আধুনিক বাংলা কাব্য ধারায় জীবনানন্দ দাশের ভূমিকা ও স্থান | আধুনিক বাংলা কাব্য ধারায় জীবনানন্দ দাশের অবদান ও কৃতিত্ব

আধুনিক বাংলা কাব্য ধারায় জীবনানন্দ দাশের ভূমিকা অবদান


“এক বিমুঢ় যুগের বিভ্রান্ত কবি জীবনানন্দ। পৌষের চন্দ্রালোকিত মধ্যরাত্রির প্রকৃতির মতো তাঁর কাব্য কুহেলী কুহকে আচ্ছন্ন। স্বভাবোক্তি অলঙ্কার ও বাক্ প্রয়োগের দেশজ রীতির মিলনে সৃষ্ট তাঁর আপাত সুবোধ্যতার অন্তরালে এক দুর্ত্তেয় রহস্য বিরাজিত। বলতে কি, আধুনিক কবিদের মধ্যে একমাত্র তাঁর কাব্যেই এ যুগের সংশয়ী মানবাত্মার ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত পরিচয় ফুটে উঠেছে।” –এটি মন্তব্য করেছেন ড. দীপ্তি ত্রিপাঠী। জীবনানন্দ সম্বন্ধে তাঁর এ বক্তব্য খাঁটি। কারণ তিনি কবিতা রচনায় রবীন্দ্র আনুগত্য নিয়েও এক স্বাতন্ত্র্যে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিলেন। কখনো সচেতন ভাবে রবীন্দ্র বিরোধিতা তার মধ্যে ছিল না। অথচ নিজস্ব এক কাব্য জগতের বাসিন্দা হয়ে আত্মমগ্ন হতে পেরেছিলেন। তাঁর কবিতা কখনোই দিক হারা ভ্রান্তি হারিয়ে যাবার জন্যে সৃষ্ট হয়নি। তিনি বিরূপ সমালোচনার সম্মুখে পড়েও কখনো তেমন কোন প্রতিবাদী মনোভাব প্রকাশ করেননি। রূঢ় কুশ্রী নিন্দা বাক্যে বার বার তাঁকে ক্ষত বিক্ষত হতে হয়েছে। তবুও তিনি কাব্যের প্রতি ছিলেন নিষ্ঠাবান। হয়তো মাঝে মাঝে মানুষের হৃদয়হীনতার ব্যথা পেয়ে নীরব হয়েছিলেন, কিন্তু কখনোই দিকভ্রান্ত হননি, কবিতাকে তিনি নির্মাণ করেননি। কবিতার হয়ে ওঠাটাই তাঁর কাম্য ছিল।


শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকাতে উচ্চারিত..... "আমার কবিতাকে বা এ কাব্যের কবিকে নির্জন বা নির্জনতম আখ্যা দেওয়া হয়েছে।” এই উক্তি থেকে কবি জীবনানন্দের সজাগ মনোভাব আমরা বুঝি, কিন্তু পাইনা এ ব্যাপারে আমরা তাঁর প্রতিক্রিয়ার কোন স্পষ্ট প্রমাণ। আসলে ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই ধরা পড়ে জনপ্রিয় এবং সিদ্ধকাম কবিমাত্রেই তার সমকালীন ভক্ত বা নিন্দুকের দ্বারা কোন বিশেষ বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত হন। বলাবাহুল্য, কবিদের স্বয়ং মন্তব্য অথবা নীরব সমর্থনই সাধারণ পাঠকমানসে তাঁর সম্বন্ধে 'মিথ' গড়ে ওঠার অবকাশ দেয়। তাই রবীন্দ্রনাথের একমাত্র পরিচয় তিনি উপনিষদের কবি, শেক্সপীয়রের নাটক নিছক ‘সামস্তশ্রেণীর মুখপাত্র সাধারণ ভক্তদের স্তাবকতায় কালিদাস কেবল ‘রতিপণ্ডিত কবি' তেমনি জীবনানন্দ দাশ ‘নির্জনতার কবি’। বস্তুতপক্ষে কাব্যের পেছনে কবির ব্যক্তিগত জীবনের প্রসঙ্গ যদি সামান্য ভাবেও জানা যায়। নিজস্ব ধারণার সমর্থনে যদি খানিক তথ্য যোগাড় করা যায় তবে সমালোচক পাঠকের তখন লক্ষ্য হয়ে ওঠে সেই বৈশিষ্ট্যের আলোকে কবির কাব্যকে বিচার করা। তবে কবি জীবনানন্দের পক্ষে তা কতদূর যুক্তিযুক্ত বিচার্যের বিষয়।


জীবনানন্দ দাশের প্রথম কাব্য 'করাপালখে' তাঁর নিজস্ব সুবকে ধরা না গেলেও পরবর্তী কাব্যগুলিতে বেশ সুস্পষ্ট রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। 'ধূসর পাণ্ডুলিপি' (১৯৩৬), বনলতা সেন (১৯৪২), ‘মহাপৃথিবী' (১৯৪৪), 'সাতটি তারার তিমির' (১৯৪৮), 'রূপসী বাংলা’ (১৯৫১)। এই সকল কাব্যে তাঁর মনের স্বরূপ ও বাক্রীতির অভিনবত্ব ফুটে উঠেছে। তবে তাঁর কাব্য বিশ্লেষণে যে নির্জনতার অনুভব জেগে ওঠে তা কয়েকটি বিশিষ্ট চেতনার দ্বারা অনুপ্রাণীত। যথা— ১। স্বপ্নের প্রসঙ্গ ও বিচ্ছিন্নতাবোধ ২। মৃত্যু চেতনা ৩। প্রকৃতি প্রসঙ্গ, ৪। চিত্রকল্প সন্নিবেশে ইত্যাদি।


প্রথমত, ঘুম ও স্বপ্নের প্রসঙ্গ জীবনানন্দের কবিতায় বারবার এসেছে একথা তার প্রথম কবিতা পাঠকের কাছেই প্রায় ধরা পড়ে। স্বপ্নের হাতে ধরা দিতে চেয়ে কবি জানান—“এখানে চকিত হতে হবে নাকো ত্রস্ত হয়ে পড়িবার নাহিকো সময়।" কারণ উজ্জ্বল আলোর দিন নিভে যায়। মানুষের আয়ু শেষ হয়, পৃথিবীর পুরানো পথের রেখা মুছে যায়। এমনকি নক্ষত্রের আয়ুও শেষ হয়, অথচ এই স্বপ্নের জগৎ চিরদিন রয় কাজেই চিরায়ত এই স্বপ্নের জগতে নির্জনতার অখণ্ড অবকাশে বর্তমানের আঘাতে আহত রক্তাক্ত সুবেশী মানুষ স্বভাবতই ভাববে— “এখানে পালঙ্কে শুয়ে কাটবে অনেক দিন জেগে থেকে / ঘুমাবার সাধ ভালোবেসে।” শুধু তাই নয়, কবির আত্মসমর্পণ যেখানে, সেখানে “সুচেতনা তুমি এক দূরতর দ্বীপ / বিকেলের নক্ষত্রের কাছে।” এই স্বপ্নের হাতে ধরা দিতে না পারার যন্ত্রণায় বস্তু জগতের সঙ্গে আত্মজগতের দ্বন্দ্বে ক্ষত বিক্ষত হয়েছে, ‘বোধ’ কবিতার স্বগত নায়ক। প্রেম ছিল, আশা ছিল বঁধূ ছিল, শিশু ছিল তবু— “উটের গ্রীবার মতো কোন এক নিস্তব্ধতা।” দেখে আত্মহত্যা করেছে ‘আটবছর আগের একদিন’ এর সেই বিচ্ছিন্ন ক্লান্ত মানুষটি।


কবি বা শিল্পী সাধারণত জীবনের কথা বলেন, জীবনের উপলব্ধিতে কবিতার মধ্যে কবি গভীর এক মগ্ন চৈতন্যে নিমজ্জিত হতে চান। শিল্প তো বাঁচার স্বপ্নকেই সফল করে তোলার সাধনা, কিন্তু তবুও আমরা দেখতে পাই জীবন জন্ম-মৃত্যুর সীমা দিয়ে ঘেরা। জন্ম থেকেই জীবনের যাত্রা শুরু; আর মৃত্যুর প্রশান্তির মধ্যে তার সমাপ্তি মধ্যেকার এই সময়টুকুতেই চলে কবির আত্মান্বেষণ। আর সে কারণেই জন্ম রহস্যের মধ্যেও কবি খোঁজেন আপন অস্তিত্ব। মৃত্যুর মধ্যেও কবি খুঁজে পেতে চান মানব জীবনের সার্থকতা। বিশ্ব কবি এই মৃত্যুকে এড়িয়ে বেঁচে থাকার বাসনায় জীবনের জয়গান গাইলেও জীবনানন্দ দাশ অকপটেই বলেছেন :

মৃত্যুরে বন্ধুর মত ডেকেছিতোপ্রিয়ার মতন! চকিত শিশুর মত তার কোনো লুকায়েছি মুখ,


কিংবা, মৃত্যুর শান্তির স্বাদ এইখানে দিতেছে জীবন-জীবনেরে এইখানে একবার দেখি ভালোবেসে। ইত্যাদি ভাবধারা তাঁর মধ্যে পরিলক্ষিত হয়।


নির্জনতার নিরবচ্ছিন্ন অবকাশ গড়ে তুলতে প্রকৃতির প্রশ্রয় সব চাইতে বেশি করে অনুভূত হয়। মাঠের গল্প, অবসরের গল্প, ঘাস, হায় চিল প্রভৃতি কবিতায় প্রকৃতির প্রসঙ্গ বর্তমান, যখন কবি গেয়ে ওঠেন—“বাসমতী চালে ভেজা সাদা হাতখানা রাখো বুকে। হে কিশোরী গোরোচনা রূপে আমি করিব যে স্পন্ধন।” তখন মনে হয় এই নগর জীবনের কোলাহলে নিপীড়িত ক্লান্ত কবি এই স্নিগ্ধ হাতে যেন শুশ্রূষাই খুঁজেছেন। বর্ণ বিন্যাসের অভিনবত্বে রূপসী বাংলা কাব্যের পৃষ্ঠা রীতি মতো আরো রঙিন, শালিখের খয়েরী ডানা, খই রাঙা হাঁস, তমালের নীল ছায়া, লাল লাল বট ফল, হলুদ বাদামী পাতা, শ্যাওলার মলিন সবুজ, পুকুরের লাল সর, সবুজ বাঁশের বন, রূপালী মাছের কন্ঠ ইত্যাদি স্বল্প পরিচিত কল্প রঙে রূপসী বাংলার সমাপ্ত প্রসাধন, বিশ্ব প্রকৃতির যৌবনপুঞ্জে অবনমিতা ধরা বধুর রূপছবি, কবির স্বীকারোক্তিতেও সেই সত্যের সুর বেড়ে উঠেছে : “বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।”


চিত্রকল্পের অভিনব সন্নিবেশে, উপমার নিত্য প্রয়োগে জীবনানন্দ অদ্বিতীয়, ইতিহাসের পট ও ভূগোলের ভূমিতে তাঁর কবিতার ভূমিকা রচিত। তবু সেই মানচিত্র প্রধানত কবি ও তার পাঠকের মানস চিত্রের সীমানা সমন্বিত। স্বভাবতই গ্রীক হিন্দু ফিনিশীয় সভ্যতার ধ্বংসস্তুপ পার হয়ে বিম্বিসার অশোকের কীর্তি অকীর্তির ধূসর পাণ্ডুলিপিতে বদ্ধ সেই পথ নির্জনকামী মানুষের কাম্য হতে পারে না। বরং তার হাঁটার পথ সেখান দিয়ে যেখানে” নির্জন খড়ের মাঠ পৌষ সন্ধ্যায়, দেখেছি মাঠের পারে নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল কুয়াশারে, যেখানে সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতোন সন্ধ্যা আসে, যেখানে 'ডানার রৌদ্রে গন্ধ মুছে ফেলে ছিল।” তারপর ‘পাখীর নীড়ের মতো চোখ নিয়ে দেখা দেয় বনলতা সেন। সেই আত্মবৃত্ত শাস্ত চিত্তে ‘নির্জনতা’ ছাড়া আর কি কাম্য হতে পারে? আধুনিক বাংলা কাব্যের আকাশে জীবনানন্দ তাই আজও এক অদ্বিতীয় নির্জন নক্ষত্র।


লোকভীরু জীবনানন্দ সর্বদা একটা আপনভোলা কবিত্বের নির্জনতায় বাস করতেন, একাকীত্বের দুর্গম নভশ্চর জীবনানন্দ কাছের মানুষের কাছে পরম বিস্ময়, দূরের মানুষের কাছে আত্মার আত্মীয়। পরাবাস্তবতা ও অস্তিত্ববাদের নিরিখে পণ্ডিত গবেষক জীবনান্দকে বিশ্লেষণ করতে পারেন, কিন্তু স্বয়ং কবি কোন ‘বাদ’ নিয়ে বাদ-প্রতিবাদ করেন নি। সমস্ত সত্তা দিয়ে সমগ্র চেতনা দিয়ে তিনি বিশ্ব বোধ ও ব্যক্তিবোধের সমন্বয় খুঁজেছেন, কখনো আত্মার গভীরে হারিয়ে গেছেন, কখনো দূর দেশকালের স্মৃতি বিস্মৃতির মধ্যে পথ চলেছেন, জীবনানন্দকে তাই চির পার্থিব বলেই মনে হয়। পথ চলাতেই তাঁর আনন্দ। সমস্ত বিশ্বে রূপ মাধুরীকে বিচিত্র প্রতীকের মারফতে উপলব্ধি করেন কখনো তিনি। 'রূপদক্ষ' হয়েছেন, কখনো ধ্বনিব্যঞ্জনার মধ্য দিয়ে রূপলোকের আভাস ইঙ্গিতের সাহায্যে এমন এক অধরার সন্ধান পেয়েছেন, যা বাক্য মনের অগোচর, এর মধ্যেই কবির অনন্যতা নিহিত।