বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস : সাহিত্য টীকা : আধুনিক যুগ (নাটক : নাট্যকার)

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস : সাহিত্য টীকা : আধুনিক যুগ



নাটক : নাট্যকার

কুলীনকুল সর্বস্ব (১৮৫৪)

গ্রন্থকার : রামনারায়ণ তর্করত্ন।

গ্রন্থরূপ : সামাজিক নাটক।

বিষয় : বাংলাদেশে কৌলীন্য প্রথার ফলে বঙ্গদেশে নারী গণের দুরবস্থা এবং কুলীন পুত্রদের ব্যভিচার ও নীচতার পরিচয় এই নাটকে উপস্থিত। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা কুলপালক বন্দ্যোপাধ্যায় বহুকাল পরে এক কুলীন পাত্র খুঁজে পেয়ে স্থির করেন ওই এক জনের হাতে তাঁর চার কন্যা সমর্পণ করবেন। সেই সূত্রে মেয়েদের প্রতিক্রিয়া, ঘটকের কপট ব্যবহার, কুলীনদের অনাচার, বিরহী পঞ্চাননের শোক ভোগ এবং কৌলীন্য প্রথা সংক্রান্ত নানাবিধ সমস্যা এখানে বর্ণনা করা হয়েছে।

কেন উল্লেখযোগ্য :

১। বঙ্গীয় সমাজের সমস্যাকে কেন্দ্র করে নাটক রচনার সূত্রপাত হয়। কৌলীন্য প্রথা সংক্রান্ত সামাজিক কলঙ্কের ঘটনাসমূহ প্রকাশ পায়। 

২। এই নাটককে আশ্রয় করে বাংলা নাটকের নিয়মিত মঞ্চাভিনয়ের সূচনা হয়। সেইজন্য 'কুলীনকুল সর্বস্ব' হয়ে ওঠে 'বাংলার আদি নাটক'।

৩। সামাজিক বিষয় বাংলা নাটকে প্রাধান্য পায়, সামাজিক সমস্যা নির্ভর নাটক লিখে পুরস্কার প্রাপ্তির ঘটনা ঘটে। রামনারায়ণ তর্করত্ন স্বয়ং এই নাটক লিখে রংপুরের জমিদার কালীচরণ রায় চৌধুরীর কাছ থেকে পুরস্কার লাভ করেন। 

৪। সংস্কৃত রীতি এবং যাত্রা পদ্ধতির সংমিশ্রণ এই নাটকে লক্ষ্য করা যায়। তবে নাট্যরূপেও এর সাহিত্য মূল্য ছিল। 

৫। সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে সাহিত্যিক প্রতিবাদের একটি ধারা এই নাটক রচনার প্রভাবে লক্ষ্য করা যায়।




ছেঁড়া তার (১৯৫০)

গ্রন্থকার : তুলসী লাহিড়ী।

গ্রন্থরূপ : নাট্য গ্রন্থ।

বিষয় : মন্বস্তরের পটভূমিতে লেখা হয় তুলসী লাহিড়ীর শ্রেষ্ঠ নাটক ছেঁড়া তার। এই নাটকের কাহিনি কৃষক জীবনাশ্রিত এবং তা প্রান্ত উত্তরবঙ্গের রংপুর জেলাকে ভিত্তি করে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। স্মরণীয় তুলসী লাহিড়ীর বাসভূমি ছিল—রংপুর জেলার নলডাঙ্গা গ্রাম। মফস্বল শহর রূপে রংপুরের কোনও একটি অঞ্চল এবং রংপুরের কোনও সুদূর অঞ্চলের একটি গ্রাম এই নাটকের পটভূমি। এ নাটকে দুটি বিরুদ্ধ পক্ষের সৃষ্টি করা হয়েছে। অত্যাচারী ও নিপীড়ক, রূপে এখানে আছে হাকিমুদ্দী এবং অত্যাচারিত সংগ্রামী মানুষের মুখপাত্র রূপে আছে রহিমুদ্দী। এই দৃষ্টিতে বিচার করলে দেখা যাবে এ নাটক হাকিমুদ্দী বনাম রহিমুদ্দীর বিরোধ। এই বিরোধের একদিকের ফলাফল হোল সমবেত ও ঐক্যবদ্ধ জনগণের কাছে হাকিমুদ্দীর পরাভব ও শাস্তিভোগ; অপর পর্যায়ের ফল— রহিমুদ্দীরই পরাভব, তার আত্মহত্যা। কিন্তু সেই আত্মহত্যা যেখানে সমস্যার সমাধান না করে সমস্যাকেই জটিলতর করে তুলেছে সেখানেই নাটকটির মধ্যে এসে পড়েছে একটি ভিন্নতর মাত্রা। নাটকের মূল রসপ্রকৃতি সেখানেই নিহিত।

কেন উল্লেখযোগ্য :

গণনাট্য ও নবনাট্য আন্দোলনের শ্রেষ্ঠ নাটক হিসাবে 'ছেঁড়া তার' নাটকের জুড়ি মেলা ভার। অন্যায় অবিচার অত্যাচারের বিরুদ্ধে সমাজকে সচেতন করা এবং মানুষের শ্রেষ্ঠ গুণগুলি প্রকাশে নাট্যকার এ নাটকের নাট্যচরিত্র নির্মাণের উপর জোর দিয়েছেন। সমাজ সচেতন শুভ চেতনায় বিশ্বাসী এই নাট্যকার আশাবাদী মানুষের সে চিত্র অঙ্কন করেছেন তা সত্যই তুলনা রহিত। নাট্যকার নিজেই স্বীকার করেছেন তাঁর 'নাট্যকারের ধর্ম নামক প্রবন্ধে–“আজও যাঁরা বেঁচে আছে তারা রাত্রির সাধনা করে প্রভাতকে বরণ করে আনবে এই আশায় উন্মুখ হয়ে দিগস্তে চেয়ে আছে,—কবে এ মেকী সভ্যতার দম্ভ দূর হবে, কবে শাসন সংরক্ষণের নামে হৃদয়হীন শোষণের অবসান হবে, কবে মানব সত্যসত্যই হৃদয়-ধর্মী হবে সেই আশায়।” বলতে দ্বিধা নেই ‘ছেঁড়া তার' নাটকের মজ্জায় মজ্জায় এই সুর ধ্বনিত হয়েছে। তাই বঙ্গ নাট্য সাহিত্যের ইতিহাসে ও গণনাট্যের আঙিনায় 'ছেঁড়া তার একটি অনন্য সম্পদ।



সাজাহান (১৯০৯)

গ্রন্থকার : দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। 

গ্রন্থরূপ : ঐতিহাসিক নাটক।

বিষয় : সপ্তদশ শতাব্দীর শেষার্ধে ভারত সিংহসন ঘিরে যে রাজনৈতিক চক্রান্ত ও ভ্রাতৃঘাতী সংগ্রামের রক্তাক্ত পটভূমিকা রচিত হয়েছিল, নাট্যকার তাকে জীবন্ত করে তুলেছেন। ভারত ইতিহাসের সেই দুর্যোগময় পটভূমিকায় নায়ক নায়িকার অন্তর্জীবনের কাহিনি যুক্ত করে নাট্যকার মানবজীবনেরই রহস্য উদ্ঘাটন করেছেন। দুর্গে বন্দি সাজাহানের দ্বন্দ্ব বিড়ম্বিত মর্মান্তিক পরিণতি, কূটকৌশলী ঔরঙ্গজেবের জটিল চরিত্র, মদ্যপায়ী নির্বোধ, বিলাসপ্রিয় সুজা, উদার হৃদয় দারা, ব্যক্তিত্বময়ী তেজস্বিনী জাহানারা লঘু চপল পিয়ারা, কর্তব্যনিষ্ট মোহম্মদ, প্রভৃতি চরিত্র স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। দিলদার নাট্যকারের বিশিষ্ট সৃষ্টি। সব মিলিয়ে মুঘল যুগের ঐশ্বর্য ও রক্তাক্ত লোভের সংঘাতময় পটভূমিকায় মানুষের প্রবৃত্তিধর্ম ব্যক্তি চরিত্র এখানে বিশেষ ভাবে অঙ্কিত হয়েছে।

কেন উল্লেখযোগ্য :

১। ইতিহাসের কাহিনিকে অবিকৃত রেখে বিচিত্র ঘটনা ও চরিত্রকে ঐক্যের সূত্রে গেঁথে লেখক চমৎকার নাটকীয় রস সৃষ্টি করেছেন। 

২। ঘটনা বিন্যাস, চরিত্র সৃষ্টি, পরিবেশ রচনা পরিণতি সমস্ত দিক দিয়ে বিচার করলে সাজাহান ঐতিহাসিক নাটক রূপে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য।

৩। ক্ষমতালোভী শঠতা ও ক্রুরতার জীবন্ত মূর্তি ও ঔরঙ্গজেবের নাট্যে প্রতিফলিত মূর্তিটি দেখবার মতো।

৪। দারার কাহিনি নাটকের মধ্যে উজ্জ্বলভাবে উপস্থাপিত।

৫। দ্বিজেন্দ্রলালের নাট্য সম্ভারের মধ্যে সাজাহান শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী।

৬। শেক্সপীয়রের ‘King Lear’ নাটকের সঙ্গে সাজাহানের সাদৃশ্য মেলে।



জামাই বারিক (১৮৭২)

গ্রন্থকার : দীনবন্ধু মিত্র।

গ্রন্থরূপ : প্রহসন ধর্মী নাটক।

বিষয় : সপত্নী ঈর্ষা, কলহ পীড়িত বহুপত্নীক স্বামীর সমস্যা এ নাটকের মূল উপজীব্য। ঘর জামাই অভয় চরণ নিঃস্ব, মূর্খ, নেশাখোর, শ্রমবিমুখ। ধনীকন্যাকে বিয়ে করে গৃহপালিত জামাতা হয়ে থাকার কি সুখ হাড়ে হাড়ে সে টের পেয়েছে, স্ত্রীর দ্বারা লাঞ্ছিত হয়েছে। একাধিক পত্নীগ্রহণ জনিত কারণে ঈর্ষাপরায়ণা সপত্নীদের কলহপ্রসূত সমস্যা, সেই সঙ্গে দুই পাশে দুই নাগিনী স্ত্রী, মাঝে অশান্তি জর্জর স্বামী। এক স্ত্রীর ভরণপোষণের ক্ষমতা নেই পদ্মলোচনের কিন্তু পাঁচ সাত বছর না কাটতেই দ্বিতীয় স্ত্রীকে ঘরে আনলো সে। এমন যে অপদার্থ পুরুষ, পত্নীদের কলহ যন্ত্রণা ভোগ করলেও কে তাকে সহানুভূতি দেখাবে? তার জন্য সমবেদনা জাগে না কারুর মনে।

কেন উল্লেখযোগ্য :

১। গৃহপালিত জামাতাদের ব্যারাক বা জামাইগোষ্ঠীর খোঁয়াড় এই নাটকের একটি দর্শনীয় বিষয়। 

২। কুলীন জামাইরা নিষ্কর্মা ও বেকার অবস্থায় কীভাবে শ্বশুরবাড়ী থাকতো এটি তার করুণ কাহিনি।

৩। এতে নাট্যকারের বিশেষ নাট্য নৈপুণ্যের পরিচয় মেলে। 

৪। হাস্য রসের দ্বারা এতে একটা কঠোর বাস্তবতা প্রকাশ পেয়েছে। 

৫। এ সম্পর্কে রামগতি ন্যায়রত্ন লিখলেন—“কৌলীন্যানুরোধে যাহারা ঘরজামাই রাখেন বা ঘরজামাই থাকেন, এই পুস্তক পাঠে তাঁহাদের অনেকেরই চৈতন্য হইবার সম্ভাবনা।"



‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো’ (১৮৬০)

গ্রন্থকার : মাইকেল মধুসূদন দত্ত।

গ্রন্থরূপ : প্রহসন (নাটক)।

বিষয় : ভক্তপ্রসাদ বড়ো হুঁশিয়ার জমিদার, গরীব চাষীর এক পয়সা খাজনা মুকুব করেন না। অথচ তিনি পরম রসিক। পরস্ত্রীর রূপ বর্ণনা শুনলে ভাব বিহ্বল হয়ে ভারতচন্দ্রের কবিতা আবৃত্তি করেন। হানিফের স্ত্রী ফতিমার কাছে দূত পাঠিয়ে তাঁর অভিসারকে নিশ্চিত করেছেন। তিনি যাবতীয় কুকর্মে রত, অথচ তিনিই আবার পুত্রের ধর্মাচরণের প্রতি বিশেষ সতর্ক দৃষ্টি হেনেছেন। যিনি মুসলমানী স্ত্রী সংসর্গে প্রবৃত্ত তিনিই মুসলমানের ছোঁয়া খাদ্যে বিষম আতঙ্কগ্রস্ত। এই ভক্তপ্রসাদ নাটকের শেষ দৃশ্যে তাঁর প্রাপ্য শাস্তি পেয়েছেন এবং তাঁর মনের পরিবর্তন ঘটেছে।

কেন উল্লেখযোগ্য :

১। আলোচ্য নাটকে মধুসূদনের ব্যঙ্গ সর্বাপেক্ষা তীব্র ও সার্থক হয়ে উঠেছে।

২। নাট্যকার গ্রামের মূর্খ, অশিক্ষিত কৃষক পরিবারের মুখে গ্রাম্য ভাষা দিয়ে চরিত্রগুলিকে জীবন্ত করে তুলেছেন।

৩। আলোচ্য প্রহসনটি সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে রচিত হয়ে বাস্তব ধর্মী হয়ে উঠেছে।

৪। এর প্রেক্ষাপট নবীন কল্লোলিনী কলকাতা, তাই সেখানকার বাস্তবচিত্র নাট্যাকারে প্রকাশ পেয়েছে।

৫ । তবে নাট্য মধ্যে পল্লীজীবনের কথা স্নেহ ও সহানুভূতির সঙ্গে বর্ণিত হয়েছে।



শর্মিষ্ঠা (১৮৫৯)

গ্রন্থকার : মধুসূদন দত্ত। 

গ্রন্থরূপ : পৌরাণিক নাটক।

বিষয় : শর্মিষ্ঠা একখানি মৌলিক পৌরাণিক নাটক। এই নাটকের কথাবস্তু মহাভারত থেকে নেওয়া হয়েছে। শর্মিষ্ঠা, যযাতি দেবযানীর কাহিনিকে নাট্যরূপ দিয়েছেন লেখক। পুরাণ কথিত বিষয় নাট্যবস্তু হলেও নাটক নির্মাতা অপ্রাকৃত অলৌকিককে যথাসম্ভব পরিহার করতে চেয়েছেন। সম্ভাব্যতার সীমা ডিঙিয়ে যাননি কোথাও। তবে প্রথম সৃষ্টির দোষ ত্রুটি এই নাটকের মধ্যে রয়েছে। কাহিনিতে নাটকীয়তার অভাব সকলের চোখে পড়ার মতো। দ্বন্দ্ব সংঘাত তেমন ফোটেনি, ফলে আখ্যান অংশ বিবৃতিধর্মী হয়ে পড়েছে। নাট্যোক্তির দীর্ঘতা, অলঙ্কার বহুল কবিত্বময় ভাষার অনাবশ্যক প্রয়োগ, নিসর্গ বর্ণনার অতিরেক, ইত্যাদি নাটকটির সাফল্যের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংস্কৃতানুযায়ী রাগ বিন্যাস, পাত্র পাত্রীর মুখে অস্বাভাবিক ও কৃত্রিম বলে মনে হয়। নায়িকা শর্মিষ্ঠার চরিত্র প্রাণবন্ত হয়ে ওঠেনি। তুলনায় প্রতিনায়িকা দেবযানীর চরিত্র অধিকতর বিকাশলাভ করেছে। রাজা যযাতির চরিত্র, সংস্কৃত নাটকের আদর্শে চিত্রিত বিদূষক চরিত্র, প্রভৃতিতে উল্লেখযোগ্য কোনও অভিনবত্ব লক্ষিত হয় না।

কেন উল্লেখযোগ্য :

শর্মিষ্ঠা পড়লে মনে হয়, কোনও সংস্কৃত নাটকের অনুবাদ। অভিনবত্ব কিছু থাকলেও শমিষ্ঠায় প্রাচীন নাট্যাদর্শই অনুসৃত, একে সেকালের ভালো মিলনাস্তক নাটকরূপে আখ্যাত করা যেতে পাবে। বাংলা সাহিত্যে এটিই প্রথম রোমান্টিক নাটক।



নীলদর্পণ (১৮৬০)

গ্রন্থকার : দীনবন্ধু মিত্র ওরফে কেনাচিৎপথিকেনাভি প্রণীতং।

গ্রন্থরূপ : সামাজিক নাটক।

বিষয় : স্বরপুর গ্রামে রায়ত চাষীদের দাদন দিয়ে নীল চাষে বাধ্য করা হোত। সেই সূত্রে কুঠিতে ধরে নিয়ে গিয়ে কয়েদ করা, চাবুক মারা, নারীর শ্লীলতাহানি ইত্যাদি নীলকরদের অত্যাচার বর্ণনা, গোলক বসু এবং সাধুচরণ ঘোষের পরিবারের বিপর্যয় এবং একাধিক মৃত্যু-ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। এই অত্যাচারের প্রতিরোধে গোলক বসুর জ্যেষ্ঠ পুত্র নবীন মাধব, রাইয়ত তোরাপ ও অন্যান্য কৃষকদের লাঞ্ছনা এবং পরিণতিতে নীবন মাধবের মৃত্যুঘটে৷

কেন উল্লেখযোগ্য :

১। নীলচাষ সংক্রান্ত সমকালীন এক সামাজিক সমস্যাকে প্রথম সাহিত্যের বিষয়রূপে ভাবা।

২। নীলকর তথা সাহেবদের সম্পর্কে অসন্তোষ প্রকাশে ও স্বদেশিক আন্দোলনের সূত্রপাতে গ্রন্থটি 'রাজনৈতিক’ গুরুত্ব পায়।

৩। গ্রন্থটির ইংরেজীর অনুবাদ প্রকাশের ফলে এদেশীয় আদালতে প্রথম গ্রন্থ প্রকাশের জন্য বিদেশি পাদরী জেমস লঙের জরিমানা ও কারাবাসের চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে। জনমত জাগ্রত হয়। নীলকরদের অত্যাচারে বিরুদ্ধে এদেশে ও বিদেশে বহু মানুষ প্রতিবাদে সোচ্চার হন। শাসক পক্ষ নীলকরদের বিচারের জন্য ‘নীল কমিশন' (Indigo Commission) বসাতে বাধ্য হন।

৪। যশোর, নদিয়া, ২৪ পরগণা প্রভৃতি অঞ্চলের বাক্রীতি ও সংলাপের সার্থক প্রয়োগ দেখা যায়; যেমন—রাইচরণ “মেরে তো ফ্যালতাম, ত্যাকন না হয় ছয় মাস ফাঁসী য্যাতাম।”

৫। নাটকটি সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের অকুণ্ঠ অভিনন্দন লাভ করে—স্টোর Uncle Tom's Cabin-এর সঙ্গে তিনি এর তুলনা করে সার্থক সমালোচনা করেন। 

৬। বঞ্চনা ও শোষণের বিরুদ্ধে নাটকটি পরবর্তী সাহিত্যিকদের অনুপ্রাণিত করে— ‘দর্পণাস্য’ সাহিত্য ধারা সৃষ্টি করে; যেমন— মীর মশারফের ‘জমিদার দর্পণ,' দক্ষিণারঞ্জনের ‘চাকর দর্পণ। 

৭। বঙ্গীয় সাধারণ নাট্য শালায় এই নাটকটি সর্বপ্রথম মঞ্চস্থ হয়েছিল। সেই অর্থে এই গ্রন্থটি জাতীয় নাটকের মর্যাদা অর্জন করে।



সধবার একাদশী (১৮৬৬)

গ্রন্থকার : দীনবন্ধু মিত্র।

গ্রন্থরূপ : প্রহসন ধর্মী নাটক।

বিষয় : একদল শিক্ষিত, উচ্ছৃঙ্খল পাশ্চাত্য সভ্যতায় শিক্ষিত ইয়ংবেঙ্গলদের চরিত্র এবং তাদের অভব্য, অশালীন আচরণ সধবার একাদশীতে বিশেষ বিশ্বস্ততা সহাকারে চিত্রিত। বিদেশি শিক্ষার দুষ্ট প্রভাবে এসে এরা সুরাপানকে আধুনিক সভ্যতার অঙ্গ বলে জেনেছিল এবং তদানুসঙ্গিক অন্যান্য কুক্রিয়ায় আসক্ত হয়ে একেবারে উচ্ছন্নে যেতে বসেছিল। তাদের মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি ফোটানোই আলোচ্য প্রহসনে দীনবন্ধুর মনোগত অভিপ্রায় প্রহসনটির অবিস্মরণীয় চরিত্র নিমে দত্ত। অটল বিহারীকে গ্রন্থের নায়ক বলে মনে হতে পারে; কিন্তু তার চরিত্রের জঘন্যহীনতা এবং ক্ষুদ্রতা কেবল ঘৃণা ও বিরক্তি উৎপাদন করে। সে নির্দ্বন্দ্ব হয়ে সমস্ত রকমের কুকর্মে রত, কোনও পাপেই তার অরুচি নেই। নিমচাঁদ অটলের ইয়ার হলেও তার প্রবলতর ব্যক্তিত্বের প্রভাব সর্বত্রই অনুভূত হয়। তার সুতীব্র ব্যঙ্গ বিদ্রূপ, প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য সুগভীর অনাসক্ত নির্লিপ্ততা সমস্ত প্রহসনটিকে উজ্জ্বল করে রেখেছে। এটি একটি ট্র্যাজিক চরিত্র। সে আত্মঅনুসন্ধানে নিরত। তার ইয়ার বারাঙ্গনা, বিলাসী অটল বিহারী সর্বনাশা আগুন নিয়ে খেলা করছে। ভোলাচঁাদ, ঘটিরাম ডেপুটি প্রভৃতি চরিত্র সেই ক্লেদাক্ত যুগের এক একটি বিশেষ টাইপ। বলতে গেলে সব চরিত্রই বাস্তবের নিখুঁত প্রতিচ্ছবি। প্রত্যেকটি ঘটনা নাট্যকারের অভিজ্ঞতার জগৎ থেকে গৃহীত।

কেন উল্লেখযোগ্য :

শিক্ষার আলোকপ্রাপ্ত মদ্যপায়ী মাতালের, মায়ের প্রশ্রয়প্রাপ্ত বিপথগামী বকাটে যুবকের, শোচনীয়, দুর্গতিক্লিষ্ট জীবনের এমন রসোজ্জ্বল ট্রাজেডি কোনো বাঙ্গালী লেখকের কলম থেকে নির্গত হয়নি। সংলাপের চমৎকারিত্ব কাহিনিকে সরস ও প্রাণবান করে তুলেছে। আর বাংলা প্রসহনের সংসারে নিমচাঁদ চরিত্রের তুলনা কোথায় ?



নবান্ন (১৯৪৪)

গ্রন্থকার : বিজন ভট্টাচার্য।

গ্রন্থরূপ : গণনাটক ।

বিষয় : নবান্ন নাটকটি সামাজিক কমেডি নাটক। অনেকে আবার একে নক্সাধর্মী নাটক বলে থাকেন। আমিনপুরের কৃষক প্রধান সমাদ্দার এবং পরিবারের প্রায় সকলেই আগষ্ট আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লো। পোদ্দার হারু দত্তের জমির প্রতি লোভ, শহরের আড়ত দারের সৃষ্টি কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ, সমাজজীবনের শোচনীয় বিপর্যয়, প্রচলিত জীবনে মূল্যবোধের পরিবর্তন, পুরাতন জীবনের ভাঙন ও নবজীবনের স্বপ্ন নাটকটির মধ্যে বাস্তব সত্যের আলোকে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। অভাবের সর্বগ্রাসী দাহ ও সমাদ্দারের পরিবারকে কীভাবে মাটির স্নেহময় কোল হতে শহরের পাষাণ পথে টেনে আনলো এবং আমিনপুরের হতভাগ্য কৃষকদের কীভাবে দিশেহারা সর্বনাশের অন্ধকারে নিক্ষেপ করে দিল নাট্যকার তা সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। কলকাতার রাজপথে হঠাৎ প্রধান সমাদ্দারের ভাইপো নিরঞ্জনের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী বিনোদিনীর সাক্ষাৎ, অতঃপর সে বিনোদিনীকে নিয়ে শহরের মোহ ত্যাগ করে গ্রামে ফিরে আসে। সেই সঙ্গে কুঞ্জ ও রাধিকা মাটির টানে ফিরে আসে গ্রামে। নবান্নের উৎসবে প্রধানও হঠাৎ চলে আসে। আবার সকলে মিলে নতুন করে স্বপ্ন দেখে শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে। নতুন জীবনের নবান্নের গান গাওয়ার মধ্য দিয়ে নাটক শেষ হয়েছে।

কেন উল্লেখযোগ্য :

নাটক হিসাবে নবান্নকে উৎকৃষ্টতর রচনা বলা চলে না। তবুও এই নাটকটি কয়েকটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছে। যেমন-

(ক) নাটকের মধ্য দিয়ে সাম্যবাদী মতাদর্শ প্রচারিত হয়েছে।

(খ) এই নাটক থেকে গণনাট্য আন্দোলনের সূত্রপাত হল।

(গ) দেশের যারা সংখ্যা গরিষ্ঠ অংশ তারা সরাসরি এই প্রথম নাটকে আশ্রয় পেল। 

(ঘ) দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ মারফত বাংলার কৃষক প্রথম মঞ্চে এসেছিল। নবান্নের মাধ্যমে কৃষক সমাজের বৃহত্তর অংশের সঙ্গে জনসাধারণকে মুক্ত করে দেওয়ার চেষ্টা প্রথম হল। এই কারণে বাংলা নাট্য সাহিত্যে বিশেষ করে গণনাট্য আন্দোলনে নবান্ন' নাটকের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।