সাহিত্যে আধুনিকতা বলতে কী বোঝ? গোপাল হালদারের ‘আধুনিক সাহিত্য প্রবন্ধে বিভিন্ন কালের সাহিত্য আলোচনার মাধ্যমে লেখক আধুনিকতার স্বরূপ সম্পর্কে যা বলেছেন তার তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

‘আধুনিক সাহিত্য' প্রবন্ধে গোপাল হালদার আধুনিকতার সংজ্ঞা নির্দেশ করে তাঁর আলোচনার দুটি ক্ষেত্রকে প্রসারিত করেছেন কালগত বা যুগগত পরিবর্তনের ধারার দিক থেকে। আসলে লেখক জীবন দর্শন ও সাহিত্য আদর্শ, এই নিয়েই আদর্শের যে সম্পর্ক সে সম্বন্ধে স্পষ্ট করে বলতে চেয়েছেন যে, কালবদল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবন দর্শন বদলে যায়। ফলে সাহিত্য আদর্শও বদলে যায়। মানব জাতীয় ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যাবে যে তার মধ্য দিয়ে চেতন অচেতনের সংঘাত। সেই সংঘাতের মধ্য দিয়েই জীবনের বিকাশ এবং কাল থেকে কালের অভ্যন্তরে অভিযান। সাহিত্য এই যুগগত বা কালগত ধারাকেই বহন করে চলে। মানুষ এবং জীবন হল সাহিত্যের অবলম্বন বা আশ্রয়। সাহিত্য থেকে জীবন তার উপাদান সংগ্রহ করে তার বিকাশের আভাস পায় এবং একটা প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে। এদিক থেকে বলা যেতে পারে যে, সাহিত্যের মধ্যে যে দেশে কালের যৌক্তিক ছাপ তা শুধু যুগের একান্তই ছাপ নয় তাতে পারিপার্শ্বিক পরিবেশেরও প্রভাব আছে। সাহিত্যিকরা তাই দুই শ্রেণির হয়ে থাকেন। এক বিশেষ যুগ বা কাল থেকেই কবি তাঁর সাহিত্যের রসদ সংগ্রহ করেন। এরা যুগসৃষ্ট কবি। আর এক রকম থাকেন, যুগশ্রষ্ঠা কবি অর্থাৎ যারা কেবল যুগ থেকে নেন না, যুগকে কিছু দানও করেন। তাঁর ভাব ভাবনা তাঁর অন্তরগত উপলব্ধি যা চিরন্তন হয়ে যুগের হয়েও যুগের নয়। কবি মাত্রেই যে বিষয়কে অবলম্বন করেন তার একটি হল বিষয়বস্তুর দিক, অপরটি প্রকাশ ও রূপায়ণের দিক। এই বিষয়বস্তু ও তার প্রকাশধর্মীতা এই দুয়ে মিলে সাহিত্যে একটি অখণ্ডতার প্রকাশ হয়ে ওঠে। অর্থাৎ কবি কৰ্ম বা কবি নিমির্তির এক বিশেষ কৌশল এই দুয়ের সমন্বয় করতে পারে, কিন্তু বিশেষ বস্তু হিসেবে যা ঘটে থাকে তাকে অনুসরণ করাই সাহিত্যেকের ধর্ম নয়, অর্থাৎ বিষয় নির্বাচনে কবিকে তাঁর একটি সামগ্রিকতার দিকে দৃষ্টি রাখতে হয়।


বিষয়বস্তুকে দুটি বিশেষ ভিন্নরূপে গ্রহণ করা যেতে পারে – 

  • (i) কথাবস্তু হিসাবে 

  • (ii) ভাববস্তু হিসাবে।


যেমন লেখক উদাহরণ দিয়েছেন, তাজমহলের কথাবস্তু তাজমহল ও সাজাহান। কিন্তু তাঁর সৌন্দর্য ও শোভা হল তার ভাববস্তু। যে শকুন্তলার বিষয়বস্তু মহাভারতে আছে, এ মূলত কালিদাসের তত্ত্ব ভগ্নাংশ কিন্তু মহাভারতের শকুন্তলা, কালিদাসের যুগের মধ্যে একট বিরাট পার্থক্য রয়েছে। সেজন্যই একটি সভ্যতা ও সংস্কৃতি। তার সমাজজীবন অথবা রাষ্ট্রজীবন, তার পরিবেশ যা ছিল তা নিম্ন পরবর্তীত যুগে পরিবর্তীত হয়ে গেছে। ঠিক সেইভাবেই প্রাচীন মধ্য যুগ পেরিয়ে আধুনিক যুগের বিষয়গত, ভাবগত, এমনকি তার রূপায়ণগত পরিবর্তন হয়েছে আমূল। আধুনিক যুগ জীবনের নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে তার বিচিত্র প্রকাশ। তাই আজকের আধুনিক কাব্যের নানান বিভাগ ও সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ আধুনিক সাহিত্যের সহস্রমুখী জীবনকে প্রকাশ করার জন্য কত বিচিত্র পথের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। যেমন—বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ পর্যন্ত শুধু কাব্যেরই প্রকাশ, যেখানে দেব দেবীই ছিল মুখ্য অবলম্বন সেখানে মানুষ নিজের প্রতিষ্ঠা দিতে পারেনি। তারপর জীবনের ধারা পালটেছে, সাহিত্যের আঙ্গিক প্রকরণও বদলে গেছে। বিষয়বস্তু তো বটেই, পদ্যের স্থানে আসছে গদ্য এবং কাব্যের ক্ষেত্রে কত বিভাগ সৃষ্টি হয়েছে, কত নতুন ছন্দ, নতুন রীতি, কত সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর অভিব্যক্তি আধুনিক সাহিত্যের প্রবন্ধে, সমালোচনায়, কাব্যে তা প্রকাশিত হয়েছে। যুগে যুগে সমালোচনার রূপ ও রীতির কতই না পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সমালোচকের উদ্দেশ্য শোল্ড রোডের মতে সমালোচনা— "Should Amcliorate society by restoring morals, by promoting healthy tastes and by cultivating the best tradition.

রিচার্ডস যাকে বলেছেন— Judge of value সমালোচকরা বলেছেন—“Discover the purpose, Judge its worth, criticize the technique.


একেবারে সব মুছে গেছে তা বলা যাবে না, এখনও মানুষ দেব দেবীকে পূজা করে, কিন্তু এখন ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কেউ লিখবে না। কাব্যের ক্ষেত্রে এখন লেখা হয় স্মৃতি, সত্ত্বা, ভবিষ্যৎ মানুষের দুঃখ-বেদনা, মানুষের জীবন-সাহিত্য এখন নানাভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। ভাববস্তুর দিক থেকে দেখা যাবে যে, মানুষের মর্যাদা সেখানে বেড়েছে। আজকে ঘুম থেকে উঠলে যে রাষ্ট্রবিপ্লব হবে একথা মেনে নেওয়া যায় না। লেখক বললেন—একদিন শম্ভুকে শিরচ্ছেদ সাহিত্যিক দেখেছেন, রাজার সুবিচারের চমৎকার প্রমাণ। একশো বছর আগেও আমাদের বৃদ্ধ প্র-পিতামহের দল একই চোখে দেখেছেন সেই কাহিনি, কিন্তু আজ আমরাও তাকে রাজশক্তি ও উচ্চবর্ণের মানুষের অবিচার হিসাবে, অর্থাৎ মানবিক দৃষ্টিটাই এখন বড়ো হয়ে উঠেছে।


আজকের দিনে সাহিত্যে মানুষের স্থান হয়েছে বটে, কিন্তু আজও সমাজের কাঠামোটি পালটায়নি, মানুষ মানুষই একথা আমরা জানি। কিন্তু কুলি, মজুর, চাকর, পেয়াদা এদের ১৫টাকা মাইনে আর পিপঁড়ের আহারই যথেষ্ট। আর মন্ত্রীউজির এদের ১৫০০ টাকা মাইনে আর হাতির খোরাক না হলে চলবে না। অর্থাৎ সব মানুষ মানুষ নয়। কেউ পিঁপড়ে কেউ হাতি, এই বৈষম্য সমাজে রয়েছে, কিন্তু তার মূল্যেবোধটুকু গৌণ হয়েছে মাত্র। তাই আধুনিক সাহিত্য হয়ে উঠেছে মানুষের সাহিত্য, মানব সত্ত্বা নিয়েই আধুনিক সাহিত্য। ব্যক্তি সত্ত্বার দাবিই বড়ো সত্য হয়ে উঠেছে। আগের দিনে মানুষ ছিল ভাগ্যের দাস। তার আত্মপ্রত্যয় বলে কিছু ছিল না। বিজ্ঞানের অপ্রয়োগ আধুনিক যুগের মানুষকে খুব যে একটা ভাষা দিতে পেরেছে তা নয়, বরং ভীতি ও নিরাশা জাগিয়েছে বেশি। তার বিজ্ঞান আমাদের এই জগতের প্রতি, মানব জীবনের প্রতি আকর্ষণ বাড়িয়েছে। বুঝিয়েছে মানুষ নিষ্ক্রিয় নয় সক্রিয়।


তারফলে মানুষের বৈপ্লবিক ভূমিকা এখানে গুরুত্ব পেয়েছে। যতই যে প্রকৃতিকে বুঝেছে, ততই সে প্রকৃত থেকে মুক্তি পেতে চেষ্টা করেছে। মানুষের এই বিপ্লব, এই বিপ্লবী নিয়তি ও মানুষের আধুনিক আবিষ্কার বিংশ শতাব্দীর মানুষ সব হারিয়ে তার— Wasteland-এর মধ্যে ও তার আত্মশক্তিকে বুঝতে চেষ্টা করেছে। এ যে তার আধুনিক মূল্যবোধ।


এই মূল্যবোধের প্রধান দিক নতুনত্ববোধ। যেমন—

  • (ক) মানুষের মর্যাদাবোধ।

  • (খ) ব্যক্তিসত্ত্বার মুক্তি।

  • (গ) তার বিপ্লবী মানসিতার।

  • (ঘ) বিপ্লবী সত্ত্বা।

  • (ঙ) বিপ্লবী চেতনা।

  • (চ) বিশ্ব মানসিকতাবোধ এবং

  • (ছ) নতুন জাতীয়তাবোধ বা Nationalism.


আজ সর্বত্র এ দাবিও উঠেছে যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য এবং গণতন্ত্রের জন্য শোষণেরও সর্বাত্মক অবসান প্রয়োজন। এই বিপ্লবই চিহ্নিত করেছিল যে মানুষ বিপ্লবী শক্তির অধিকারী, কারণ মানুষ সৃজনধর্মী। আন্তরিক শ্রমে যে নিজের জীবনকে গড়ে নিতে পারে। এ ঘটনা পৃথিবীর সর্বত্র ঘটেনি। আমাদের দেশেও না, তাছাড়া আমরা এখনও ধনিক দেশ হয়ে উঠতে পারিনি, যদিও আশা ও চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই। পুরোনো সামন্তবাদের বোঝা একদিকে সমাজতন্ত্রী সমাজের স্বপ্ন আমাদের জীবনের মানচিত্রকে জটিল করেছে। জাতীয় স্বাধীনতা এবং ব্যক্তি স্বাধীনতাকে আমরা আলাদা করে দেখতে চাই। আধুনিকভাবে যে বাণী আমাদের ধ্বনিত হচ্ছে তা এসেছে ‘অসাধারণ তীব্র আবেগে' সে আবেগের সূচনা মধুসূদন বঙ্কিমে। মানুষের সর্বাবয়ব প্রতিষ্ঠা ঘটল। কিন্তু একদা খুবই সত্য তা সাহিত্যে যার প্রতিষ্ঠা ঘটল জীবনে তা সম্ভব হল না তেমনভাবে। জীবনে আমাদের মানবধিকারের ঢেউ এসে পৌঁচেছে একথা বিংশশতাব্দীর মধ্যে পর্বে লেখা এই প্রবন্ধে গোপাল হালদার মানতে চাননি। যদিও একথা তিনি নির্দ্বিধায় মেনেছেন যে ১৯৬০ থেকে ১৯৪০ এই আশি বছরের সাহিত্যে আমরা চারশো বছরের আধুনিক যুগের ইয়োরোপীয় সাহিত্যের বিচিত্র পর্যায়কে পার হতে চেয়েছি। আন্তরিকতার সঙ্গে। এই শতাব্দীর চারের দশকের একেবারে প্রান্তে পাঁচের দশকের সূচনার গোপাল হালদার তাই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে একমাত্র ‘সোভিয়েত দেশ’ ছাড়া যাকে তিনি ‘মানুষের বিপ্লবী নিয়তি’ বলে মনে করেন ইয়োরোপের বহু সাহিত্যে ও তার পরিচয় অস্পষ্ট, যদিও এটাও একেবারেই অসম্ভব নয় যে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের সাহিত্যে, একই সময়ে মানুষের সমতা এবং মানুষের বিপ্লবী নিয়তির বাণী ফুটে উঠতে পারে। বাংলা সাহিত্যে বিপ্লবী জাগরণ দেখা দিলে তবেই আমরা পৌঁছতে পারবো আধুনিকতার তৃতীয় স্তরে। তখনই সাহিত্যে মানুষ ও মানবসত্য প্রাধান্য লাভ করবে এবং এটিই আধুনিকতার মূল বাণী।