'ঈশ্বরগুপ্তকে যুগ সন্ধির কবি বলা যায়।'—উক্তিটির যৌক্তিকতা | ঈশ্বরগুপ্তকে বাংলাকাব্যে মধ্যযুগের শেষ কবি এবং নবযুগের প্রথম কবি— ঈশ্বরগুপ্তের কবি কৃতির পরিচয় দান

বাংলা সাহিত্যে ঈশ্বরগুপ্তের অবদান ও কৃতিত্ব


সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র তাঁরই সাহিত্য গুরু ঈশ্বরচন্দ্রগুপ্ত সম্পর্কে বলেছিলেন— 'সেকাল আর একালের সন্ধিস্থলে ঈশ্বরগুপ্তের প্রাদুর্ভাব।' সত্য কথা, একটি কালের ভাবের স্রোত যখন ধীরে ধীরে মন্দীভূত হয়ে আসে তখন অপর দিক থেকে একটা ভিন্নতর ভাবের জোয়ার বইতে থাকে। যে কোন কবি বা ব্যক্তির উভয়ের একটি সন্ধিস্থলে দাঁড়িয়ে আপন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা বড়ো কঠিন। কারণ, তার পক্ষে যেমন পুরাতনকে একেবারে বিদায় দেওয়া দুসাধ্য তেমনি নৃতনকে অবলম্বন করে ভবিষ্যতে পাড়ি দেওয়া একেবারেই কষ্টকর। ঈশ্বরগুপ্ত সেই দ্বৈরথ সমরে উপনীত হয়েছিলেন। আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা দীক্ষা সম্বন্ধে তাঁর প্রত্যক্ষ ধারণা না থাকলেও আপন অভিজ্ঞতাকে উপজীব্য করে এগিয়ে গিয়েছিলেন। নিরুৎসুক হয়ে থেমে থাকার পাত্র তিনি ছিলেন না। তার সৃষ্ট কাব্য কলা পদ্য ও ছড়ায় রচিত হলেও উনিশ শতকের সাহিত্য থেকে তাকে কোন মতেই বাদ দেওয়া যায় না। ইতিহাসের প্রয়োজনেই তা আলোচিত হওয়া দরকার। সমস্ত শিল্পকারখানার শেষ আদালত নান্দনিক বিচারশালা হলেও দেশকাল-পাত্রকে উপেক্ষা করে কোন সাহিত্য ও শিল্প অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারে না। সেই দিকে লক্ষ্য রেখে ঈশ্বরগুপ্ত আলোচনার যোগ্য।


ঈশ্বরগুপ্তের জীবনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় যদি নিতে যাই, তাহলে দেখবো ভাগ্য দেবী জন্মলগ্নেই তাঁর কপালে দুঃখ দারিদ্র্যের টিকা পরিয়ে সংসারে পাঠিয়েছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায় বলতে হয়—‘ঈশ্বরগুপ্তের ভাগ্য তাঁর স্বহস্ত গঠিত।' কলকাতার উত্তরে কাঁচড়াপাড়া গ্রামে ১৮১২ খ্রীঃ সাধারণ অবস্থার বৈদ্য পরিবারে তাঁর জন্ম। তার দশ বৎসর বয়সে মাতৃবিয়োগ হওয়ায় বাবা দ্বিতীয়বার দ্বার পরিগ্রহ করলে এই রকম ক্রুদ্ধ হয়েই কলকাতার জোড়াসাঁকোয় মাতামহের বাড়ীতে চলে আসেন। এ সমস্ত কারণে শৈশবে তাঁর উপযুক্ত বিদ্যাভ্যাস হয়নি। তিনি কোন পাঠশালা বা স্কুলে পড়েননি, জীবনের পাঠশালাই তাঁকে শিক্ষা দিয়ে বড়ো করে তুলেছিল। আপন তীক্ষ্ণ বুদ্ধির জোরেই বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে শুনে শুনেই ঙ্গভাষা ও কিছু কিছু ইংরাজী শব্দ রপ্ত করেছিলেন। যাইহোক তার জীবনের সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হল দাম্পত্য জীবনের ব্যর্থতা। এক জড়বুদ্ধি সম্পন্ন বালিকার সঙ্গে দাম্পত্য বন্ধনে আবদ্ধ হলেও দাম্পত্য জীবনযাপন অগ্রসর হতে পারেননি। বিবাহের পর তিনি কোন দিনই স্ত্রীর সঙ্গে বসবাস করেননি জীবনের এই বিষাদগ্রস্ততা পরবর্তী কালে কৌতুকের রূপ নিয়ে তাঁর লেখনীর মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছিল।


পাথুরিয়া ঘাটার ঠাকুর বাড়ীতে অবস্থানের ফলে উচ্চ সমাজে তাঁর বিশেষ পরিচিত বেড়েছিল। কোন এক বান্ধব তাঁর প্রতিভাগুণে মুগ্ধ হয়ে শ্রুতিধর বলে আখ্যাত করেছিলেন। তিনি সর্বদা স্বভাব সিদ্ধ রসিকতা ও রচনা শক্তির গুণে একদিকে যেমন কবিয়াল ও পাঁচালির দলে ভার বেঁধে দিয়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তেমনি সমসাময়িক ঘটনা নিয়ে ব্যক্ত কৌতুকপূর্ণ ছড়া ও পদ্য লিখে অভিজাত সমাজে সমাদৃত হয়েছিলেন। নন্দকুমার ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র যোগেন্দ্র মোহন ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর বিশেষ অন্তরঙ্গতা বাড়ে। এরই ফলে ঈশ্বরগুপ্তের খ্যাতি ও প্রতিপত্তির দুয়ার খুলে গেল। উনিশ শতকের দু' তিন দশকে সাময়িক পত্রিকা প্রকাশের হুজুগ শুরু হলে যোগেন্দ্রমোহন ঈশ্বরগুপ্তকে সম্পাদক করে সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করলেন সংবাদ প্রভাকর। পরে সংবাদ প্রভাকর দৈনিকরূপে প্রকাশিত হয়ে দীর্ঘদিন ছিল। বস্তুত এটিই বাংলা ভাষার প্রথম দৈনিক পত্র। তাছাড়া তিনি আরো কয়েকখানি পত্রিকা সম্পাদনা করেন, যথা—সংবাদ রত্নাবলী, পাষণ্ডপীড়ন, সংবাদ সাধুরঞ্জা। তাঁর এই পত্রিকা সম্পাদনার ফলে কবিয়ালদের সম্পর্ক পরিচয় পাই। নইলে বোধ হয় তারা এত দিনে কোন বিস্তৃতির অতল তলে হারিয়ে যেত।


সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে তিনি যেমন খ্যাতির শীর্ষদেশে আরোহণ করেছিলেন। তেমনি কবিজীবনী সংগ্রহ গদ্য গ্রন্থ রচনা, কবিতা ছড়া রচনা করে সাহিত্যের ইতিহাসে আপন স্থান নির্দিষ্ট করে গিয়েছিলেন।


ঈশ্বরগুপ্তের রচনাসমূহ :


ক) রাম প্রসাদের কালী কীর্তন (১৮৩৩) : বাংলার মধ্যযুগীয় কবি রামপ্রসাদ সেন সম্পর্কে ঈশ্বরগুপ্তের বিশেষ আকর্ষণ ছিল, তাই মাত্র একুশ বৎসর বয়সে রাম প্রসাদের জীবনী সহ ‘কালী কীর্তন’ প্রকাশ করেন। এ গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি বলেছেন—“আমি আকর স্থান হইতে মূল পুস্তক আনয়ন পূর্বক সংশোধিত করিয়া কালীকীর্তন পুস্তক মুদ্রিতকরণে প্রবৃত্ত হইয়াছি।” এ থেকে বোঝা যায় মূল গ্রন্থটি তার হাতে পড়েছিল এবং তার ছন্দ ও ভাষার ত্রুটি সংশোধন করেছিলেন।


খ) কবিবর ভারত চন্দ্র রায়গুণাকরের জীবন বৃত্তান্ত (১৮৫৫) : এ পুস্তকের ভূমিকায় ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছিলেন—“ইহার পূর্বে কোন মহাশয় এতদ্দেশীয় কোন কবির জীবনচরিত প্রকাশ করেন নাই।” হ্যা, ভারতচন্দ্রের প্রথম জীবনচরিত হিসাবে এ গ্রন্থ বিশেষ ভাবে সমাদৃত ভারতচন্দ্রের পৌত্র ও অনুরাগী প্রাচীন ব্যক্তিদের কাছ থেকে যে তথ্য উদ্ধার করে তিনি এ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন আমরা এখনও তাই নিয়ে নাড়াচাড়া করছি।


গ) প্রবোধ প্রভাকর-১ম খণ্ড (১৮৫৭) : কালীধামের বিখ্যাত পণ্ডিত ও বর্ধমান রাজের সভাপণ্ডিত পদ্মলোচন ন্যায় রত্নের উপদেশ ক্রমে পয়ার, ত্রিপদীতে এই গ্রন্থটি রচনা করেন এটি মূলত তত্ত্বকথায় শুরু এবং তত্ত্বকথায় শেষ হয়েছে।


ঘ) হিত প্রভাকর (১৮৬১) : হিতোপদেশ অবলম্বনে রচিত এই কাব্যটি মূলত স্কুলপাঠ্য পুস্তিকা হিসাবে প্রকাশিত হয়েছিল। ছোট্ট ছোট্ট উপদেশমূলক গল্পকে ঈশ্বরগুপ্ত পদ্যাকারে লিখে জনসমক্ষে হাজির করেছিলেন।


ঙ) বোধেন্দু বিকাশ (১৮৬৩) : একাদশ শতাব্দীর সংস্কৃত নাট্যকার কৃষ্ণমিশ্রের অধ্যাত্ম নাটক ‘প্রবোধ চন্দ্রোদয়' অবলম্বনে অনেকটা স্বাতন্ত্র্যধর্মী রূপকধর্মী বিস্তৃত গদ্য পদ্য রচনা সংযোজিত করে ঈশ্বরগুপ্ত তাঁর ‘বোধেন্দু বিকাশ পুস্তকখানি রচনা করেন। তবে এটি সম্পূর্ণ নাটক হয়ে ওঠেনি।


চ) তার মৃত্যুর বহু বছর পর ১৩১৯ বঙ্গাব্দে 'সত্য নারায়ণের ব্রতকথা' নামে যে পুস্তিকা হুগলী কলেজের অধ্যাপক সতীশচন্দ্রদের নিকট ছিল পরে তা প্রকাশিত হলে অতি নিম্নমানের রচনা বলেই জনসমক্ষে ততটা প্রচারধর্মী হয়ে ওঠে নি।


ঈশ্বরগুপ্তের ছড়া পদ্য কবিতা :

সেকালের বঙ্কিমচন্দ্র থেকে শুরু করে একালের বিষ্ণু দে পর্যন্ত ঈশ্বরগুপ্তের পদ্য রচনার বিশেষ প্রশংসা করেছেন। কেউ কেউ তাকে ‘মহাকবি’, আখ্যা দিয়েছেন। তাঁর ভাঁড়ামি সহ্য করতে না পেরে কেউ তাকে রক্ষণশীল দলের প্রতিভূ ও কবিয়ালা শ্রেণী দূষিত রুচির কবি বলেছেন। আবার কেউ তাঁর মধ্যে নূতন ও পুরাতনের সংমিশ্রণ লক্ষ্য করেছেন। আবার কেউ বা তার রচনায় আধুনিকতাও প্রগতির পদধ্বনি শুনতে পেয়েছেন। সব মিলিয়ে তিনি যে অনন্য প্রতিভার অধিকারী ছিলেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে তার মধ্যে বাক্ বিন্যাসের দেশজ রীতি এবং বস্তুনির্ভর সাধারণ সুস্থ বুদ্ধির সরসতা লক্ষ্য করে বোধ হয় বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন— "মধুসুদন, হেমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ শিক্ষিত বাঙালীর কবি—ঈশ্বরচন্দ্রগুপ্ত বাঙ্গালার কবি।"


ঈশ্বরগুপ্ত অজস্র কবিতা লিখেছিলেন, কেউ কেউ মনে করেন তিনি নাকি পঞ্চাশ হাজার ছত্র কবিতা রচনা করেছিলেন। কথাটা অত্যুক্তি হলেও কবিতা রচনায় 'অবিশ্বাস্য প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। পয়ার ত্রিপদী ছন্দই ছিল তাঁর মূল বাহন। শ্বাসাঘাত প্রধান ছন্দে তার বিশেষ অধিকার ছিল। গ্রাম্য ছড়ার ঢঙে তিনি অনেক ছড়া ফেঁদেছেন। তিনি কবিতা রচনায় কিরূপ সিদ্ধ হস্ত ছিলেন তার কয়েকটি কবিতার ছত্র নিয়ে পর্যালোচনা করলে প্রমাণ পাওয়া যায় আধুনিকা স্ত্রী সম্পর্কে বলেন- 

“বিবিজান চলে যান লবেজান করে।” 

ইংরাজ মহিলা সম্পর্কে কটুক্তি করেন—

“বিড়ালাক্ষী বিধুমুখী মুখে গন্ধ ছুটে। 

আহা তায় রোজ রোজ কত রোজ ফুটে।।”

দুর্দশাগ্রস্ত জন্মভূমি সম্পর্কে বক্তব্য—

"এত ভঙ্গ বঙ্গদেশে তবু রঙ্গে ভরা।”

দাম্পত্য কলহ সম্পর্কে বলেন—

“শয্যার ভার্বার প্রায় ছারপোকা উঠে গায়।”

আপন পরিচয় দানে শব্দালঙ্কারের আশ্রয় নিয়ে বলেছেন—

“কেবলে ঈশ্বরগুপ্ত ব্যাপ্ত চরাচর। 

যাহার প্রভায় প্রভা পায় প্রভাকর।”

এসব পংক্তিগুলি একটিবার পাঠ করলে আর কখনো ভোলার নয়।


তাছাড়া ঈশ্বরগুপ্তের আধুনিক মনোভাবের পরিচয় ও প্রতিভা শক্তি জানতে হলে তাঁর সম্পাদিত সাপ্তাহিক, মাসিক, দৈনিক সংস্করণের ‘সংবাদ প্রভাকরের’ মন্তব্য ও অন্যান্য সংবাদগুলি বিশ্লেষণ করলেই তার যুগোপযোগী আধুনিক মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যাবে। তবে মূলত তার মধ্যে একটা ভাব দ্বন্দ্বের লক্ষণ লক্ষ্য করা যায়। তত্ত্ববোধিনী সভা দেবেন্দ্রনাথের সান্নিধ্য এবং অন্যান্য প্রগতিমূলক সংস্কারের সঙ্গে যুক্ত থেকেও তিনি কোন কোন ক্ষেত্রে নিম্নরুচির পরিচয় দিয়েছেন। কবিয়ালাদের দোসর স্থানীয় ঈশ্বরগুপ্তের রসিকতায় কবিয়ালাদের স্থূল রুচির অবাধ মিশ্রণ ঘটেছে। স্ত্রী শিক্ষার পক্ষপাতী হয়েও বেথুন, বিদ্যাসাগরের স্ত্রী শিক্ষাকে সমর্থন না করেই বলেন—

“আগে মেয়েগুলো ছিল ভালো ব্রতধর্ম করতো সবে। 

একা বেথুন এসে শেষ করেছে আর কি তাদের তেমন পাবে।

যত চুড়িগুলো তুড়ি মেরে কেতাব হাতে নিচ্ছে যবে। 

তখন এ বি শিখে বিবিশিখে বিলাতী বোল করেই কবে।”


কিন্তু বেথুন সাহেবের অনুরোধে ওই বিদ্যালয়ের বালিকাদের জন্য পাঠ্য পুস্তক লিখতে স্বীকৃত হয়েছিলেন। কবি, কবিয়াল, সাংবাদিক ও প্রাচীনপন্থী হয়েও নবযুগের সমর্থক এক ঈশ্বরগুপ্তের দুই রূপ। এই জন্য বঙ্কিমচন্দ্র তাঁকে যুগসন্ধিক্ষণের কবি বলেছেন।


এই প্রসঙ্গে বলতে হয়। বঙ্গকৌতুক, ব্যঙ্গ বিদ্রুপ ও হাস্যরস সাহিত্যকে দীর্ঘজীবন দিতে পারে না। তাই বোধ হয় তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে জনচিত্ত থেকে তার রচনা ক্রমেই অপসারিত হতে শুরু করেছিল কিন্তু শেক্সপীয়র বহু শতাব্দীর বেষ্টন বিদীর্ণ করে দেহকালাতীত মানব চেতনায় যে অমরত্ব লাভ করেছে মূলত তাঁর কালজয়ী রচনার গুণে। ঈশ্বরগুপ্তের পরিণাম কিন্তু বিষাদজনক৷ প্রভাতে শাখাচ্যুত সন্ধ্যামালতীকে কে যত্ন করে তুলে রাখে? তাইতো তিনি আজ বিস্তৃত প্রায়। তবে তিনি যে নূতনের সূচনা করেছিলেন পুরো স্বরূপটা ধরতে পারেননি। আর একটা দীর্ঘজীবী হলে হয়তো মধুসুদনের মত বঙ্গ সাহিত্যে একটা বৈপ্লবিক আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারতেন।