বাংলা সাহিত্যে প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরীর কৃতিত্ব | বাংলা সাহিত্যে প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরীর অবদান

বাংলা সাহিত্যে প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরীর ভূমিকা


আধুনিক বাংলা সাহিত্যের আকাশে প্রমথ চৌধুরী এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্করূপে দেদীপ্যমান। তাঁর রচনা শাণিত স্বাতন্ত্র্যের সমুজ্জ্বল। বিংশ শতাব্দীর নাগরিকতার ভাষ্যকার এই প্রাবন্ধিক ‘বীরবল’, ছদ্মনামে প্রসিদ্ধ। তাঁর সাহিত্য বীরবলী সাহিত্য এবং তার স্টাইল ‘বীরবলী স্টাইল’ নামেও সুপরিচিত। প্রকৃতপক্ষে এইদিক থেকে সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী ‘বাঙালী জাতির বিদূষক হিসাবেও খ্যাতিমান। এ সম্পর্কে তিনি স্বয়ং মন্তব্য করেছেন : “আমি যখন দেশের লেখাকে রসিকতাচ্ছলে কতকগুলি সত্যকথা শোনাতে মনস্থ করি তখন আমি না ভেবে চিন্তে বীরবলের নাম অবলম্বন করলুম।”


কিন্তু শুধুমাত্র বীরবলের ছদ্মনামের আড়ালে হাস্য পরিহাসে নয় ‘সবুজপত্র’ পত্রিকার সম্পাদক চলিত ভাষার প্রচারক। সনেটকার ছোটগল্পকার প্রাবন্ধিক ইত্যাদি বিভিন্ন ভূমিকায় প্রমথ চৌধুরীর কৃতিত্ব দেখা যায়। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ও সাহিত্য জীবনের অনন্যতায় মুগ্ধ হয়ে সমালোচক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন : “সব্যসাচী প্রমথ চৌধুরী ‘সবুজপত্র’ তার গাণ্ডীব, আর সবুজ সভার সভ্য বা পাণ্ডব সেনার দল। রূপের চেয়ে রূপকে, রূপের চেয়ে রুচিকে, রুচির চেয়ে ঋদ্ধিকে বড়ো মনে করতেন তিনি। তাঁর সাহিত্য প্রতিভায় নব্যতা ছিলো —ছিল অনন্যতা।” বাস্তবিক তাঁর মননের মধ্যে যেমন ছিল ফরাসী মেজাজ তেমনি তাঁর মন ছিল ভারতীয় রসবোধে সঞ্জীবিত আর সবার উপরে ছিল উচ্চচূড় ইনটেলেকট-এর দীপ্তি, কলাকৈরল্যবাদী প্রত্যয়ের সঙ্গে কলাকারের নিখুঁত প্রকাশভঙ্গী বহুশ্রুতি ভাবের সঙ্গে ভাষার চাবুক। তিনি মননশীল হয়েও জীবন রসিক। অর্থাৎ তার দৃষ্টি ছিল Science-এ, তাঁর নীত The proper Study of mankind is man".


প্রমথ চৌধুরীর রচনাসমূহঃ

প্রমথ চৌধুরীর গদ্য গ্রন্থগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য—তেল-নুন-লকড়ী (১৯০৬), বীরবলের হালখাতা (১৯১৭), নানাকথা (১৯১৯), নানা চর্চা (১৯৩২) প্রভৃতি।


প্রমথ চৌধুরীর প্রবন্ধের বৈশিষ্ট্য:

দর্শন রাজনীতি সংস্কৃতি ইতিহাস ভাষা ও সাহিত্য প্রভৃতি বিবিধ বিষয়ে তাঁর অবাধ বিচরণ ও পাণ্ডিত্য যেমন দেখা যায়, তেমনি আছে উপযুক্ত ভাষায় তাকে প্রকাশের চাতুর্য। তাঁর প্রবন্ধগুলির প্রধান বৈশিষ্ট্য : (ক) প্রগতিশীল যুক্তিবাদিতা, (খ) মনন প্রধান চিন্তা ভাবনা, গ) তির্যক বাচনভঙ্গী অলংকারের বাকৃবিন্যাস ঘ) নাগরিক বৈগদ্ধ্য।


সবুজপত্র (১৯১৪) সম্পাদনার পূর্বে ভারতী (১৯০২) পত্রিকার মাসিক লেখায় বীরবল নামে প্রমথ চৌধুরী চলিত ভাষার সপক্ষে লিখতে শুরু করেন। তির্যক ব্যঙ্গে তিনি বলেন ঃ “ভাষা মানুষের মুখ হতে কলমের মুখ আসে, কলমের মুখ হতে মানুষের মুখে নয়। উল্টোটা চেষ্টা করতে গেলে মুখে শুধু কালি পড়ে।” রবীন্দ্রনাথ একদা প্রমথ চৌধুরীর কবিতাকে বলেছিলেন ইস্পাতের ছুরি। তাঁর গদ্যের মধ্যেও আছে সেই শাণিত দীপ্তি। প্রমথ চৌধুরীই বাংলা ভাষায় প্রথম প্রবন্ধ লিখিয়ে যিনি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রেরণায় কিংবা দেশাস্তবোধের আবেগে কলম ধরেননি। তাঁর ভাষায় : “আমি রূপায়িত করি শুধু নিজেকে, আমার রচনার বিষয় আমি নিজে।” করুণ আবেগে আর্দ্র বাংলাদেশের জলীয় পরিবেশে তিনিই প্রথম সুস্থ শুষ্ক সতেজ মনের ভাবনা প্রকাশ করেন। তার ভাবনা ও রচনার বিস্তার বহু বিষয়স্পর্শী, কিন্তু তার সমধিক কৃতিত্ব বাচন রূপায়ণে, একথা হয়তো সত্য, যে তার বাচন বৈশিষ্ট্য অনেক সময় তাঁর মনন বা সিদ্ধান্তের উপরে স্থান নিয়েছে। তবু তাঁর মনোহারিত্ব অনস্বীকার্য।


প্রমথ চৌধুরীর প্রবন্ধের ভাষারীতি বা স্টাইল:

তাঁর লেখনী রীতি ছিল এক বিশেষ ধরনের যা বাংলা গদ্যের আঙিনায় ছিল অভূতপূর্ব। কিছু দৃষ্টান্তের দ্বারা তা প্রমাণ করা যেতে পারে। যথা—“মত্র সাপকে মুগ্ধ করিতে পারে কিনা জানিনে, কিন্তু মানুষকে যে পারে তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ গোটা ভারতবর্ষ।” কিংবা, “জ্ঞানের ভাণ্ডার যে ধনের ভাণ্ডার নয়, এ সত্য তো প্রত্যক্ষ কিন্তু সমান প্রত্যক্ষ না হলেও এও সমান সত্য যে, এ যুগে যে জাতির জ্ঞানের ভাণ্ডার শূন্য নয়, সে জাতির ধনের ভাঁড়েও ভবানী।” কখনো বা ফরাসী বাগ্‌ভঙ্গির অনুসরণে লেখা হয়—“কিন্তু সমালোচকেরা চক্ষের জলে বক্ষ ভাসিয়ে দিলেও বঙ্গ সরস্বতীর আর গোবিন্দ অধিকারীর অধিকারভুক্ত হবেন না এবং দাশরথিকেও সারথি করিবেন না।” অর্থাৎ প্রমথ চৌধুরীর অধিকাংশ প্রবন্ধের বক্তব্যই বিতর্কমূলক হয় প্রাচীন না হয় নবীন, প্রচলিত অথবা প্রচারিত মতকে পরীক্ষা করে প্রায় তার উচ্ছেদ করাই এর লক্ষ্য। এই পরীক্ষায় আছে যুক্তি ও তর্কের বিচার, দেশী ও বিদেশী তথ্য ও তত্ত্বের বহু আলোচনা। তবে বক্তব্য বিষয় নয়—“যা প্রথম থেকে পাঠকের মনকে সজাগ ও মুগ্ধ রাখে সে হচ্ছে বিচার ও আলোচনার প্রকাশের ভঙ্গি।” (অতুলচন্দ্র গুপ্ত)


একথা অনস্বীকার্য, বাংলা গদ্যের চলিত রীতিকে প্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলনে প্রমথ চৌধুরী তাঁর সম্পাদিত ‘সবুজপত্র’ এর ভূমিকা ছিল সর্বাগ্রে। কিন্তু কেবল নেতৃত্বদানের জন্যই নয়। এক স্বতন্ত্র ভাষা রীতির স্রষ্টারূপেও চৌধুরী মশাই-এর অবদান ছিল অসামান্য। তাঁর ভাষারীতির মধ্যে আছে আলংকারিতা ও উপমা ব্যবহারের অভিনবত্ব, স্পষ্টতা ও সত্যবাদীতা, ব্যঙ্গধর্মী বুদ্ধিদীপ্ত মানসিকতা, ঋতুতা ও শাণিত বাক্‌ভঙ্গি। wit-এর ব্যবহারে তাঁর ভাষার রীতির মধ্যে যেমন একদিকে এসেছে ইস্পাতী উজ্জ্বলতা, অন্যদিকে উপেক্ষিত সত্যের মূর্তি বলার গুণে বিমুখ পাঠকের কাছেও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। স্বভাবতই তার প্রবন্ধ পড়ে পাঠকের মনে হয়—“কথা বলাকে এখানে তিনি কথা কানায় পরিণত করেছেন।”