চৈতন্য পূর্ব ও চৈতন্যোত্তর যুগের পদাবলী সাহিত্যের পার্থক্য | “ষোড়শ শতাব্দী বৈষ্ণবপদাবলীর সুবর্ণযুগ।”— আলোচনা করো।

চৈতন্য পূর্ব ও চৈতন্যোত্তর যুগের পদাবলী সাহিত্যের পার্থক্য


চৈতন্যদেবের আবির্ভাব বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে একটি উজ্জ্বল ঘটনা। প্রাকচৈতন্য ও চৈতনোত্তর পদাবলীর পার্থক্য অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গ উভয় দিক থেকেই স্পষ্ট। তাঁর আবির্ভাব যেমন ছিল যুগান্তকারী ঘটনা তেমনি তাঁর দেবোপম চরিত্র এবং প্রেম ভক্তির আদর্শ বাংলা সাহিত্যে যুগান্তর সৃষ্টি করেছে। এমন কি তাঁর আবির্ভাবে বৈষ্ণব কবিতারও নতুন মূল্যায়ন হতে থাকে। মহাপ্রভু চৈতন্যদেব বৈব সাধনার প্রচলিত রীতিসমূহ থেকে একটু সরে গিয়ে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের প্রবর্তন করলেও চৈতন্য আবির্ভাবের কয়েকশতাব্দী পূর্ব থেকেই গৌড়বঙ্গে ও ভারতবর্ষে যে বৈবধর্ম প্রচলিত ছিল, রাধাকৃষ্ণের প্রেম কাহিনি অবলম্বনে বিভিন্ন কাব্য যে রচিত হয়েছিল, তার বহু প্রমাণ বিদ্যমান। কাজেই চৈতন্যপূর্ব কালের বৈব ও চৈতন্যোত্তরকালের বৈব পদের একটা তুলনামূলক আলোচনা যে কোনও রসপিপাসু পাঠকের নিকট অতিশয় প্রাসঙ্গিক।


শুধু গৌড়বঙ্গেই নয়, সম্ভবত সমগ্র ভারতবর্ষেই গৌড়েশ্বর লক্ষণ সেনের সভাপন্ডিত কবি জয়দেব বিরচিত গীতগোবিন্দম কাব্যে সর্বপ্রথম সুশৃঙ্খলভাবে রাধাকৃষ্ণের প্রেমকাহিনি অবলম্বনে পদ ও গীতের সন্ধান পাওয়া যায়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য মহাভারতের ‘মিল’ অংশ, হরিবংশ, শ্রীমদভাগবত, বিষ্ণুপুরাণ প্রভৃতি গ্রন্থ সমূহে সবিস্তারে শ্রীকৃষ্ণের কাহিনি গীত হলেও শ্রীমতী রাধিকার কোনও উল্লেখ এ সকল গ্রন্থে নেই। বিচ্ছিন্নভাবে কোনও কোনও সংস্কৃত ও প্রাকৃত প্রকীর্ণ শ্লোকে এবং পরবর্তীকালের কোনও কোনও পুরাণে রাধাকৃষ্ণের প্রেম বিষয়ক কাহিনি পরিপোষিত হলেও জয়দেবের গীতগোবিন্দম কাব্যে বিষয়টি সর্বপ্রথম একটি পালার আকারে লিপিবদ্ধ হয়। এর পর বড়ু চন্ডীদাস। প্রধানত গীতগোবিন্দের আমলেই তাঁর শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটি রচিত। বিস্ময়ের সঙ্গে উল্লেখ করা চলে যে গীতগোবিন্দ বৈষ্ণুবকাব্য রূপে স্বীকৃত হলেও শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যখানি আজো বৈশ্বব কাব্যের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়নি। কারণ কাব্যটিতে মধুর রসের একান্তই অভাব।


শ্রীকৃষ্ণবিজয়ে মালাধর বসু ভিন্ন সূত্রে রাধাকাহিনি সংযোজন করেছেন। এটি আখ্যায়িকা কাব্য এবং স্বয়ং শ্রীচৈতন্যদেব মালাধর বসুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করলেও বৈশ্বসম্প্রদায় এটিকে বৈশ্বব কাব্যরূপে গ্রহণ করেন নি। মৈথিলি কোকিল কবি বিদ্যাপতি কর্তৃক ব্রজবুলি ভাষায় রচিত পদগুলি রাধা কৃষ্ণের প্রেম সম্পর্কিত প্রথম বৈষ্ণব পদ রূপে স্বীকৃত হয়ে থাকে। বিদ্যাপতি যে সকল গান রচনা করেছেন তাঁর রচিত পদগুলির ভাষা ছন্দ অলংকরণের বৈশিষ্ট্য অতিশয় হৃদয়গ্রাহী। এদের অসাধারণ বিষয়-বৈচিত্র। বৈক্ষ্ণবগণ বিদ্যাপতির পদগুলি হৃদয়ে গ্রহণ করলেও তাতে যেন কবি-আত্মার স্পর্শ নেই। কবি চণ্ডীদাসই বাংলা ভাষায় যথার্থ পদ রচনা করেন। এখানে যে সকল কবি ও কাব্যের উল্লেখ করা গেল সবই চৈতন্য পূর্ববর্তী।


চৈতন্যপূর্ব কবিরা সাধারণভাবে পঞ্চদশ শতকের এবং চৈতন্য সমকালীন ও চৈতন্যোত্তর যুগের প্রথম পর্যায়ের কবিরা সাধারণভাবে ষোড়শ শতকের। গুণগত এবং পরিমাণগত বিচারে প্রধান বৈব কবিদের মধ্যে রয়েছেন চন্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, বলরামদাস, লোচনদাস প্রভৃতি। তাঁরা বৈব সাহিত্যকে উৎকর্ষের চরম সীমায় উন্নীত করেছেন। যার জন্য ষোড়শ শতককে বলা হয় সুবর্ণযুগ। যাঁরা চৈতন্যের সমকালীন পদ রচনা করেছিলেন তাঁদের সবাই ছিলেন চৈতন্যদেবেরই সহচর। এঁদের মধ্যে রয়েছেন চৈতন্যের বয়ঃজ্যেষ্ঠ ভক্ত মুরারিগুপ্ত, চৈতন্যের সহাধ্যায়ী মুকুন্দ দত্ত ও তাঁর জ্যেষ্ঠ বাসুদেব দত্ত, নরহরিদাস ঠাকুর, চৈতন্য সহচর গোবিন্দ, মাধব ও বাসুদেব ঘোষ, বংশী বদন প্রভৃতি এঁরা অধিকাংশ রাধা বিষয়ক পদ লিখলেও কৃতিত্ব অর্জন করেছেন গৌরবিষয়ক পদে।


চৈতন্যদেবের জীবিতকালেই তাঁরা জন্মগ্রহণ করেছেন কিন্তু বৃন্দাবনের ষড় গোস্বামীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কাব্য রচনা করেছেন। এরূপ বিশিষ্ট কবিদের চৈতন্যোত্তর কালের কবিরূপে গ্রহণ করাই বিধেয়। এঁদের মধ্যে বলরাম দাস, জ্ঞানদাস, লোচন দাস প্রভৃতি চৈতন্য সহচরদের সাক্ষাৎ সম্পর্কে এসেছিলেন। এর পরের পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য নরোত্তম দাস, রামচন্দ্রদাস, গোবিন্দদাস, গোবিন্দ চক্রবর্তী প্রভৃতি। চৈতন্যসমকালীন কবিরা চৈতন্যের ভগবত সত্তায় আস্থাবান ছিলেন বলে তাঁরা শ্রীকৃষ্ণের লীলার অনুসরণে গৌরাঙ্গ লীলার পদ রচনাতেই বিশেষ আগ্রহী হয়েছিলেন। কিন্তু উত্তরকালের কবিরা গৌড়ীয় বৈষ্ণুব ধর্মের তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন বলে নিষ্ঠাভরে তা অনুসরণ করেছেন। ফলে তাঁরা রাধাকৃষ্ণ লীলায় মঞ্জুরীভাবে অর্থাৎ পরিচারিকার ভূমিকা গ্রহণ করে দূর থেকে সেই লীলা প্রত্যক্ষ করেছেন।


সর্বোপরি বলতে হয় প্রাকচৈতন্য কবিগণ লোকায়ত জীবন থেকে উপাদান সংগ্রহ করে রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদ রচনা করেছিলেন। পূর্ব যুগের কবিদের রচনায় ভক্তির পরিচয় ছিল। কিন্তু তা ছিল ঐশ্বর্যভিত্তিক। পরবর্তী কবিদের ভক্তি রাগানুরাগ মাধুর্যসিক্ত। আসলে ভগবানকে ঈশ্বর বুদ্ধির স্বরূপ আয়তনে প্রত্যক্ষ না করে চৈতন্য-উত্তর কবিগণ মানবীয় সম্পর্কের বাস্তব লীলায় নিয়ে আসার ফলে পরবর্তী সাহিত্যে মাধুর্য রসের প্রবাহের সঙ্গে বাৎসল্য এবং সখ্য রসেরও সন্ধান পাওয়া যায়, যা পূর্ববর্তীকালে ছিল না।


ষোড়শ শতাব্দী বৈষ্ণবপদাবলীর সুবর্ণযুগ

বৈষ্ণব ধর্মের সঙ্গে বৈষ্ণব পদাবলী অভিন্ন আত্মা'—এই অনুমানের ভিত্তিতে অনেকের মতে বৈষ্ণবপদসাহিত্য একান্তভাবেই চৈতন্য উত্তর কালের সৃষ্টি। কিন্তু এই অনুমান অতিশয় ভ্রান্ত। বৈষ্ণবধর্মের সঙ্গে বৈষ্ণব পদের যোগটা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত নয় বলেই বিদ্যাপতির মতো পঞ্চোপাসক স্মার্ত ব্রাহ্মণ সন্তান এবং মুর্তজা, বসির, আলাওল প্রভৃতির মতো মুসলমান কবিগণও বৈষ্ণবপদ রচনায় কোনও দ্বিধাবোধ করেননি। আবার মহাপ্রভু চৈতন্যদেব বৈষ্ণব সাধনার প্রচলিত রীতি সমূহ থেকে একটু সরে গিয়ে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের প্রবর্তন করলেও চৈতন্য আবির্ভাবের কয়েক শতাব্দী পূর্ব থেকেই গৌড়বঙ্গে ও ভারতবর্ষে যে বৈষ্ণবধর্ম প্রচলিত ছিল এবং রাধাকৃষ্ণের প্রেমকাহিনি অবলম্বনে বিভিন্ন কাব্য রচিত হয়েছিল, তার বহু প্রমাণ বিদ্যমান রয়েছে। কাজেই চৈতন্য পূর্বকালে প্রচলিত বৈষ্ণব পদ এবং চৈতন্যোত্তর কালে রচিত বৈশ্বব পদের একটা তুলনামূলক আলোচনা যে কোন বৈষ্ণবপদ রস পিপাসু পাঠকের নিকট অতিশয় প্রাসঙ্গিক।


শুধু গৌড়বঙ্গেই নয়, সম্ভবত সমগ্র ভারতবর্ষে গৌড়েশ্বর লক্ষণসেনের সভাপণ্ডিত জয়দেব রচিত 'গীতগোবিন্দ' কাব্যেই সর্বপ্রথম সুশৃংখলভাবে রাধাকৃষ্ণের প্রেমকাহিনি অবলম্বনে পদ ও গীতের সন্ধান পাওয়া যায়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য মহাভারতের ‘মিল’ অংশ, হরিবংশ, শ্রীমদ্ভাগবত, বিষ্ণুপুরাণ প্রভৃতি গ্রন্থ সমূহে সবিস্তারে কৃষ্ণ কাহিনি গীত হলেও রাধিকার কোনও উল্লেখ এ সকল গ্রন্থে নেই। বিচ্ছিন্নভাবে কোনও কোনও সংস্কৃত ও প্রাকৃত প্রকীর্ণ শ্লোকে এবং পরবর্তীকালের কোনও কোনও পুরাণে রাধাকৃষ্ণের প্রেমবিষয়ক কাহিনি পরিবেশিত হলেও জয়দেবের ‘গীতিগোবিন্দ' কাব্যেই বিষয়টি সর্বপ্রথম একটি পালার আকারে লিপিবদ্ধ হয়। এরপর বড়ু চণ্ডীদাস প্রধানত গীতগোবিন্দের আদলেই তাঁর ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কাব্যটি রচনা করেন। বিস্ময়ের সঙ্গে উল্লেখ করা চলে যে, ‘গীতিগোবিন্দ’ বৈষ্ণব কাব্যরূপে স্বীকৃত হলেও—‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ অদ্যাবধি বৈষ্ণব কাব্যের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়নি। কাব্যটিতে মধুর রসের একান্তই অভাব। এতে কৃষ্ণের ঐশ্বর্যরসই ফুটিয়ে তোলবার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এর একান্ত লৌকিকতা এবং গ্রাম্যতা আদি রস সম্ভবত এটিকে বৈষ্ণব সমাজের সমাদর থেকে বঞ্চিত করেছে।


মালাধর বসু ‘ভাগবত পুরাণের’ দশম ও একাদশ স্কন্দ অবলম্বনে ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্য রচনা করলেও এতে ভিন্ন সূত্রে রাধাকাহিনি সংযোজন করেছেন। কিন্তু এটি আখ্যায়িকা কাব্য এবং স্বয়ং চৈতন্যদেব মালাধর বসুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করলেও বৈষ্ণব সম্প্রদায় এটিকে বৈষ্ণব কাব্যরূপে গ্রহণ করেননি। মৈথিল কবি বিদ্যাপতি কর্তৃক ব্রজবুলি ভাষায় রচিত পদগুলিই বস্তুত রাধাকৃষ্ণের প্রেম সম্পর্কিত প্রথম বৈষ্ণব পদরূপে স্বীকৃত হয়ে থাকে। বিদ্যাপতি যে সকল গ্রন্থ রচনা করেছেন তা থেকে অনুমিত হয় তিনি বৈষ্ণব ছিলেন না। তিনি ছিলেন পঞ্চোপাসক স্মার্ত ব্রাহ্মণ সন্তান। তাঁর রচিত পদগুলির ভাষা, ছন্দ, অলঙ্করণের বৈশিষ্ট্য অতিশয় হৃদয়গ্রাহী, এদের বিষয় বৈচিত্র্য ও অসাধারণ, বৈষ্ণবগণ বিদ্যাপতির পদগুলিকে হৃদয়ের ধন বলেই গ্রহণ করলেও তাতে যেন কবি আত্মার স্পর্শ নেই। কবি চণ্ডীদাসই সম্ভবত বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম যথার্থ বৈষ্ণবপদ রচনা করেন। স্বয়ং চৈতন্যদেব বিমুগ্ধ চিত্তে বিদ্যাপতি এবং চন্ডীদাসের পদের স্বাদ গ্রহণ করতেন বলে তাঁর জীবনীকারগণ উল্লেখ করেছেন। এখানে যে সকল কবি ও কাব্যের উল্লেখ করা হল সবাই চৈতন্য পূর্ববর্তী।


চৈতন্য পূর্ব ও চৈতন্য উত্তর কবিদের বিভাজনটি অন্যভাবেও ধরা যেতে পারে। চৈতন্য পূর্ব যুগের কবিদের সাধারণভাবে পঞ্চদশ শতকের এবং চৈতন্যোত্তর যুগের প্রথম পর্যায়ের কবির সাধারণভাবে ষোড়শ শতকের ধরা হয়। এঁরা প্রকৃতপক্ষে গৌড়ীয় বৈষ্ণব রস শাস্ত্রসম্মত পঞ্চরসের ভাষ্যরূপে অজস্র পদ রচনা করে বৈষ্ণব সাহিত্যকে বিশ্বসাহিত্যের দরবারে উপস্থিত করেছেন। ষোড়শ শতকের বৈষ্ণব কবি এদের মধ্যে রয়েছেন জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, বলরামদাস, লোচনদাস প্রভৃতি—তাঁরা বৈষ্ণব সাহিত্যকে উৎকর্ষের চরমসীমায় উন্নীত করেন, যার জন্য ষোড়শ শতককে বলা হয় বৈষ্ণব সাহিত্যের সুবর্ণযুগ। চৈতন্যের‌ সমকালীন বৈবপদ রচয়িতাদের প্রায় সকলেই ছিলেন চৈতন্যদেবেরই সহচর। এঁদের মধ্যে রয়েছেন—চৈতন্যদেবের বয়োজ্যেষ্ঠ ভক্ত ও পরিকর মুরারিগুপ্ত, চৈতন্য সহাধ্যায়ী মুকুন্দ দত্ত ও তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র বসুদেব দত্ত, নরহরি দাস ঠাকুর, চৈতন্য সহচর গোবিন্দ, মাধব ও বাসুদেব ঘোষ ভ্রাতৃদ্বয়, বংশীবদন প্রভৃতি। এঁরা অনেকেই রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক‌ পদ রচনা করলেও অধিকাংশ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ রচনায়।


বৃন্দাবনের ষড়-গোস্বামীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কাব্য রচনা করেছেন এরূপ বিশিষ্ট কবিদের চৈতন্যোত্তর কালের কবিরূপে গ্রহণ করাই বিধেয়। এদের মধ্যে বলরাম দাস, জ্ঞান দাস, লোচনদাস প্রভৃতি চৈতন্য সহচরদের সাক্ষাৎ সম্পর্কে এসেছিলেন। এরপরের পর্যায়ে উল্লেখ্যযোগ্য— নরোত্তম দাস, রামচন্দ্র দাস, গোবিন্দ দাস, যদুনন্দন, শেখর, গোবিন্দ চক্রবর্তী প্রভৃতি। চৈতন্য সমকালীন কবিরা চৈতন্যের ভগবৎসত্তায় আস্থাবান ছিলেন বলে তাঁরা শ্রীকৃষ্ণের লীলার অনুসরণে গৌরাঙ্গ লীলার পদরচনাতেই বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। অধিকন্তু এঁরা বৃন্দাবনের গোস্বামীদের প্রবর্তিত তত্ত্বের দ্বারা প্রভাবিত হবার সুযোগ পাননি বলেই রাধাকৃষ্ণের লীলায় সখী, দূতী বা বন্ধুরূপে অংশগ্রহণ করেছেন। কিন্তু উত্তরকালের কবিরা গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের তত্ত্বে অভিষিক্ত হয়েছিলেন বলে ঘনিষ্ঠভাবে তার অনুসরণ করেছেন। ফলে তাঁরা রাধা কৃষ্ণলীলায় মঞ্জরী ভাবের অর্থাৎ পরিচারিকার ভূমিকা গ্রহণ করে দূর থেকে সেই লীলা প্রত্যক্ষ করেছেন।


সমগ্রভাবে চৈতন্য পূর্ববর্তী ও চৈতন্য উত্তর যুগের বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যের তুলনামূলক আলোচনা রূপে অধ্যাপক পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য তাঁর “বৈষ্ণবপদাবলী ঃ উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ” গ্রন্থে লিখেছেন—“রাধাভাব দ্যুতি সুবলিত কৃষ্ণস্বরূপ চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের ফলে যে দুকূলপ্লাবী প্রবাহ দেখা দিয়াছিল, তার পূর্বেই মহাজন পদকর্তাগণ রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা অবলম্বনে বহু উৎকৃষ্ট পদ রচনা করে ধন্য হয়েছেন। তবে ওই সকল পদ রচিত হয়েছিল সাহিত্য বোধের প্রেরণায়, এর সঙ্গে বৈব ধর্ম বা দর্শনের বিশেষ কোনও যোগ ছিল না, তাই তখনকার পদাবলীতে মানবিক অনুভূতি এবং প্রেমসম্ভোগের চিত্রই প্রাধান্য লাভ করেছে। চৈতন্য দেবের আবির্ভাব তাঁর সমকালীন এবং পরবর্তীকালের ভক্তদের মনকে এমন ভাবে অভিভূত করেছিলেন যে চৈতন্যলীলাকেই তাঁরা সাংসার রূপে গ্রহণ করেছিলেন এবং এর আলোকেই রাধাকৃষ্ণের লীলাকে তাঁরা উপভোগ করেন। তাঁরা যেন লীলাসুখ—দূর থেকে মঞ্জুরী অংশভাবে ওই লীলা দর্শনেই তৃপ্ত হতেন। পূর্ববর্তী কবিদের মতো তাঁরা কৃষ্ণলীলায় কোনও অংশগ্রহণের অধিকারী ছিলেন না। এমনকি মোক্ষবাঞ্ছা কেতব প্রধান জেনে চৈতন্য পরবর্তী কোনও মহাজন কবি বিদ্যাপতির প্রার্থনা পদের মতো মুক্তি প্রার্থনা করেননি। অথবা চন্ডীদাসের নিবেদন পদের মতো ঐশ্বর্য চেতনারও প্রকাশ ঘটাননি। তাই চৈতন্য উত্তর যুগের কাব্যকে নিছক সাহিত্যরূপে বিচার করা চলে না—একে বলা চলে, বৈষ্ণব তত্ত্বের রসভাষ্য।


অর্থাৎ প্রাকচৈতন্য কবিগণ লোকায়ত জীবন থেকে উপাদান সংগ্রহ করে রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদরচনা করেছিলেন। পূর্ব যুগের কবিদের রচনায়ও ভক্তির পরিচয় ছিল কিন্তু তা ছিল ঐশ্বর্যভিত্তিক, পরবর্তী কবিদের ভক্তি রাগানুরাগ, মাধুর্যসিক্ত। আসলে ভগবানকে ঈশ্বরবুদ্ধির আলোকে প্রত্যক্ষ না করে চৈতন্য উত্তর কবিগণ মানবীয় সম্পর্কের বাস্তবসীমায় নিয়ে আসার ফলে পরবর্তী সাহিত্যে মাধুর্য রসের প্রবাহের সঙ্গে বাৎসল্য এবং সখ্যরসেরও সন্ধান পাওয়া যায়, যা পূর্ববর্তী কালে ছিল না।