চর্যাপদের সমাজ জীবন।

চর্যাপদের সমাজ জীবন


সাহিত্য যদি জীবন ও সমাজের দর্পণ হয়ে থাকে তাহলে 'চর্যাপদ' যে সেই জীবন ও সমাজের বাস্তব চিত্রের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করবে তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। তবে চর্যাপদের উদ্দেশ্য একটি বিশেষ ধর্মীয় আচরণ সম্বন্ধে ইঙ্গিত দেওয়া হলেও, সেই ইঙ্গিত প্রসঙ্গে সিদ্ধাচার্যরা লৌকিক জীবনের যে ছবি এঁকেছেন তা জীবন রসিক কাব্য পাঠক এবং ঐতিহাসিকের কাছে মহামূল্যবান চিত্তাকর্ষক সামগ্রী। যে জীবনের কথা এবং ছবি চর্যাপদের বিভিন্ন কবিতায় বিবৃত তাতে বিলাস বাসনাসক্ত, ভোগকামী, ঐশ্বর্যদাম্ভিক রাজা-উজীরের কথা নেই, আছে সেকালের ছোট বড় সাধারণ লোকের প্রতিদিনের জীবনযাত্রার ও দৈনন্দিন আচরণের সরল সুন্দর সহজ স্বচ্ছ বর্ণনা। সেখানে না আছে কোনও বিশেষ ধরনের সাহিত্যিক রীতি মেনে চলার প্রবণতা, না আছে কোনও আয়াস এই কষ্টকল্পনাহীন, আয়াসহীন, সাবলীল বর্ণনা অন্যত্র খুঁজে পাওয়া রীতিমত কঠিন। এই বর্ণনায় সেকালের সাধারণ লোকের জীবন ও জীবিকা, শ্রম ও বিশ্রাম, কাজ ও আনন্দ, পূজো-আর্চা ক্রিয়া কর্ম, গৃহস্থের পারিবারিক জীবন, বস্ত্র অলঙ্কার, দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত খাদ্য ও বাসন পত্র, অপরাধ ও বিচার পদ্ধতি, সঙ্গীত ও সঙ্গীতের উপকরণ—ইত্যাদি বহু বিষয়ের শিল্প সম্মত বিবরণ আমরা পেয়ে থাকি।


প্রথমেই সাধারণ লোকের জীবন জীবিকার কথা ধরা যেতে পারে। বেশিরভাগ চর্যাগীতিতেই ডোম-ডোমনী, শবর-শবরী, নিষাদ ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে। আর্থিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে এদের বিপর্যস্ত, অবহেলিত অবস্থা বিশেষভাবে ফুটে উঠেছে। মনে হয় রাজশক্তির বিরূপতায় অভাজন এইসব অস্তেবাসীদের সামাজিক অর্থনৈতিক মর্যাদা বলতে কিছুই ছিল না। এরা যে অস্পৃশ্য ছিল, উচ্চ বর্ণের ছোঁয়া বাঁচিয়ে দূরে এদের বাসস্থান নির্দিষ্ট ছিল তার ইঙ্গিত বিভিন্ন চর্যায় প্রকটিত। যেমন নগর বাহির ডোম্বি তোহোরি কুড়িআ (১০), উঁচা উঁচা পাবত তঁহি বসহি সবরি বালী (২৮), টালত মোর ঘর নাহি পড়বেষী (৩৩) ইত্যাদি চর্যা এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু উচ্চবর্ণের ‘নাগরিকেরা’ মাঝে মাঝে গোপনে এই সব অন্ত্যজ রমণীদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতেন। কিন্তু তার জন্যে সমাজে কোনও শাস্তির ব্যবস্থা ছিল বলে মনে হয় না বরং মাঝে মাঝে দেখা যায়, যৌবনের উন্মত্ত আবেগে সেই নাগরিক উচ্চারণ করতো 'আলো ডোম্বি তোত্র সম করিবে ম সাঙ্গ' (৩) অর্থাৎ ডোম্বি তোকে আমি সাঙ্গা করবো। মধুরাতে মুগ্ধ হৃদয়ে দেহকে স্বর্গ মানার এমন চাটুবাণীতে অশিক্ষিত পটু নারীর কোন বিশ্বাস নেই। স্বভাবতই নীরবতা এ আর্তির একমাত্র উত্তর। এরপর তাই শোনা যায় পুরুষের সদম্ভ উচ্চারণঃ ‘মারমি ডোম্বি লোম পরাণ'-(১০)।


কিন্তু অন্তহীন দারিদ্রের মধ্যে দিন কাটাতে হয় এই অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষদের। এদের জাতিগত বৃত্তি বলতে তাঁত বোনা, চাঙারী তৈরি করা, নৌকা বাওয়া। অনেক সময় হাঁড়িতে ভাত থাকে না, তবু বাড়িতে নিত্য অতিথি সমাগম—'হাড়ীত ভাত নাঁহি নিতি আবেসী— কিন্তু সংসার দিন দিন বেড়েই চলেছে। কপালের এমন ফের দোয়া দুধ যেন বাঁটেই ফিরে যাচ্ছে-(৩৩)। বিত্তবৈভবের কোনও চিহ্ন নেই, সাজ পোষাকের মধ্যে ময়ূর পুচ্ছের পরিধান, গলায় গুঞ্জা ফুলের মালা (২৮)। জীবনযাত্রার উপাদান হিসাবে যে সমস্ত বস্তুর পরিচয় মেলে তা নিতান্তই সাধারণ, হাঁড়ি, পিঠা, ঘড়া, গাড়ু ইত্যাদি। অলঙ্কার হিসাবে সোনা রূপার ব্যবহার এরা করতো বলে মনে হয় না—'সোনা ত রূঅ মোর কিম্পি ন থাকি। উনিঅ পরিবারে মহা নেহে থাকিউ' (৪৯)। আর বিত্ত বৈভব বা ‘আসবে কোথা থেকে? জীবিকার মধ্যে তো— তাঁত বোনা, ঝুড়ি বানানো, তুলো ধোনা, নৌকা বওয়া কখনো বা মাছ ধরা, তাছাড়া যদিও বা কখনো মদ চোয়ানো, (৩) কিংবা নটবৃত্তি (১০) করে জীবন ধারণ করতে হত তবুও এ সমস্ত তো সামাজিক সম্মানের ক্ষেত্রে অনুকূল ছিল বলে মনে সমীচীন নয়।


সাধারণ আর পাঁচটা মানুষের মতো সন্তান পরিবার নিয়ে সুখে বেঁচে থাকার কামনা এদের মধ্যে প্রবল থাকলেও সত্যকার সুখ এদের কপালে জুটতো কিনা সন্দেহ জাগে। সুখতো দূরের কথা, শান্তিও দূর অন্ত। ছোটোখাটো চুরি ডাকাতি নিত্য লেগেই থাকতো— ‘কানেট চৌরি নিল অধরাতি' (২), এর থেকে রেহাই পেতে তালা-চাবির ব্যবহার থাকলেও নিস্তার ছিল না। শেষ পর্যন্ত থানা কাছারি বা কোটালের শরণাপন্ন হতে হতো। কিন্তু হাঁক পেড়ে যখন ডাকাতি হতো, যখন নির্দয় লুঠেরা এসে দেশ লুটতো, এমনকি ঘরের বৌকেও ধরে নিয়ে যেত, তখন বাঁচা ও মরা সমান। পরম দুঃখে এই সমস্ত নির্যাতিতেরা উচ্চারণ করতো—‘আপনে নাহি মো কাহেরি সঙ্কা। তা মহা মুদেরি টুটি গেলি কংখা।”(৩৭) অথবা আমার ঘরের গৃহিণী চতুষ্কোটি ভাণ্ডার সব লুটে নিয়েছে, আমার বাঁচায় মরায় কি পার্থক্য! — “জীবস্তে মঅলেঁ নাহি বিশেষণ।” (৪৯) এছাড়া ২০ সংখ্যক পদে এক হতভাগ্য অশিক্ষিত গ্রাম্য নারীর মর্মান্তিক দুঃখের কথা এইভাবে বর্ণিত হয়েছে—‘বাসনার পুঁটুলি আমার নাড়ি ছেঁড়া ধন এই প্রথম প্রসব, মাগো, আঁতুড় কোথায় পাই ? ভাতার আমার বিবাগী, বাপ ও কবে মরে গেছে, আমার নিরাশার শেষ কোথায়! যা চাই তাই কি পাওয়া যায়! এ নব যৌবন আমার ব্যর্থ! (২০)"


জীবন যতই যন্ত্রণাদায়ক হোক, বেঁচে থাকা যত কঠিনই হোক, তবু তো সহজে মৃত্যু নয়। তাই অন্তহীন দুঃখের মধ্যেও মানুষ সুখের চিন্তা করে। মনে মনে কল্পনা করে সুখী জীবনের ছবি। ২৮সংখ্যক পদে তেমনি একটি সুখী দাম্পত্য প্রেমের ছবি ফুটে উঠেছে—“নানা তরুবর মুকুলিত— আকাশ ছোঁয়া তাদের ডাল। শবর ত্রিধাতুর খাট পেতে মহাসুখে শয্যা বিছিয়েছে। কর্পূর বাসিত পান খেয়ে নৈরামনি শবরীর কণ্ঠাশ্লিষ্ট হয়ে প্রেমে রাত পোয়ালো। ৫০ সংখ্যক পদে পাই—বৃক্ষান্তরালে উঁচু টিলায় শান্তিপূর্ণ ঘর। কণ্ঠাশ্লিষ্ট প্রেমময়ী গৃহিণী ; ধান পেকেছে, অন্নের অভাব এবার মিটবে। সুখের জন্য আর কি চাই? তবে পরিবারে কেবলমাত্র স্বামী-স্ত্রীই মুখ্য নয়, সেখানে থাকতো শাশুড়ী, ননদী, শালী সবাই। এছাড়া বাদ্য যোগে বিবাহযাত্রা, যৌতুক প্রথা, নারীদের বাসরজাগা, সবই ছিল। ছিল অবসর বিনোদনের জন্য দাবাখেলা (১২), বীণা বাদন (১৭), নারী পুরুষের মিলিত নাচ (১০-১৭), অভিনয়, বারুণী সেবন ইত্যাদি। যদিও এসবের স্পষ্ট বর্ণনা তেমন কোথাও নেই তবুও দুঃখ দারিদ্র পীড়িত সাধারণ মানুষের মধ্যে দুঃখ ভুলে থাকার উপায় হিসাবে এই সমস্ত মেনে নেবে তাতে আর আশ্চর্য কি?


তবে জীবন যত দুঃখ কিংবা সুখেরই হোক, 'চিতাতেই সব শেষ'। মানুষের যেমন জন্ম আছে, মৃত্যুও অবশ্যম্ভাবী। তাই মানুষের মৃত্যুর পর সৎকারের ব্যবস্থাও সব সমাজেই প্রচলিত ছিল। এমনই একটি চিত্র চর্যাপদের ৫০ সংখ্যক পদে পাই –

চারিবাসে তা ভলা রেঁ দিআঁ চঞ্চালি।

তঁহি তোলি শবরো (দা) হ কত্রলা কান্দশ সগুন শিআলি ৷৷

মারিল ভবমত্তারে দহাদিহে দিধলি বলী।

হের সে শবরো নিবেবস ভাঙ্গলা ফিটিলি শবরালী।।


“চারিবাস (খাট, বালি) গড়া হল বাঁশের চেঁচারি দিয়ে, তাতে তুলে শবরকে দাহ করা হল ; কাঁদলো শকুন শিয়াল, দশদিকে পিণ্ড দেওয়া হল। শবর নির্মূল হল। শবরালি ঘুচে গেল।”—তাই বলতে হয়, চর্যাপদে প্রাপ্ত দৈনন্দিন জীবনে প্রত্যক্ষ লৌকিক রূপের জগতের উপাদানগুলি সিদ্ধাচার্যদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা দ্বারা প্রকাশ পেয়েছে।