বাংলা কাব্য কবিতার ধারায় কাজী নজরুল ইসলামের স্থান | বাংলা কাব্য কবিতার ধারায় কাজী নজরুল ইসলামের স্থান অবদান ও কৃতিত্ব

বাংলা কাব্য কবিতার ধারায় কাজী নজরুল ইসলামের অবদান ও ভূমিকা


ভারতবর্ষ পরাধীন। পরাধীন ভারতবর্ষে তখন চলেছে উত্তাল মুক্তি যুদ্ধের সংগ্রাম। গান্ধীজীর নেতৃত্বে একের পর এক বিপ্লব ঘটে চলেছে এদেশে। অসহযোগ আন্দোলন সারা বাংলা দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে। ঠিক সেই সময়ে দৃপ্ত কণ্ঠে বিদ্রোহের বাণী নিয়ে বাংলা কাব্য জগতে আবির্ভূত হলেন নজরুল। সমসাময়িক যুগ চেতনায় তাঁর কাব্যের মোড় ঘুরিয়ে দিল। ব্রিটিশ সরকারের অত্যাচারের প্রতি তার বিদ্রোহ। বিদ্রোহই এ দেশের জমিদার, মালিক ও সুদখোর মহাজনদের বিরুদ্ধে। এদের অত্যাচারের কাছেই খুঁজে পেলেন তার কাব্যের ভাষা। তবে তার এ বিদ্রোহ মূলত অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে। নজরুল এসেই যে বিদ্রোহের বাণী সঞ্চারিত করে দিলেন তার তেজ ভবিষ্যতে কখনো স্তিমিত হয়ে পড়েনি। তাই রবীন্দ্রনাথের পর বর্তমান কাব্য আন্দোলনের মধ্যে সঠিকভাবে কেউ যদি কবিতার মোড় ঘুরিয়ে থাকেন তিনি হবেন নজরুল। স্বয়ং বুদ্ধদেব বসু স্বীকার করেছেন : "সব কটা জানালা খুলে নূতনের হাওয়া প্রথম যিনি সবেগে বইয়ে দিলেন, তিনি নজরুল ইসলাম, নজরুলের ছিল দৃপ্ত কণ্ঠস্বর, অব্যবহিত আঘাতের শক্তি, তাই রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক কবিদের মধ্যে তাকেই আজ উজ্জ্বলতম সেতু বলে মনে হয়।"


কাজী নজরুল ইসলামের পরিচয়:

নজরুল আয়ু পেয়েছিলেন ৭৭ বছর। সচেতনভাবে বেঁচে ছিলেন মাত্র ৪৩ বছর। ২৩ বছরের কবি ও কর্মী জীবন তাঁকে দিয়েছে চির জীবনের সম্মান। বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে কবির জন্ম। বাল্যেই পিতৃবিয়োগ এবং দারিদ্র্যের দুভাগে জীবনের সূচনা। ভৃত্যের কাজ থেকে শুধু করে ৪৯ নম্বর বাঙালী পণ্টনে যোগদান পর্যন্ত বিভিন্ন পেশার মধ্য দিয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়। তারপরে পরাধীন ভারতে ইংরেজ শাসন ও শোষণ সামন্ততন্ত্র ও জমিদারদের অত্যাচারে প্রজাসাধারণের দুর্দশা, ধর্মীয় বিদ্বেষ জাতিভেদ ও সাম্প্রদায়িকতা-রাজনৈতিক উৎপীড়ন দেখে অগ্নিক্ষরা প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠা। অন্যদিকে প্রেম প্রণয়ভঙ্গী বিবাহবিচ্ছেদ ইত্যাদি ঘটনার প্রতিক্রিয়ায়, প্রেমের আবেগে একের পর এক কবিতা লিখে যাওয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফজিলতুন্নেসার কাছে প্রেম নিবেদন ও প্রত্যাখ্যান, রানু সোমকে গান শেখাতে গিয়ে অপ্রিয় ঘটনা, দৌলতপুরে সৈয়দা খাতুন ওরফে নার্গিসের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ, কুমিল্লায় ধীরেন্দ্র সেনগুপ্ত ও গিরিবালার কন্যা দোলন চাপা আশালতা ওরফে প্রমীলার সঙ্গে প্রণয় ও বিবাহ শনিবারের চিঠিতে সেই নিয়ে সমালোচনা প্যারডি রচনা ইত্যাদি। “অতীত দিনের স্মৃতি” যার কথা “কেউ ভোলে না কেউ ভোলে।”


কাজী নজরুল ইসলামের রচিত কাব্য গ্রন্থ :

অগ্নিবীণা (১৯২২), ভাঙার গান (১৯২৪), সাম্যবাদী (১৯২৫), ফণিমনসা (১৯২৭), চক্রবাক্ (১৯২৯), বিষের বাঁশী (১৯২৪), ছায়ানট (১৯২৫), সর্বহারা (১৯২৬), সিন্ধুহিন্দোল (১৯২৭), প্রলয়শিখা (১৯৩০) ইত্যাদি।


কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যের পটভূমি :

ঘটনাবহুল নজরুলের জীবনের মতোই তাঁর কাব্যের পটভূমিও বৈচিত্র্যময়। বিষয় বৈচিত্র্যে ও কল্পনায় নজরুলের কবিতা সমৃদ্ধ তাঁর কবিতা সমূহকে সাধারণভাবে দুটি ভাগে বিন্যস্ত করা যায়। ১। বিষয় নিষ্ঠ ও বক্তব্যপ্রধান। ২। ব্যক্তিনিষ্ঠ ও কল্পনা প্রধান। প্রথম পর্যায়ের কাব্য কবিতার মধ্যে সমাজ ; সমাজের আর্থ রাজনৈতিক অবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে নানা সমস্যা, বিদ্রোহ, বিক্ষোভ, অভিযোগ, স্বদেশ, যুদ্ধ ঘোষণা প্রভৃতি দেখা যায়। দ্বিতীয় পর্যায়ে বিশুদ্ধ Lyric বা কবি মনের ভাব উচ্ছ্বাস, ব্যক্তিময়তা বা মৃন্ময়ভাব প্রাধান্য পায়। যদি নজরুলের সমগ্র কাব্য কবিতাকে সঠিক বিশ্লেষণের দ্বারা বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যে বিভাজন করা যায় তাহলে কয়েকটি বিভাগ বেশ প্রকট হয়ে ওঠে


1) বিদ্রোহ ও সমাজ ভাবনা : নজরুলের বস্তুনিষ্ঠ ও বক্তব্যপ্রধান কবিতাগুলির মধ্যে বিদ্রোহী, ফরিয়াদ, সাম্যবাদী, অন্ধস্বদেশ, দেবতা, কাণ্ডারী হুঁশিয়ার প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এইসব কবিতার মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা ও বিদ্রোহের দীপ্তি ও দাহ যুগমানসের বৈশিষ্ট্য রূপে প্রকাশ লাভ করেছে। আমার কৈফিয়ৎ কবিতায় তিনি স্পষ্টই বলেছেন :

“প্রার্থনা করো-যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটী মুখের গ্রাস।

যেন লেখা হয় আমার রক্ত লেখায় তাদের সর্বনাশ।”


বিদ্রোহী কবিতা তীব্র চিৎকারে ঘোষণা করেছেন—

“আমি সেই দিন হবো শান্ত যবে

উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবেনা 

অত্যাচারীর ঘড়া কৃপাণ ভীম রণভূমে বসিবে না।”


আবার কখনো বিপ্লবের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করার প্রেরণায় তিনি গেয়েছেননবীন মন্ত্রে দামিতে দীক্ষা আসিতেছে ফাল্গুনী।


জাগোরে জোয়ান। ঘুমায়ো না ভূয়ো শান্তির বাণী শুনি। কবি ধ্বংসের জয়গান গাইলেও তার মধ্যে নূতন জীবনের ইঙ্গিতও দিয়েছেন :

“ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর প্রলয় নূতন সৃজন বেদন

আছে নবীন জীবন হারা অসুন্দরে করতে ছেদন।”


তাই ওই নূতনের কেতন ওড়ে কালবৈশাখীর ঝড়।” দেখে তিনি আনন্দিত, শুনতে পেয়েছেন সেই অমর বার্তা—

ফাসীরমঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান।

আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা দিবে কোন বলিদান।”


সাম্প্রদায়িক বিভেদনীতির বিরুদ্ধে দেশনেতাকে হুঁশিয়ার করে দেওয়ার সচেতনতাই কাণ্ডারী হুঁসিয়ার কবিতার মর্ম সত্য, এছাড়া বিপ্লববাদের মতোই নজরুলের 'সাম্যবাদী ইন্টারন্যাশানাল গীতি, কৃষাণের গান, শ্রমিকের গান, গান, ধীবরের গান প্রভৃতি কবিতায় জাতিভেদ হীন সাম্প্রদায়িকতা মত্ত এক উদার সাম্যবাদী ভাবনা প্রতিফলিত। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ভাষায় : “বিশুদ্ধ আবেগজীবী নজরুল অত্যাচারিতের প্রতি সমর্থনে। শোষক সম্প্রদায়ের প্রতি মহৎ ঘৃণায় এবং সর্বমানবিক কল্যাণবোধের আমন্ত্রণে সাম্যবাদের কাছে এসেছেন।” এখানেই তাঁর অনন্যতা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।


2) প্রেম ও প্রকৃতি বিষয়ক :

বিদ্রোহ ও বিপ্লবের কবিতার মধ্যেই নজরুলের কবি প্রতিভা শুধু আবর্তিত হননি। ‘বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি’ গানের আড়াল, আমি গাই তার গান প্রভৃতি কবিতায় প্রেম ও প্রকৃতির অপূর্ব সমাহার অনুভব করা যায়। যেমন বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি কবিতায় কী আশ্চর্য সুন্দর প্রেম চেতনা আত্মপ্রকাশ করেছে :

নিশীথিনী যায় দূর বনছায় তদ্ৰায় ঢুলুঢুলু।

ফিরে ফিরে চায় দুহাত জড়ায় আঁধারের এলোচুল।’

কবি মুসাফির নজরুল কুমিল্লায় থাকাকালীন তার ঘরের জানালার পাশে গুবাক তরুর সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। কোন এক অনামিকা প্রেমিকার কাছে হৃদয় নিবেদনের মুহূর্তে তার স্মৃতিচিত্র কবিকে আলোড়িত করেছে। আবার ‘গানের আড়াল’ কবিতায় ও রোমান্টিকতার বিরহ মাধুর্যে মনোহর :

জানায়ো আমারে, যদি আসে দিন এইটুকু শুধু যাচি। 

কণ্ঠে পরায়ে হয়েছি তোমার হৃদয়ের কাছাকাছি।


3) শিশু বিষয়ক :

কাজী নজরুল বেশ কিছু শিশু বিষয়ক কাব্য কবিতা নাটক রচনা করেছেন। তার ‘খুকুও কাঠবিড়ালী’, ‘প্রভাতী’, ‘লিচুচোর’, ‘ঝুমকো লতায় জোনাকী’, ‘মটকু মাইতি’, ‘বাঁটকুল রায়’, ‘ঘুমপাড়ানি গান’, ‘আমি যদি বাবা হতাম’, ‘বাবা হত খোকা', 'সাত ভাই চম্পা', 'শিশুর জাদুকর' ইত্যাদি কবিতাগুলি এই পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য। খুকুর চোখে কাঠ বিড়ালীর যে জীবন্ত অবয়ব ফুটে উঠেছে তা সত্যই চমৎকার : 

“দাঁত দেখিয়ে দিচ্ছ ছুট? 

অমা দেখে যাও।।”

কাঠবিড়ালী। তুমি মর? 

তুমি কচু খাও।।

সমগ্র দৃশ্যটি যেন শিশুর কণ্ঠস্বর সহ একটি শ্রুতিময় চিত্র হয়ে ওঠে। তাঁর ‘পুতুলের বিয়ে’ নাকি শিশু মনের উপযোগী নাটক ও কবিতার সমাবেশ দেখা যায়।


4) সঙ্গীত বিষয়ক :

গান রচনায় নজরুল ‘স্বরাজ্যে স্বরাট’। তারই রচিত গান নজরুল গীতি নামে পরিচিত। তিনি আগমনী বিজয়া, রাম শ্যাম বা কৃষ্ণ, চৈতন্য শঙ্কর দুর্গা, সরস্বতী বন্দনামূলক, মহাপুরুষ বন্দনা, বৈষ্ণব ভাবমূলক, হাস্য রসাত্মক, গজল, মারফতী-মর্শিদ, জারি, সারি, ঝুমুর, খেয়াল ঠুংরী, বাউল, কাজরী, ভাটিয়ালী শ্যামাসঙ্গীত প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের গান রচনা করে সাঙ্গীতিক প্রতিভার বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। শ্যামাসঙ্গীত প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের গান রচনা করে সাঙ্গীতিক প্রতিভার বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। কাব্য ও কবিতা রচনায় নজরুলের যে অসংযম ও বাণীশৈথিল্য দেখা যায় গানে তার পরিচয় অবিরমা নয়, বাংলা সাহিত্যের সুরসিক ও ভাবুকের কাছে নজরুল আজও নিত্য প্রেরণা।


সর্বশেষে বলতে হয়, বাংলা কাব্য কবিতার জগতে জনপ্রিয়তা এবং কবি প্রতিভার দিক থেকে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সকলের শীর্ষে। রবীন্দ্রকাব্য পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ ও মোহিতলাল। কিন্তু যারা রবীন্দ্র কাব্য পরিমণ্ডলের বাইরে কাব্য সাধনা করেছিলেন তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে নাম করতে হয় নজরুলের, নজরুল যুগচেতনার কবি, হুজুগের কবি, যুগচেতনার কবি হয়েও তিনি যুগতীর্ণ। হয়তো তিনি ভেবেছিলেন যুগের হুজুগ কেটে গেলে তার কাব্য কবিতা সকলের কাছে তেমন সমাদর পাবে না। “পরোয়া করিনা বাঁচি বা না বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে। “কিন্তু যুগের হুজুগ কেটে যাওয়ার পরও তিনি বেঁচে আছেন। শতবর্ষ পরেও আমরা তাকে ভুলে যাইনে। ভোলার কথাও নয়। আজও আমাদের মনে রাখতে হয় তাঁর সেই অমর বাণী—“মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।”