'এই লক্ষণ কবিদের মধ্যে বর্তায় কখনো বা ব্যক্তিগত কারণে আর কখনো বা ঐতিহাসিক কারণে।—লক্ষণটি নির্দেশ করে লক্ষণ বর্তাবার ব্যক্তিগত ও ঐতিহাসিক কারণ ব্যাখ্যা করো। বাংলা সাহিত্য দ্বিতীয় কারণ উদ্ভূত হওয়ার মতো পরিস্থিতি কেন হয়েছিল, তাও লেখকের অনুসরণে বিশ্লেষণ করো।

“বিশ শতকের তৃতীয় দশকে বাংলাদেশের যে ক-টি যুবক সাহিত্যক্ষেত্রে খ্যাতিলাভ করেন তাদের সকলেরই প্রথম ও প্রধান অবলম্বন ছিল 'কল্লোল' এবং সে হিসেবে 'সবুজপত্র' ও 'ভারতী'র সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কল্লোলের নামও স্মরণীয়।” লেখকের মতে, আপন অজান্তেই নজরুল বাংলা সাহিত্যে নতুন যুগ সৃষ্টি করেছেন। কোনো মহান অসন্তোষ বা দিব্যদাহ নজরুলের শিল্পী চিত্তকে ক্ষুব্ধ করে তোলেনি। তবে তিনি পরবর্তী শিল্পীদের চিত্তে অতৃপ্তি ও অসন্তোষকে সংক্রামিত করেছিলেন। রবীন্দ্রদ্রোহিতা দিয়ে নজরুল—পরবর্তী যুগের কবিদের যাত্রা শুরু হল। রবীন্দ্রনাথ যে স্বয়ংসম্পূর্ণ নন, তার কাব্যও যে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, সীমাবদ্ধতা আছে তা কল্লোল গোষ্ঠীর কবিকুল অনুভব করলেন এবং করালেন। কল্লোলের প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক ছিলেন দীনেশ রঞ্জন দাশ। কল্লোলের প্রধান লক্ষণ ছিল বিদ্রোহ এবং তা রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে। কল্লোল গোষ্ঠীর বিদ্রোহের মধ্যে আতিশয্য ছিল, আবিলতা ছিল। আত্মপ্রকাশের প্রবল তাড়নায় অন্য কিছু লেখার তাগিদে এই যে রবীন্দ্র বিরোধিতা তা’ একান্তই গঠনমূলক— ‘রবীন্দ্রনাথকে সহ্য করার, প্রতিরোধ করার পরিশ্রমও প্রয়োজন ছিল এই বিদ্রোহের-বাংলা কবিতার মুক্তির জন্য নিশ্চয়ই, রবীন্দ্রনাথকেও সত্য করে পাবার জন্য।'


এদের বিশ্বাস ছিল বাংলা কাব্যে নতুন কিছু করতে হলে রবীন্দ্রনাথ থেকে দূরে সরে থাকা অবশ্য কর্তব্য। তাই কল্লোলের কাব্যে এল—

  • ১। সংরাগের তীব্রতা।

  • ২। জীবনের জ্বালা যন্ত্রণার চিহ্ন।

  • ৩। মানব শরীর, যা রবীন্দ্রনাথে একদা উপেক্ষিত বলে মনে হল।


অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ভাষায়, “রবীন্দ্রনাথ থেকে সরে এসেছিল 'কল্লোল'। সরে এসেছিল অপরিজ্ঞাত ও অবজ্ঞাত মনুষ্যত্বের জনতা, নিম্নগত মধ্যবিত্তের সংসারে, কয়লাকুঠিতে, খোলার বস্তিতে, ফুটপাতে। প্রথম দিকে রবীন্দ্র বিরোধিতা, কিছু জঞ্জাল সৃষ্টি হলেও পরবর্তী সময়ে সুধীন্দ্রনাথ সম্পাদিত 'কবিতা' ও 'পরিচয়' পত্রিকায় নবীন কবিরা নিজেদের প্রতিভার স্বাক্ষর মুদ্রিত করে দিলেন।


এই নবীন কবিগোষ্ঠীর কবিতায় দেখা গেল সংহতি ও বুদ্ধিদীপ্ত মননশীলতা, ভাষা ও রীতির ক্ষেত্রেও তারা আনলেন অভিনবত্ব। সাধারণ পরিবেশ ও গৃহীত হল সাধারণ ভাষা। গদ্য ও পদ্য তার বাঁধাপথ ছেড়ে জনতার পরিচিত পথে যাত্রা শুরু করল। এই সময়েই গদ্য ও পদ্যের সংমিশ্রণে সৃষ্টি হল গদ্য কবিতা। যদিও এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথই পথ প্রদর্শক। এই কল্লোল গোষ্ঠীর কবিদের রচনা একপথে চলেনি, তাদের পারস্পরিক ব্যবধান ছিল বিস্তর।


দৃশ্য গন্ধ স্পর্শময় জীবনানন্দ আর মনন প্রধান অবক্ষয় চেতনার কবি সুধীন্দ্রনাথের ইনটেলেকট প্রধান কাব্যে স্বরূপত প্রভেদ বিপুল। অমিয় চক্রবর্তী প্রাকরণিক বৈচিত্র্যে, আন্তর্জাতিক মানসিকতা আমদানির পথে নতুনতা আনলেন। প্রেমেন্দ্র মিত্র সমুদ্রপ্রেমিক নাবিকের মতো। তাঁর কাব্য সামাজিক, বুদ্ধিদীপ্ত ও সর্বজনগম্য। এঁরা বাংলা কাব্য সম্পদকে নানাভাবে পরিবর্ধিত করেছেন। এঁদের মূল উদ্দেশ্য ছিল রবীন্দ্রনাথকে এড়িয়ে নতুন কাব্য সৃষ্টি। রবীন্দ্রপ্রভাব মুক্ত হয়ে তাঁরা যে স্বাধীন চেতনার পরিচয় দিলেন তার মূল রস সংগৃহীত হল পাশ্চাত্য সাহিত্য থেকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পাশ্চাত্য কাব্যে যে হতাশা, ক্লান্তি, সংশয় ধ্বনিত হল তা সংক্রমিত হল বাংলা কাব্যে। ফলে কবিতার সুর ও মেজাজ গেল পালটে। অবক্ষয় ও বিজ্ঞান চেতনা, রাবীন্দ্রিক বলয়ের ঈশ্বর, প্রেম মাধুর্যের বদলে 'Melodies of age' সম্পর্কে সাহিত্যিকদের সচেতন করে তুলল। কেবল কবিতায় নয়, কথা সাহিত্যের দর্পণেও ধরা পড়ল এই যুগান্তকারী বাঁক বদলের ছবি। কল্লোল গোষ্ঠীর কবিদের কবিতায় পাওয়া গেল বাস্তবের ঘনিষ্ঠতা তথা রিয়ালিজম। তা লালসার অসংযম, দারিদ্র্যের আস্ফালন না রিয়ালিটির সাময়িকতা তা বিচার্য নয়। বরং এই রবীন্দ্রেতর হওয়ার যে লক্ষ্য নিয়ে কল্লোলের অভিযাত্রার সূচনা তা সফল হল।


রবীন্দ্রনাথকে আত্মস্থ করে যে নতুন কবিসমাজ এগিয়ে এলেন তাদের নিয়েও সমস্যা দেখা দিল। এই গোষ্ঠীর প্রতিভাবান নবাগতদের প্রভাবিত করতে লাগল, বিশেষ করে জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী প্রমুখের রচনা। আসলে অনুসরণ থেকেই অনুসৃজনের পথে পুরানোর পরিবর্তে নতুনের জন্ম হয়। আর চিরকালই নতুন ও পুরাতনের দ্বন্দ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে একটা কৌতুকের মতো। সুধীন্দ্রনাথ প্রথম দিকের রচনায় রাবীন্দ্রিক বাক্য বিন্যাস অনায়াসেই চালিয়ে দিলেন। অমিয় চক্রবর্তী রবীন্দ্র জগতে থেকে, প্রকরণগত বৈচিত্র্য আনলেন মাত্র। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের বিপুল বিত্তকে এঁরা বৈচিত্র্য সৃষ্টির কাজে লাগালেন। রবীন্দ্রনাথের ঋণকে অস্বীকার না করেও এঁরা প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বাংলা কাব্যের দিগন্তকে প্রসারিত করে দিলেন। সাহিত্য তথা কবিতা রচনা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা তো চলবেই। শেষ পর্যন্ত স্থায়ী হবে সেই কবিতাই না মানুষকে আশ্রয় দিতে পারে—তার অনুভূতির দোসর হতে পারে। আর বাংলা কাব্যে তথা সাহিত্যে আদিগন্ত ব্যাপ্ত রবীন্দ্রনাথের ঋণ স্বতঃসিদ্ধ মেনে নিয়ে স্বচ্ছন্দ অগ্রসরণ ঘটবে বাংলা কবিতার। লেখকের মতে, ‘রবীন্দ্রনাথ সেই লেখক, যাঁর দোষ আমরা যে কেউ যে কোনোদিন ধরতে পারি, আর যাঁকে না হলে আমাদের কারোরই এক মুহূর্ত চলে না। আর এখানেই তাঁর চরম জয় যে তিনি অপরিহার্য।