচারের দিকেই ঝোঁক। সাহিত্য যেমন জীবনের দর্পণ, তেমনি আবার জীবনের ওপরেও সাহিত্যের ছাপ পড়ে—এই স্বীকৃতিতে সাহিত্যকে এখন জীবন দর্শন রূপে দেখা হয়, তাই 'আধুনিক সাহিত্য বলব তাকেই যেখানে আধুনিক জীবন দর্শনের প্রতিফলন ঘটেছে। সহজ কথায় বলা যায় যে, সাহিত্যয় প্রকাশ পেয়েছে ‘যুগধর্ম' তথা ‘পরিবেশ ধর্ম অর্থাৎ পারিপার্শ্বিকের ছাপ, সেটাই আধুনিক।


বিষয়বস্তু এবং প্রকাশ বা রূপায়ণ-এই দুয়ের সুসঙ্গত সমাহারের মধ্য দিয়েই সাহিত্যে যথার্থ যুগধর্ম প্রকাশ পায় এবং সাহিত্যও সৃষ্টি হিসেবে সার্থক হয়, বিষয়বস্তুর আবার দুটি দিক–কথা বস্তু ও ভাব বস্তু। যেমন কর্ণকুন্তীসংবাদের কথাবস্তু মহাভারত ও রবীন্দ্রনাথের কবিতায় প্রায় অভিন্ন, কিন্তু ভাববস্তু বা বাণীরূপ বা আইডিয়ার দিক থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। কাজেই কথাবস্তু এক হলেও ভাববস্তুর জন্যই কোনো ঘটনা আধুনিক হয়ে উঠতে পারে। এই প্রসঙ্গে রূপায়ণের দিকটিও বিচার্য, জীবন-রহস্যকে যথাযথ জানবার জন্য যেমন দেহ ও মন—উভয়কে জানতে হয়, সাহিত্যকে বুঝতেও তেমনি ভাববস্তু ও প্রকাশ-কলা দুটিকেই যথাযথ বুঝতে হয়।


সাহিত্যে যখন ‘যুগধর্ম’ ও ‘পরিবেশের ছাপ' পাওয়া যায় এবং মূল্যবোধের পরিবর্তন লক্ষিত হয়, তখনই তাকে আমরা ‘আধুনিক সাহিত্য' অভিধায় অভিহিত করি। যুগধর্ম ও পরিবেশের ছাপ লক্ষ্য করা যায় রচনার বিষয়বস্তু ও রূপায়ণ—দুদিক থেকেই। বিষয়বস্তুর আবার দুটি দিক—এক কথাবস্তু এবং ভাববস্তু। কথাবস্তু এক থাকা সত্ত্বেও ভাববস্তুর বিচারে প্রাচীন কাহিনি ও আধুনিক ধর্মী হয়ে উঠতে পারে। যেমন, মহাভারতে কর্ণকুন্তী কাহিনি এবং রবীন্দ্রনাথের কর্ণকুন্তীসংবাদ,—উভয়ের কথাবস্তু প্রায় অভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও ভাববস্তুতে কত পার্থক্য। আবার ভিন্ন কথাবস্তুর মধ্যে ভাবগত ঐক্য থাকা সম্ভব। এই ভাববস্তুই যখন প্রকাশ তথা রূপায়ণের মধ্য দিয়ে সত্য হয়ে ওঠে, তখনই সাহিত্যের যথার্থ মূল্য স্বীকৃত হয়। রূপকলা প্রকাশ পায় সাধারণত রীতি বা স্টাইল, আঙ্গিক বা টেকনিক ও অলংকারাদির সাহায্যে। দেহ এবং মনের বিচিত্র লীলাতে যেমন জীবন, তেমনি ভাববস্তু এবং রূপকলা— উভয়ের যথাযোগ্য সমন্বয়েই প্রকৃত আধুনিক সাহিত্য সৃষ্টি হয়। রবীন্দ্রনাথ আধুনিকতার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এক স্থানে লিখেছেন, “আধুনিকতার যদি কোনো তত্ত্ব থাকে তবে সেই তত্ত্বকে নৈর্ব্যক্তিক আখ্যা দেওয়া যায়”। তবে বলতেই হবে, বিশ্বের প্রতি এই উদ্ধৃত অবিশ্বাস ও কুৎসার দৃষ্টি এ-ও একটা মোহ, এর সঙ্গে ও নিরাসক্ত চিত্তে বাস্তবকে সহজভাবে গ্রহণ করার গভীরতা নেই।


এই ভাববস্তুর জন্যই প্রধানত সাহিত্য আধুনিকতার ছাপ পেতে পারে। মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যে কালকেতুর যে কাহিনি আছে, তার ভাববস্তু হল, মানুষের দুঃখ বেদনার কাহিনি, তা নিয়ে একালের উপন্যাস নাটক রচিত হচ্ছে। ভাববস্তু একই রয়েছে, কিন্তু কথাবস্তু আর রূপায়ণ পালটেছে। আবার কথাবস্তুতে সধর্ম বজায় রেখেও ভাববস্তুর পরিবর্তন ঘটিয়ে সাহিত্যকে আধুনিক করে তোলা যায়। রামায়ণে রামচন্দ্র প্রজানুরঞ্জনের জন্য পতিব্রতা স্ত্রী সীতাকে বিসর্জন দিয়ে সুবিচারের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন। একালের বিচারে এটি মূঢ়তা প্রসূত অবিচার। তাই ডিউক অব উইন্ডসর যখন স্বীয় মনোমত পাত্রীকে বিবাহ করবার জন্য সিংহাসনের দাবি ত্যাগ করলেন, তখন দিকে দিকে প্রশংসার বান বয়ে গেল। কারণ, এখানে রাজকর্তব্য নয়, ব্যক্তিপ্রেম, মানুষের মর্যাদাই প্রাধান্য পেলো। বস্তুত এটিই হল আধুনিকতা, আধুনিক সাহিত্যে মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত রয়েছে, যদিও পরিপূর্ণ ভাবে নয়। তবে দেবতা আর ধর্ম যে ক্রমশ গৌণস্থানে চলে গিয়ে ক্রমশ মানুষের জন্য সাহিত্যে ঠাঁই করে দিতে লাগল, তার পরিচয় কিন্তু আমরা প্রাচীন সাহিত্যেও পেয়ে থাকি।


আমাদের মহাকাব্য রামায়ণে রামচন্দ্র সীতাকে বিসর্জন দিয়ে যজ্ঞের নিমিত্ত স্বর্ণ সীতা তৈরি করিয়েছিলেন, কিন্তু দ্বিতীয়বার দ্বার পরিগ্রহ করেননি, অথচ তার পিতা দশরথের সাড়ে সাতশো মহিষী ছিল। কাজেই রামচন্দ্র ব্যক্তিপ্রেমকে যথাযোগ্য মর্যাদাই দিয়েছিলেন। শুধু কি তাই, রামচন্দ্র অবতার হওয়া সত্ত্বেও তাকে আমরা-পিতা-পুত্র-স্বামী-রাজা প্রভৃতি আকারে পারিবারিক এবং সামাজিক মানুষ রূপেই গ্রহণ করেছি। দেবতা কৃষ্ণও আমাদের কল্পনায় মানবীয় সম্পর্ক নিয়েই দেখা দিয়েছেন। চণ্ডীদাসের কবিতায় বলা হয়েছে 'সবার উপরে মানুষ সত্য/ তাহার উপরে নাই', পৃথিবীর কোনোকালে এমন স্পষ্ট ভাষায় মানুষের মর্যাদা স্বীকৃতি হয়নি। মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যেও চণ্ডীমঙ্গল কাহিনিতে আমরা অনেক সাধারণ মানুষের দেখা পাই। অতএব অতিশয় সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠতে পারে তাহলে ওগুলি আধুনিক সাহিত্য নয় কেন? আধুনিক সাহিত্যের সঙ্গে প্রাচীনকালের সাহিত্যের পার্থক্য কোথায়?


প্রাচীনকালে মানুষ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, সে প্রকৃতি থেকে স্বতন্ত্র। তার মধ্যে মানবীয় চেতনা সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের মর্যাদা বিষয়েও একটা সীমাবদ্ধ ধারণা তার গড়ে উঠেছিল, কিন্তু মানুষের মূল্যবোধ সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে সচেতন হয়ে উঠতে পারেনি, কাজেই সে নিজেকে দেবতার ক্রীড়নক হিসাবেই দেখেছে, তাই মানুষের নামে কীর্তিত হয়েছে দেবতা মাহাত্ম্য। সমগ্র প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা তথা ভারতীয় সাহিত্যে আমরা দেবতা আর ধর্মকেই প্রাধান্য দিয়েছি। তাই চণ্ডীদাসের ‘সবার উপরে মানুষ সত্য যে মানুষ সেও আধ্যাত্মিক মানুষ, মরজগতের আধিভৌতিক মানুষ নয়। তুলনামূলকভাবে প্রাচীন গ্রিক সাহিত্য ছিল অনেক আধুনিক। তাদের জীবনযাত্রা রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পরিবেশ ছিল অনেক উন্নত, তাদের মানবতাবাদ সাহিত্যে অনেকটাই পরিস্ফুট হয়ে উঠেছিল। প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার বুনিয়াদ অনেকটা আধুনিক কালেরই যেন ক্ষুদ্র সংস্করণ ছিল। প্রাচীন চিনে ও কনফুসীয় যুগ থেকে একটা সুস্থ ঐহিক দৃষ্টিভঙ্গি সমাজবোধে স্থান পেয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে চিনে মানুষের মূল্য, ব্যক্তিত্বেরও গণতন্ত্রের স্ফুরণ আর বিশেষ ঘটল না। ফলত চিনের সমাজ ও অনড় হয়ে রইল। বস্তুত মধ্যযুগটা পৃথিবীর সর্ব এই অন্ধকারাচ্ছন্ন যেমন যুরোপ, তেমনি চিন, তেমনি ভারত। প্রাচীনযুগে মানবতাবাদের যে অস্ফুট প্রকাশ সর্বত্র লক্ষ করা গিয়েছিল, মধ্য যুগে কোথাও তা এক পা এগুতে পারেনি, বরং নানা দিক থেকে তা কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিল।


তাছাড়া দীর্ঘকাল পর আবার গ্রিক চিন্তা জগতের পুনরাবিষ্কার চেষ্টা থেকেই শুরু হল যুরোপীয় রেনেসাঁসবস্তুত এটিকেই আমরা আধুনিক যুগের সূত্রপাত বলে গ্রহণ করতে পারি। প্রাচীনযুগের মানবতাবোধের ঐতিহাসিক পরিণতি রূপেই এর উদ্ভব। তবে প্রাচীন মানবতাবোধের সঙ্গে এর যে পার্থক্য, তা পরিমাণগত নয়, গুণগত। জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বীকরণের ফলে, ‘আধ্যাত্মিক মানুষের' কালগত হল, 'মানুষের মানবতা বোধ’ এইবার যথোপযুক্ত স্বীকৃতি লাভ করল। আধুনিকতার প্রথম সোপান এইটিই। এর পরই ধীরে ধীরে ইংল্যান্ডে ও আমেরিকায় মানুষের অধিকারের স্বীকৃতি নিয়ে তৎকালীন সমাজবিদ চিন্তা জগতে তুমুল আলোড়ন চলছিল। তারপরই ১৭৮৯ খ্রিঃ ফরাসি বিপ্লবের পর ‘সর্বজন স্বীকৃতরূপে মানুষের অধিকার' ঘোষণায় মানবতাবাদ আর এক ধাপ এগিয়ে এল। মানুষের চিন্তাধারায় যখন বাঁক ফেরে, সমকালীন সাহিত্যেও তার চিহ্ন থেকে যায়। প্রোমিথিউস আন বাউন্ডের মধ্য দিয়ে কবি যে ব্যক্তি-স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন, তারপর একসময় স্বপ্নভঙ্গের দুঃখ ও মানুষকে সইতে হয়েছে। ইংরেজি সাহিত্যের রোমান্টিকতার পুনর্জাগরণের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি-স্বাধীনতার স্বপ্নলোকে পাড়ি দিয়েছে, এল টেনিসন আর্নল্ডদের যুগ, ওদিকে হুইটম্যান আর এদিকে ব্রাউনিং-এর আশাবাদ। তারপর সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল, শোনা গেল ওয়েস্টল্যান্ডের বর্তমান বিলাপ। কিন্তু পৃথিবী তো থমকে থাকেনি। এক সময় হতাশার কালও শেষ হল। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় পাদে রুশ বিপ্লবের ফলে আধুনিকতার তৃতীয় পর্ব সূচিত হল। ফরাসি বিপ্লবে ব্যক্তিসত্তার স্বীকৃতির সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্রের আবশ্যিকতাও স্বীকৃত হয়েছিল। এই দাবি মেটানোর জন্যই প্রয়োজন দেখা দিল শোষণতন্ত্রের অবসানের। রুশ বিপ্লবে স্বীকৃত হল, মানুষ ও বিপ্লবী শক্তি, কারণ মানুষ সৃষ্টিধর্মী। সে নিয়তি তাড়িত নয়, আপনার ভাগ্য সে আপনি গড়ে নিতে পারে। মানুষের এই ক্রমিক আধুনিকতায় উত্তরণ-চিহ্ন রয়ে গেছে যুগে যুগে সাহিত্যের বুকে। এখন আধুনিক সাহিত্য মানুষের এই স্বীকৃতি, এই মানব সত্য ও ব্যক্তি মহিমাকে প্রকাশ করতে পেরেছে, তা নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচার করে না দেখলে বোঝা যাবে না।