বাংলা সাহিত্যে প্রাবন্ধিক রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর কৃতিত্ব | বাংলা সাহিত্যে প্রাবন্ধিক রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর ভূমিকা

বাংলা সাহিত্যে প্রাবন্ধিক রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর অবদান


বিজ্ঞান সাধনা-দার্শনিকতা সাহিত্য ভাবনার একত্র মিলনে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। সুরেশচন্দ্র সমাজপতি তাঁর মধ্যে 'দর্শনের গঙ্গা বিজ্ঞানের সরস্বতী ও সাহিত্যের যমুনার' ত্রিবেণী সঙ্গম লক্ষ্য করেছিলেন। তাঁর প্রবন্ধ পাঠ করে অপ্রতুল গুপ্ত ভেবেছেন : “বিজ্ঞানের মাটিতে শিকড় গেড়ে দর্শনের আকাশে পাখা মেলেছে এবং সাহিত্যের অমৃতরস এদের অক্ষয় নবীনতা দান করেছে।' তাঁকে দেখে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মনে হয়েছে—“বিদ্যার একটা বড়ো জাহাজ।” আর বর্ষীয়ান বিশ্বকবি তার এই স্নেহামুজকে পঞ্চাশ বৎসর পূর্তি উপলক্ষে অভিবাদন করেছেন এই বলে “তোমার হৃদয় সুন্দর, তোমার বাক্য সুন্দর, তোমার হাস্য সুন্দর, হে রামেন্দ্রসুন্দর, আমি তোমাকে সাদরে অভিবাদন করিতেছি।”


বঙ্কিম যুগেই রামেন্দ্রসুন্দর রচনার সূচনা। সেই কারণে বঙ্কিমের কাছ থেকে যুক্তিবাদীতার পাঠ নিয়ে তার সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন আপন হৃদয়ের সহৃদয়তা এবং পরিশীলিত প্রজ্ঞা। তার প্রবন্ধ রচনার মধ্যে আছে বিষয়ের ব্যাপ্তি ও বিস্তৃতি। বস্তুত বিজ্ঞান-দর্শন ধর্ম-স্বদেশ-সমাজ সংস্কৃতি-শিক্ষা-সাহিত্য-ভাষা-বিজ্ঞান-বৈদিক যজ্ঞকাণ্ড থেকে শুরু করে বাঙালীর ব্রতকথা পর্যন্ত তার ভাবনার বিস্তার, বলাবাহুল্য এই ভাবনাসমূহ পুঁথিগত সমকালের চেতনায় প্রদীপ্ত। তার আবেদন এককথায় নানামুখী। যথা— 


  • (ক) ধর্মনির্ভর দার্শনিকতার বদলে বিজ্ঞান নির্ভর দার্শনিকতার প্রকাশ।

  • (খ) জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিষয় এবং দর্শন-সমৃদ্ধ সত্য স্বরূপকে সরস ভঙ্গিমায় পরিবেশন 

  • (গ) উচ্ছ্বাসহীন জাতীয়তাবোধের প্রকাশ।


আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর গ্রন্থসমূহ :

প্রকৃতি (১৮৯৬), পুণ্ডরীক কুলকীর্তি পঞ্জিকা (১৯০০), জিজ্ঞাসা (১৯০৪), বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা (১৯০৬), মায়াপুরী (১৯১১), ঐতরেয় ব্রাহ্মণ (১৯১১), চরিত কথা (১৯১৩), কর্মকথা (১৯১৩), বিচিত্র প্রসঙ্গ (১৯১৪), নানা কথা (১৯২৪), শব্দকথা (১৯১৭), যজ্ঞকথা (১৯২০), বিচিত্র জগৎ (১৯২০), জগৎকথা (১৯২৬) প্রভৃতি। তাছাড়া নানাকথা, বিচিত্র জগৎ, বা মাসিকপত্রে প্রকাশিত বেশ কিছু বিষয় সমৃদ্ধ প্রবন্ধ একসময় আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।


সমকালের বিজ্ঞান চিন্তাকে সাধারণ বাঙালীর ঘরে পৌঁছে দেওয়ার কাছে রামেন্দ্রসুন্দরের কৃতিত্ব অপরিসীম। ডারউইন প্রমুখ বৈজ্ঞানিকদের বিজ্ঞান আলোচনার ধারা ব্যাখ্যা করে বিজ্ঞানের দার্শনিক প্রত্যয় রূপে তিনি উপস্থিত করেছেন। তার বিজ্ঞান আলোচনায় প্রসাদগুণান্বিত ভাষারীতির কিছু দৃষ্টান্ত দিলে সহজেই অনুমিত হবে – 'রামেন্দ্রসুন্দর বৈজ্ঞানিকের মতো বিশ্লেষণ করেছেন। দার্শনিকের মতো চিন্তা করেছেন ও সাহিত্যিকের মত সরসভাবে প্রকাশ করেছেন।


আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর দৃষ্টান্ত প্রবণতা :

তাঁর স্টাইলের একটি অন্যতম পরিচয় হলো দৃষ্টান্ত প্রবণতা, বক্তব্যকে হৃদ্য ও গ্রাহ্য করা এবং সম্ভাব্যতা দান রার জন্য তিনি দৃষ্টান্তের দিকে ঝুঁকেছেন। এই দৃষ্টান্ত প্রবণতাও আবার বহুমিশ্র ভাবনার ফলশ্রুতি। যথা—


  • প্রাত্যহিক দৃষ্টান্তঃ “লোকালয়ের বাহিরে ও দূরে বৃহৎ জলাশয়ে নানা জাতি ছোট বড়ো মাছ, কাছিম কঁাকড়া ও শামুক গুগলির সহিত পুরুষপরম্পরা ক্রমে ঘর কন্যা করে।” (অতি প্রাকৃতের প্রথম প্রস্তাব) কিংবা “প্রহারের দর্শন শ্রবণ বা কল্পনা ভয়ানক, কিন্তু প্রহার খাইতে তেমন কষ্ট নাই। সকলে পরীক্ষা করিতে সম্মত হইবেন কিনা সন্দেহ।” (সুখ না দুঃখ )

  • হাস্যরস : “যদি কোন প্রকাশ্য বৈজ্ঞানিক আসিয়া হঠাৎ প্রতিপন্ন করিয়া দেন, যে ভূত আছে ও তাহার পা বাঁকা, তাহা হইলে মন যেন হাঁপ ছাড়িয়ে বাঁচে। (অতিপ্রাকৃত প্রস্তাব)

  • নৃতত্বের উল্লেখঃ কত অতিকায় হস্তী, কত ভীমকায় কুম্ভীর, কত বিশাল বিহঙ্গম এককালে ধরা পৃষ্ঠে— নাচিয়া বেড়াইয়াছিল। এখন তাহারা লোপ পাইয়াছে। তাহাদের শিলীভূত কংকাল তাহাদের অস্তিত্বে একমাত্র সাক্ষী হইয়া বর্তমান।” (সমঙ্গলের উৎপত্তি)

  • ইতিহাসের দৃষ্টান্ত : “ইহুদী জাতির বাইবেল নামক প্রামাণিক ইতিবৃত্তের বিবরণ।” কিংবা “তৈমুরলঙ্গ ও চেঙ্গিস খাঁর অবলম্বিত নীতির” ব্যাখ্যা।

  • রামায়ণের উল্লেখ: “রামায়ণ মানব জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সঙ্গীত। তবে বৈরাগ্য অবলম্বন ইহার উপদেশ নহে।”

  • নৈয়ায়িক ভঙ্গিঃ “এক বল, ঈশ্বর সর্বশক্তিমান, তাহা হইলে তিনি দয়াময় নহেন, অথবা বল, তিনি দয়াময়, তাহার হইলে তিনি পূর্ণ শক্তিমান।” ইত্যাদি৷


‘জিজ্ঞাসা’ গ্রন্থভুক্ত ‘অমঙ্গলের উৎপত্তি’ নামক প্রবন্ধটি প্রায় আদ্যন্ত কড়া সুরে বাঁধা। প্রবন্ধের প্রথমেই ভূমিকম্পে মৃত্যু উপলক্ষে মঙ্গলময় ঈশ্বরের বিধানের ব্যাখ্যাতাদের উপলক্ষে লেখক ব্যঙ্গযুক্ত বাক্যে তাদের মনোভাব বিশ্লেষণ করেছেন। যেমন কোন নিরীহ ব্যক্তি— ‘মাথা চ্যাপটা করিয়া দিয়া তাহার অনাসা পত্নীর অন্নের সংস্থান বন্ধ করা হইল কেন?” সংশয়পন্থীর এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তথাকথিত মঙ্গলপন্থী মানুষেরা এইভাবে— “সে ব্যক্তি না হয় নির্দোষ ও নিষ্ফলংক ছিল, কিন্তু তাহার পত্নীর কথা কে জানে? অথবা তাহার দোষ না থাকুক তার বাপের দোষ ছিল, অথবা পিতামহের দোষ ছিল, অথবা এ জন্মে দোষ না থাক, পূর্বজন্মে‌ দোষ ছিল না। তাহাকে বলিল?” তার পরেই ব্যঙ্গ তুঙ্গে উঠেছে— “ব্যাঘ্র মেষ শাবককেও ঠিক এইরূপ বলিয়া ছিল?”


বিপরীত ভাবে, তাঁর ‘বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা’ গ্রন্থটি প্রধানত স্বাদেশিকতার ব্রত দীক্ষায় সমৃদ্ধ স্বদেশপ্রেমের সঙ্গে কবিত্বের ঘনিষ্ঠ সংযোগের ফলে ভাষা হয়ে উঠেছে ভক্তের নমনীত আবেগে পরিপূর্ণঃ “মা লক্ষ্মী কৃপাকর, কাঞ্চন দিয়ে কাঁচ নেব না। শাখা থাকতে চুড়ি পরবো না। ঘরের থাকতে পরের নেব না।' রামেন্দ্রসুন্দরের ‘চরিতকথা' গ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যে মনীষীদের জীবন চিত্রায়ণের এক অমূল্য সংযোজন। এখানে আছে আটজন মনীষীর জীবন চিত্র যথা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, হর্মান হেলমহোল্যজ আচার্য মক্ষমূলর উমেশচন্দ্র বটব্যাল রজনীকান্ত গুপ্ত এবং বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিষয়ের ভাব এখানে ভাষার লাবণ্যে কমনীয় হয়ে উঠেছে। এই গাম্ভীর্য ও কমনীয়তার গুণের জন্যই রামেন্দ্রসুন্দর স্মরণীয়।